ঋদ্ধিমান কাণ্ডে ক্রিকেট সাংবাদিকতার মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে কুৎসিত মুখ
ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ শুরু হলেই বাঙালির জাত্যভিমান চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকে। এমন একটা সময়ে সর্বশেষ বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার ঋদ্ধিমান সাহাকে (বাংলা থেকে নির্বাচিত সর্বশেষ টেস্ট ক্রিকেটার অবশ্য উত্তরপ্রদেশ থেকে এসে কলকাতার বাসিন্দা হয়ে যাওয়া মহম্মদ শামি) ভারতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজের জন্য দল ঘোষণা ১৯ ফেব্রুয়ারি হয়ে থাকলেও সংবাদমাধ্যমে আগেই প্রকাশিত হয়েছিল, ভারতীয় দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড় নাকি ঋদ্ধিমানকে বলে দিয়েছেন, তাঁকে দলে নেওয়া হবে না। প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মা দল ঘোষণা করার পর থেকে ঋদ্ধিমান বেশ কয়েকটা সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলেছেন। সর্বত্রই পরিষ্কার যে সত্যিই তাঁকে দ্রাবিড় সেরকমই বলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, চেতনও ফোনে বলেছিলেন এরপর থেকে আর ঋদ্ধিমানের কথা ভাবা হবে না। একে ঋদ্ধিমান ধনী ক্রিকেট প্রশাসক বাবার আদরের ছোট ছেলে নন, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার; তার উপর তিনি কলকাতার ছেলে নন, শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। সেই কারণেই বোধহয় বাঙালির আবেগের এখনো তেমন বিস্ফোরণ ঘটেনি। তার আবেগ উস্কে দেয় কলকাতার যে খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো, তারাও এখনো ঈষদুষ্ণ; টগবগিয়ে ফুটছে না। এর পাশে সৌরভ গাঙ্গুলির খেলোয়াড় জীবন মনে পড়লে অবাক লাগে।
জীবনের প্রথম দুটো টেস্টে শতরান করার পরে বাংলা কাগজগুলো স্রেফ সৌরভের প্রশংসা করে থামত না। তাঁকে যে কোনো মুহূর্তে বাদ দেওয়া হতে পারে, এমন আশঙ্কা সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত। ওয়েস্ট ইন্ডিজে সৌরভ একটা টেস্টে বাদ পড়লেন। বাংলা কাগজে টেস্ট ম্যাচের রিপোর্টের থেকেও বেশি জল্পনা কল্পনা হল ভারতীয় দলে কতজন ব্রুটাস আছে তা নিয়ে। অধিনায়ক শচীন যে সৌরভকে মোটেই পছন্দ করেন না, তিনি ছেলেবেলার বন্ধু বিনোদ কাম্বলির জন্যে সৌরভকে বলি দিচ্ছেন -- এসব কথা আমরা তখন গোগ্রাসে গিলতাম। আশ্চর্যের ব্যাপার, সৌরভকেই অধিনায়ক শচীন টাইটান কাপে নিজের ওপেনিং পার্টনার করে নিলেন। সেই জুটি একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা জুটি হয়ে উঠল। ২০০২ সালে অধিনায়ক সৌরভই সেই জুটি কিছুদিনের জন্য ভেঙে দিয়েছিলেন। আর কাম্বলি? তাঁর কেরিয়ার বেশি লম্বা হয়নি। তিনি বহু বছর পরে এক সংবাদমাধ্যমকে দুঃখ করে বলেছিলেন, শচীন আমার ছোটবেলার বন্ধু অথচ আমাকে একটু সাহায্য করল না। করলে আমার কেরিয়ারটা অন্যরকম হতে পারত। অধিনায়ক হিসাবে শচীন যে ঠিক লোকের উপরেই ভরসা করেছিলেন, সৌরভের কেরিয়ারই তার প্রমাণ।
