চরম মুহূর্তে কেন ব্যর্থ রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা?
World Cup Final India Vs Australia : কে এল রাহুল প্রথম থেকেই এতটাই স্লো খেলছিলেন যে তিনি নামার পরে ভারতের রান রেট একেবারে তলানিতে ঠেকে যায়।
ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩-এর ফাইনালে ব্যাট করতে নেমে চরম ব্যর্থ ভারতীয় ব্যাটাররা। আমেদাবাদের মহারণে ফাইনাল ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া। কুড়ি বছর পর ফাইনালে একে অপরের বিরুদ্ধে নেমেছে এই দু'টি দল। ২০০৩ সালে আশা জাগিয়ে ফাইনালে গিয়েও জোহানেসবার্গের মাঠে স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল ভারতের। রিকি পন্টিংদের দুর্দান্ত টিম এফোর্টে বিশ্বজয়ের আশা নিভে গিয়েছিল ভারতের। নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে বিশ্বজয় না হলেও আজ গান্ধীর ভূমিতে সেই বদলা নেওয়ার সুযোগ ভারতের কাছে। কিন্তু ভারতের ব্যাটাররা যেন এই দিনের জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজেদের সব থেকে খারাপ পারফরমেন্স। রোহিত শর্মা থেকে শুরু করে বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আইয়ার, শুভমান গিল, কে এল রাহুল, রবীন্দ্র জাদেজা, সূর্যকুমার যাদব, সবাই রীতিমতো ফ্লপ। আমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে যেখানে ডিউ ফ্যাক্টর রয়েছে, সেখানে মাত্র ২৪০ রানেই থেমে গেল ভারতের ইনিংস। কিন্তু এতটা কেন ব্যর্থ হলেন ভারতীয় খেলোয়াড়রা?
প্রথমত, আজকের ম্যাচে ভারতের প্রত্যেকটি ক্রিকেট ভক্ত ভরসা রেখেছিল রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলির উপরে। প্রথম বল থেকেই ভালো খেলতে শুরু করেছিলেন রোহিত শর্মা। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হলো না হিটম্যান হ্যারিকেন। ১ লক্ষ ৩২ হাজার আসন বিশিষ্ট নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বলে খুবই খারাপ একটা শট খেলে আউট হলেন রোহিত। প্রথম থেকেই নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডিংয়ে চিতার ক্ষিপ্রতা দেখাচ্ছিলেন হেড এবং লাবুসেনরা। সেটা জানা সত্ত্বেও, কেন রোহিত শর্মা এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন শট খেললেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে প্রথম পাওয়ার প্লে-তে ঝড় তুলে এসেছেন রোহিত শর্মা। আর আজকেও সেই হিটম্যান অবতারে দেখা গেল তাকে। দ্বিতীয় ওভারে হেজেলউডকে বেশ কয়েকবার বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে ভারতকে একেবারে চালকের আসনে নিয়ে এসেছিলেন রোহিত শর্মা। মিড অনের হাতে নিজের পছন্দের শট খেলে আউট হয়ে শুভমান গিল প্যাভেলিয়ানে ফেরার পরেও রোহিত শর্মা নিজের ব্যাটিংকে একই জায়গায় ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু তখনই আচমকা ছন্দপতন হলো আহমেদাবাদের মাঠে। পার্ট টাইম স্পিনার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে যেন একেবারে উইকেট ছুড়ে দিয়ে এলেন ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা।
দশ ওভারের দ্বিতীয় বলে ছয় এবং তৃতীয় বলে চার মেরে রোহিতের আত্মবিশ্বাস একেবারে চরমে। সেই আত্মবিশ্বাস এই চতুর্থ বলে স্টেপ আউট মারতে গিয়েছিলেন রোহিত। কিন্তু রোহিতকে এগিয়ে আসতে দেখে লেন্থ কিছুটা পিছিয়ে দিলেন ম্যাক্সওয়েল। আর তাতেই কেল্লাফতে। দূরত্ব না পেয়ে, কভারপয়েন্টে ট্রাভিস হেডের হাতে ধরা পড়লেন রোহিত। রোহিত ইনিংসের শুরুয়াত করে গিয়েছিলেন, কিন্তু এই ধারাকে আর কেউ ধরে রাখতে পারলেন না।
