থিকথিকে ভিড় থেকে গরুর ভবিষ্যৎবাণী, বাংলাদেশের ফুটবল উন্মাদনায় হতবাক বিশ্ব
FIFA World Cup 2022: ফুটবলের মহারণে মেতেছে গোটা বিশ্ব। সেখানে বাংলাদেশের উদযাপন অন্য মাত্রা যোগ করেছে। বাদ নেই ভারতও...
রাতের বেলা সামনে বাঁধা ছোট্ট একটা মঞ্চ। জোরালো আলো ঠিকরে পড়ছে চতুর্দিকে। তবে অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার ঘটল এরপরেই। মঞ্চের সামনে যেদিকে তাকাবেন, সেদিকেই থিকথিকে ভিড়। মানুষ, কেবলমাত্র শত শত মানুষের মাথার ভিড়ে ঢেকে গিয়েছে প্রাঙ্গণ। ভোটের মরসুমে গভীর রাতে সভা হচ্ছে নাকি? আদতে এই ভিড়ে কোনও রাজনীতির পরিসর নেই। এর একটাই রঙ, হলুদ-সবুজ। গত সোমবার, ২৮ নভেম্বর ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের হাই ভোল্টেজ ম্যাচ। গ্রুপ পর্যায়ের দ্বিতীয় খেলায় জাকা, শাকিরি, এমবোলোর সুইজারল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল। সেই খেলা দেখতেই বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেছিল জায়ান্ট স্ক্রিন। সেখানেই কাতারে কাতারে ভিড় জমিয়েছিল খেলাপাগল জনতা। এই ম্যাচে ব্রাজিলের জয় সেই উন্মাদনাকে আরও যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছবিই এখন নেট দুনিয়ায় ভাইরাল।
ব্রাজিল আসরে নামলে আর্জেন্টিনাও কি চুপ করে থাকবে? লাতিন আমেরিকার এই দুই দলের ময়দানি লড়াইয়ে সামিল হয় গোটা বিশ্ব। শুধু ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলাদেশেও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের উল্লাস চোখে পড়ার মতো। ২৭ নভেম্বর, রবিবার ছুটির দিনে ছিল আর্জেন্টিনা বনাম মেক্সিকোর ম্যাচ। সৌদি আরবের সঙ্গে হারের ধাক্কা কীভাবে পূরণ করে নীল-সাদা ব্রিগেড, সেটাই ছিল দেখার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই জায়ান্ট স্ক্রিন আবারও সজাগ হয়, কেবল রঙটা বদলে যায় নীল-সাদায়। ২ গোলে আর্জেন্টিনা জিতে যাওয়া, লিওনেল মেসি এবং এনজো ফার্নান্ডেজের দুরন্ত গোলের ছটায় জেগে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর। সেদিনও ময়দানে ছিল থিকথিকে ভিড়। বাংলাদেশের সেই উন্মাদনার ছবি স্তম্ভিত করেছে গোটা বিশ্বকে। ফিফা স্বয়ং সেই উচ্ছ্বাসে মুগ্ধ। মেসির গোলের পর বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদযাপনের একটি ভিডিও তারা নিজেদের টুইটারেও পোস্ট করে।
This is the power of football ❤️@Argentina fans in Bangladesh celebrating Lionel Messi's goal in the #FIFAWorldCup victory over Mexico last night 🙌🇦🇷pic.twitter.com/HSE6JGGRsw
— FIFA.com (@FIFAcom) November 27, 2022
আরও পড়ুন : সৌদি আরবের ড্রেসিংরুমে ঠিক কী বলেছিলেন কোচ হার্ভে রেনার্ড?
ভারত ও বাংলাদেশ – প্রতিবেশী এই দুই দেশ বিশ্ব ক্রিকেটের পরিচিত দুই মুখ। টেস্ট থেকে বিশ্বকাপ, সব জায়গায় তাদের দেখা মেলে। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপ যেন দূর গ্রহের বাসিন্দা। ভারত তবুও ১৯৫০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের সুখ্যাতি গোটা এশিয়া জুড়েই। পেলের কসমসকেও রুখে দিয়েছিল বাংলা। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেভাবে কোনও সোনালি রেখা নেই। সম্প্রতি ২০২২ মহিলা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জয়লাভ করেছে বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল দল। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের মহারণে দর্শক হিসেবেই অংশ নিতে হয় ভারত ও বাংলাদেশকে। বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন আজও দেখে চলেছে আট থেকে আশি। কিন্তু তাতে উন্মাদনায় ভাটা পড়েনি এতটুকুও। কলকাতার অলিতে গলিতে তো বটেই, গোটা ভারত জুড়ে একটাই দ্বন্দ্ব – ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? রোনাল্ডো, মেসির পাশে উঠে আসে নেইমারের নামও। কলকাতার এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে গেলে চোখে পড়বে ফুটবল জার্সির আনাগোনা। সোশ্যাল মিডিয়ায় স্পষ্টতই ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার যুযুধান। কখনও চলে আসে পর্তুগাল, জার্মানি বা স্পেনের প্রসঙ্গ। ইতিউতি দেখা গিয়েছে গতবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের পতাকাও। বিশ্বকাপে না থাকলেও, কলকাতা তথা গোটা ভারত প্রবলভাবে রয়েছে কাতারে। রইল আর্জেন্টিনা বনাম মেক্সিকো ম্যাচের সময় ভারতের কেরালার একটি দৃশ্য...
