পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, বাংলাদেশ, জলপথেই ঘটছে মেলবন্ধন

আগামী ডিসেম্বর মাসে ফের এমন এক যাত্রার সাক্ষী থাকবে সমস্ত পৃথিবী। তবে এবারের নদীপথে যাত্রাটি গোটা বিশ্বের দীর্ঘতম নৌসফর। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বুকে ৫১ দিনব্যাপী এই সফর হবে মূলত অন্তরা লাক্সারি রিভার ক্রুজেস-এর উদ্যোগে।

অতুল গুপ্তর ‘নদীপথে’ চিঠি আকারে একটি ট্রাভেলগ। তরতরে গদ্য যেন নদীর বুক চিরে ছুটে চলেছে খোদ। বাংলার নদীপথ যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। এত ধরনের নৌকোর উৎপত্তি সেই জন্যই। লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে পুবে গিয়েছিলেন এই কারণেই, অশ্বারোহী মুসলমান সেনারা নদীর জাল দেখে এগোতে সাহস পেত না, বারবার নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে তাদের। সিরাজ পালিয়েছিলেন নদীপথেই। ফলে নদনদীর সঙ্গে যাতায়াতের ব্যাপারটা এই সেদিন পর্যন্তও ছিল। কিন্তু নদীখাত পরিষ্কার না রাখায় ধীরে ধীরে এপার বাংলায় তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে এখনও লঞ্চ, স্টিমার— নানা ধরনের নৌকোর ব্যবহার রয়েছে। অতুল গুপ্ত কলকাতা থেকে নদীপথে গিয়েছিলেন আসাম। আগামী ডিসেম্বর মাসে ফের এমন এক যাত্রার সাক্ষী থাকবে সমস্ত পৃথিবী। তবে এবারের নদীপথে যাত্রাটি গোটা বিশ্বের দীর্ঘতম নৌসফর।

গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বুকে ৫১ দিনব্যাপী এই সফর হবে মূলত অন্তরা লাক্সারি রিভার ক্রুজেস-এর উদ্যোগে। উত্তরপ্রদেশের কাশী থেকে যাত্রা শুরু। মাঝে সুন্দরবন হয়ে বাংলাদেশের পথে পাঁচটি রাজ্য এবং দু'টি দেশ পেরিয়ে যাওয়া হবে অসমের ডিব্রুগড় পর্যন্ত। পথে সাতাশখানা নদী পেরবেন যাত্রীরা। যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম অঞ্চলগুলির সঙ্গে পরিচিত হতে চান, তাঁদের জন্য এই সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আসতে চলেছে অন্তরার নতুন আর্ট ডেকো বুটিক জাহাজ। তার নাম অন্তরা গঙ্গা বিলাস। যাঁরা ইতিহাস ভালবাসেন, যাঁরা নানা ধরনের সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করতে ভালবাসেন, ভালবাসেন নৈসর্গিক সৌন্দর্য– তাঁরা প্রাণভরে উপভোগ করবেন এই যাত্রা। আবার একই সঙ্গে এতে কম দূরত্বের যাত্রীরাও যেতে পারবেন বিভিন্ন স্টেশনে। যতদূর প্রয়োজন গিয়ে নেমে যেতে পারবেন তাঁরা।

এই অভূতপূর্ব ভ্রমণসূচি সম্বন্ধে অন্তরা লাক্সারি রিভার ক্রুজেস-এর প্রেসিডেন্ট এবং প্রতিষ্ঠাতা রাজ সিং জানিয়েছেন, 'যাত্রার প্রত্যেকটি বিষয় আমি নিজে পরখ করে দেখেছি, যাত্রীরা অত্যন্ত আরামে যাত্রা করতে পারবেন। বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার যৌথভাবে এই যাত্রার আয়োজনে সাহায্য করেছে, ভরসা দিয়েছে আমাদের। তার জন্যই বিনা বিপত্তিতে এক অনন্য যাত্রা উপভোগ করতে পারবেন যাত্রীরা।' এছাড়াও রাজ সিং-এর আরেকটি পরিচয় রয়েছে। তিনি উপমহাদেশের স্তন্যপায়ী, পাখি এবং জলজ প্রাণীদের নিয়ে লেখালেখি করছেন অনেকদিন। তাঁকে ভারতীয় বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ হিসেবেও চেনেন অনেকে। যাই হোক, দীর্ঘ এই যাত্রার প্রতিটি দিন যাত্রীরা খানিকটা সময় নদীতে কাটাবেন, খানিকটা কাটাবেন স্থলে। বেনারসে যাত্রা শুরু। এরপরে গঙ্গা বেয়ে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের নানা দর্শনীয় স্থানে থামবে এই জাহাজ। থামবে পশ্চিমবঙ্গের নানা দর্শনীয় স্থানেও। খুঁটিয়ে দেখা হবে সমস্ত ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের চিহ্ন এবং আঞ্চলিক রীতিনীতি, বৈশিষ্ট্য, স্থাপত্য ইত্যাদি। তারপর ফের বাহনে ফিরে আসা। এরপরে ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা। বিশ্বের সবথেকে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্যও এইটি। সুন্দরবন হয়ে জাহাজ পৌঁছবে বাংলাদেশে। বরিশালের জলে ভাসমান বাজার হয়ে বাগেরহাট। সেখানকার ঠাকুরদিঘি নামে একটি স্বাদু জলের জলাশয়ের পূর্ব তীরে অবস্থিত ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। তা দেখে সোজা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক শহর সোনারগাঁও। এরপরে ঢাকা থেকে যমুনার দিকে বাংলাদেশের উত্তরে ক্রমশ এগোনো। খানিক পুবে ঘুরে ধুবড়ি। এখান থেকে ব্রহ্মপুত্রে পড়বে জাহাজ। প্রকৃতির বুকে অসংখ্যা মানুষের বসতির কোল ঘেঁষে নানা সংস্কৃতিকে চাক্ষুষ করতে করতে অসমের দিকে এগিয়ে যাবেন যাত্রীরা।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুতে শ্যামলীর জয়যাত্রা, যেভাবে জুড়ছে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা

এই যাত্রার অভিনবত্ব আরেকটু খুলে ব্যাখ্যা করেন রাজ। বলেন, 'অতিথিরা মাতিয়ারির মতো বিখ্যাত জায়গা ঘুরবেন। দেখবেন পেতলের কাজ কেমন করে হয়, টালির কাজ কেমন করে হয়। গ্রামে গ্রামে কুটিরশিল্প নিজের চোখে দেখতে পাবেন তাঁরা। ২৫০০ বছরের পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট ঘুরে দেখবেন। আমরা তাঁদের বিক্রমশিলা দেখাব। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় দেখাব। বৌদ্ধদের এই বিশ্ববিদ্যালয় দেখার পর্যাপ্ত সময় সময় পাবেন যাত্রীরা। ভাগলপুরের তসর কাজ দেখবেন। বাংলার ঔপনিবেশিক প্রভাব, ফরাসি এবং দিনেমার প্রভাবের স্থাপত্য, বাংলাদেশ বর্ডারে সুন্দরবনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, বাংলাদেশে জীবন, শিল্প, সংস্কৃতি ফুতে উঠবে যাত্রীদের চোখের সামনে। সরাসরি সেই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে, কারিগরদের সঙ্গে, শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন যাত্রীরা। এইভাবে একটা একটা করে বিষয় পর্যালোচনা করে আমরা যাত্রার পরিকল্পনা করেছি। গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরজুড়ে যে জনজীবন, যে সমৃদ্ধি ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে, তার সম্বন্ধে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ধারণা লাভ করবেন যাত্রীরা।'

এইসব চিরকালীন অথচ চিরপরিবর্তনশীল নদীতীরে, উপকূলবর্তী অঞ্চলের নানা কারিগরি এবং শিল্পের কথা বিশদে বলেন, আর্ট হিস্টোরিয়ান অন্নপূর্ণা গরিমেল্লা। তাঁর মতে, 'একরকমভাবে বলা যায়, এইসব নদীতীরেই জীবন এবং সভ্যতার শুরু। কাজেই নিজ নিজ সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন এইসব অঞ্চলে দেখা যায় আজও। খাবারদাবার হোক, বয়নশিল্প হোক, স্থাপত্যশিল্প হোক বা চাষাবাদ হোক– এই যাত্রা বহুমুখী অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করবে যাত্রীদের। এই উন্মুক্ত নিসর্গের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া এককথায় যাবতীয় ভারতের বিভিন্নতাকে এক যাত্রায় উপভোগ করা।'

অন্তরা গঙ্গা বিলাস নির্মিত হয়েছে বিংশ শতকের আধুনিক রীতিতে। ১৮টি সুইট রয়েছে এতে। প্রতিটি ঘর সাজাতে যে সুতো, লিনেন, আসবাব এবং টেবিলসজ্জা ব্যবহার করা হয়েছে- তার প্রত্যেকটি ভারতে তৈরি। কিছু সজ্জাসামগ্রী তৈরি হয়েছে এই নদীতীরের দু'পাশেই। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিশাল সমস্ত জানলা দিয়ে নদী যেন ঢুকে পড়ে খোলামেলা জাহাজের মধ্যে। এই যাত্রা নিয়ে বেশ উৎসাহিত সবাই। এত কাছ থেকে নদীপারের জনজীবন দেখার সুযোগ আর ক'বার হয়!

 

More Articles