রোহিতের উইকেট পড়ার পরে অনেকে ভেবেছিলেন শ্রেয়াস আইয়র ভালো খেলবেন। বিগত কয়েকটি ম্যাচে রোহিত শর্মার উইকেট পড়ার পরে ভারতের হাল ধরেছিলেন আইয়ার। কিন্তু এই ম্যাচে আর সেরকম হলো না। ব্যক্তিগত ৪৭ রান করে রোহিত আউট হবার পরে খেলাটা কিছুটা ধরেছিলেন বিরাট। আইয়ারকে বলা হয়েছিল সময় নিতে । কিন্তু সেই একই সমস্যা শ্রেয়সের ক্ষেত্রেও। যে পিচে বল স্লো আসছে, সেখানে একটু সময় নিয়ে খেললেও হত। কিন্তু সেই এক ভুল করলেন শ্রেয়াস আইয়ার। চার মেরে খাতা খুলে, পরবর্তী ওভারেই প্যাট কামিন্সকে টার্গেট করতে গেলেন তিনি। কিন্তু, কামিনসের ঘাতক অফকাটার না বুঝতে পেরে পরাস্ত হন শ্রেয়াস এবং মাত্র ৪ রান করে ফেরেন প্যাভিলিয়নে।
কিন্তু ভারতের সবথেকে বড় ক্ষতি হলো অর্ধশতক করার পরেই প্যাট কামিন্সের বলে কোহলির প্লেড অন হয়ে যাওয়া। এমনিতেই হার্দিক পাণ্ডিয়া চোটের কারণে নেই। তাই অতিরিক্ত ব্যাটার খেলানোর বিলাসিতা দেখাতে পারছে না টিম ইন্ডিয়া। তাই এই জায়গায়, ওডিআই-এর রাজার থেকে একটা ভালো ইনিংসের আশা করেছিল সবাই। কিন্তু হঠাৎই দুর্ভাগ্যের শিকার হলেন তিনি। একটা সাধারণ ডেলিভারি ব্যাটের নিচের দিকে লেগে সরাসরি আঘাত করল উইকেটে। ৫৪ রানের মাথায় সাঙ্গ হল এবারের বিশ্বকাপের বিরাট পর্ব। নবম ৫০+ হাঁকিয়ে এবারের মত বিশ্বকাপকে বিদায় জানালেন বিরাট কোহলি।
কে এল রাহুল প্রথম থেকেই এতটাই স্লো খেলছিলেন যে তিনি নামার পরে ভারতের রান রেট একেবারে তলানিতে ঠেকে যায়। পিচ স্লো থাকলেও এতটা স্লো ইনিংস আশা করা যায়না একজন ব্যাটারের থেকে। তাই শেষমেষ রানরেট বৃদ্ধি করতে গিয়ে একটা বাজে শট খেলে আউট হলেন কে এল রাহুল। রবীন্দ্র জাদেজা, সূর্যকুমার যাদবও একইভাবে টার্গেট করতে গিয়ে আউট হলেন। তবে শুধুমাত্র পিচ স্লো বলেই যে এতটা খারাপ খেলতে হবে এরকম বলা যায় না।
আজকে ভারতের ব্যাটিংয়ে একটা সমস্যা প্রথম থেকেই ছিল। অস্ট্রেলিয়ার কাছে মূলত ৪ জন ফুলটাইম বোলার রয়েছে। এরমধ্যে তিনজন ফাস্ট বোলার হলেন প্যাট কামিন্স, যশ হেজেলউড এবং মিচেল স্টার্ক। অন্যদিকে একজন ফুল টাইম স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। আর বাকি যে বোলার অস্ট্রেলিয়া ব্যবহার করেছে তারা সবাই পার্ট টাইমার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, ট্রেভিস হেড এবং মিচেল মার্শ। ভারতের উচিত ছিল এই তিনজন বোলারকে মূলত টার্গেট করা। কিন্তু এই তিন জনের বিরুদ্ধে একেবারেই আক্রমণাত্মক দেখা গেল না ভারতের কোনও ব্যাটসম্যানকে। ম্যাক্সওয়েলের বিরুদ্ধে যেভাবে আক্রমণাত্মকভাবে রোহিত খেলছিলেন, সেটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
টার্গেট করা উচিত ছিল এদেরকে। কিন্তু, ভারতের ব্যাটাররা টার্গেট করে বসলেন ফাস্ট বোলারদের। এমনিতেই দ্রুতগতির বল বিরাট কোহলি ভালো খেলতে পারেন। অন্যদিকে আইয়ার ভালো খেলেন স্পিন। তাই প্যাট কামিন্সকে টার্গেট না করে আইয়ার যদি একটু সময় নিয়ে খেলতেন তাহলে হয়তো কে এল রাহুল একটু সময় নিয়ে ভালোভাবে ব্যাট করতে পারতেন। তাকে এতটা স্লো খেলতে হতো না। অন্যদিকে বলতে হয়, কে এল রাহুলের সময় যখন হেড কিংবা মার্শ বল করছিলেন, তখন তাদেরকে একটু টার্গেট করাই যেত। তাই অনেক দিক থেকেই আজকের ভারতের ব্যাটিং ছিল দুর্বল। এবারে ভরসা বোলারদের উপরেই। তারা যদি ভালো বল করতে পারেন, তাহলেই ভারত পারবে এই বিশ্বকাপ জিততে। নাহলে আবারো পুনরাবৃত্তি হবে ২০০৩-এর ইতিহাসের।