A huge crowd has assembled at Nainamvalappu in Kozhikode, Kerala to watch #ArgentinavsMexico #FIFAWorldCupQatar2022 pic.twitter.com/zLDA7DkHpJ
— Onmanorama (@Onmanorama) November 26, 2022
আর বাংলাদেশ? কেবল এশিয়া নয়, ইউরোপ, দুই আমেরিকাই অবাক এখানকার ফুটবল উন্মাদনায়। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক। বিশ্বকাপ এলেই নিত্য নতুন ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের জন্ম হয়। পল দ্য অক্টোপাসের কথা আজও গোটা বিশ্ব মনে রেখেছে। এবার বাংলাদেশেও আবির্ভাব হয়েছে তেমনই ‘একজনের’। মানুষ নন, আস্ত একটি গরু। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় গরুটি বিশ্বকাপের ভবিষ্যৎ খোলসা করে জানিয়েছে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা না জার্মানি – কে হাতে তুলবে এবারের সোনালি কাপ এই প্রশ্ন ছিল জনতার মনে। তাই এই তিন দেশের পতাকার রঙে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল তিনটি ড্রাম। সেখানে রাখাছিল ঘাস। বলা হয়েছিল, গরুটি যে ড্রাম থেকে ঘাস খাবে, তারা জিতবে। ব্রাজিলের ড্রাম থেকে ঘাস খাওয়ার পর কুষ্টিয়ার ওই অঞ্চলে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে যায়!
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ভক্তদের মধ্যে লড়াই তো কিংবদন্তিসম হয়ে গিয়েছে। সেই লড়াইয়ে এবার অন্য জোয়ার তুলেছে বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় করে ম্যাচ দেখা তো হয়েই গেল। এছাড়াও আছে সুবিশাল পতাকা। বাংলাদেশের নওগাঁয় আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থকরা ১২০ ফুট দীর্ঘ আর্জেন্টাইন জাতীয় পতাকা ওড়ান। ব্রাজিলের সমর্থকরা এবার চুপ করে থাকবেন কেন? সাত তাড়াতাড়ি তাঁরা একই জায়গায় ২৭০ ফুট দীর্ঘ ব্রাজিলের পতাকা টাঙিয়েছেন। গ্রাম থেকে মফস্বল, শহরের অলি গলি রাজপথে এমন দৃশ্য আকছার দেখা যাচ্ছে। এমনকী দু’পক্ষের মধ্যে চলে মারামারিও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুটবল উন্মাদনা ভারত-বাংলাদেশের রক্তে। তবে ১৯৮৬ সালে মারাদোনার বিশ্বকাপ জয়ের পর ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জয়জয়কার আরও প্রকট হয় উপমহাদেশে। সামনে আসে পেলে বনাম মারাদোনার মতো প্রসঙ্গ। বর্তমানে সেই জায়গাটা নিয়েছেন মেসি ও নেইমার। পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোও সেই জায়গায় ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু চায়ের ঠেকে আড্ডার মূল চালিকাসূত্র আজও সেই আদি অকৃত্রিম ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা…
আরও পড়ুন : আর্জেন্টিনার খেলা দেখার অপেক্ষায় ছিল ছোট্ট মেয়েটি, দাদা-ই কেটে টুকরো করল তাকে!
এই উন্মাদনাই নজর কেড়েছে গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের। তারা এও জেনে অবাক হয়েছেন, আর্জেন্টিনার পর বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি নীল-সাদা জার্সির সমর্থকরা রয়েছেন। অন্য একটি দেশ জেতার পর মানুষ হাসছে, কাঁদছে, আনন্দে লাফিয়ে উঠছে- এ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না তারা। কলকাতায় যখন এসেছিলেন, তখন এই উন্মাদনা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং মারাদোনাও। ফিফা ক্রম তালিকায় ১৯২ (বাংলাদেশ) ও ১০৬ (ভারত) তম স্থানে থাকা দু’টি দেশের উন্মাদনা বারবার মুগ্ধ করেছে লাতিন আমেরিকার মানুষদেরও। তাই তো কলকাতার আর্জেন্টিনা ভক্ত চা-ওয়ালার দোকান উঠে আসে বিশ্বকাপের পর্দায়। বাংলাদেশের মেসি ভক্ত আলিনা ইসলাম আয়াতের হত্যার ঘটনায় শিহরিত হয় পেরু, আর্জেন্টিনাও।
ভারত ও বাংলাদেশ কবে নিজেরাও ফুটবল বিশ্বকাপে জায়গা পাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। কেবল দিনের শেষে মাঠ পেরিয়ে কাদামাখা ছেলেটা এখনও স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। বল পায়ে ছুটে চলে গোলের সন্ধানে। তাই তো বিশ্বকাপেরথিক আগে বাংলাদেশের এক পথশিশুর ছবি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। ছড়িয়ে পড়ে ব্রাজিলে, আর্জেন্টিনায়। শতচ্ছিন্ন হলুদ রঙের ময়লা জামাটার পিছনে লেখা থাকে স্বপ্নের নাম। ‘মেছি ১০ হিরা’। ফুটবলের স্বপ্নের ভাষা এভাবেই গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়, প্রতিবার…