গ্রেগ চ্যাপেলের আমলে তো চ্যাপেল আর দ্রাবিড় হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির জাতীয় শত্রু। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটারটি যে কত বড় বদমাইশ, সে কথা গজাল দিয়ে বাঙালির মাথায় গুঁজে দিয়েছিল কলকাতার সংবাদমাধ্যম। তার ফল পাওয়া গিয়েছিল হাতে নাতে। সেইসময় ইডেন উদ্যানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটা একদিনের ম্যাচে গোটা স্টেডিয়াম সমর্থন করেছিল গ্রেম স্মিথের দলকে। ভারতীয় অধিনায়ক বোল্ড হতে দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন। তখন ভারতের বিপক্ষ দলকে সমর্থন করলে গ্রেফতার করার রেওয়াজ ছিল না। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না।
২০১৮ সালে অস্ত্রোপচারের জন্যে ভারতীয় টেস্ট দলের এক নম্বর উইকেটরক্ষক ঋদ্ধিমানকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল, তাঁর জায়গা নিয়েছিলেন ঋষভ পন্থ। ঋদ্ধিমান যে সেইসময় ভারতের সেরা উইকেটরক্ষক তা নিয়ে কোথাও কোনো বিতর্ক ছিল না, বরং তিনিই বিশ্বসেরা কিনা তা নিয়ে আলোচনা হত। সৈয়দ কিরমানি থেকে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট -- কিংবদন্তি উইকেটরক্ষকরা সকলেই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। অথচ ঋদ্ধিমান ফিট হয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন অধিনায়ক বিরাট কোহলি আর কোচ রবি শাস্ত্রী কিন্তু তাঁকে তাঁর জায়গা ফিরিয়ে দেননি। ঋষভ ঋদ্ধিমানের অনুপস্থিতিতে ইংল্যান্ডে শতরান করেছিলেন সত্যি, একবার এক ইনিংসে পাঁচটা ক্যাচ নিয়েছিলেন তা-ও সত্যি। কিন্তু তাঁর কিপিং যে মোটেই টেস্ট ক্রিকেটের মানের নয়, তা সাদা চোখেও ধরা পড়ত। বিশেষ করে স্পিনাররা বল করলে একেকসময় ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াত। তবু ক্রমশ ঋদ্ধি হয়ে গেলেন টিম ম্যানেজমেন্টের দ্বিতীয় পছন্দ, ঋষভ বারবার ব্যর্থ না হলে অথবা আহত না হলে ঋদ্ধির জন্য প্রথম একাদশের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তাতে সময়ে সময়ে বোলারদের উপর নিদারুণ অবিচার হচ্ছে দেখে নতুন সূত্র তৈরি করা হল, বিদেশে কিপিং করবেন ঋষভ আর দেশে ঋদ্ধি। সবসময়ে সেটাও অবশ্য মানা হয়নি। আশ্চর্যের কথা, পড়তি ফর্মের সৌরভকে বাদ দেওয়া হয়েছিল বলে যে সাংবাদিকরা প্রায় ধর্মযুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন, তাঁরা ফর্মে থাকা ঋদ্ধিমানের প্রতি অবিচার নিয়ে বিশেষ শব্দ খরচ করেননি।
ঋষভের ফর্ম মুখ বন্ধ করে রেখেছিল -- এই যুক্তি কিন্তু খাটবে না। কারণ প্রমাণিত যোগ্যতার সিনিয়র খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে দারুণ খেলেও তিনি ফিরে আসায় জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে জুনিয়রকে -- এমন ঘটনা কোহলি-শাস্ত্রী জমানায় একাধিকবার ঘটেছে। বোলারদের ক্ষেত্রে তো আকছার এমনটা হয়েই থাকে। কিন্তু সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা ব্যাটার করুণ নায়ারের। ২০১৬ সালে চোটের জন্য অজিঙ্ক রাহানে দলের বাইরে থাকায় খেলতে নেমে করুণ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শতরান নয়, দ্বিশতরান নয়, ত্রিশতরান করেছিলেন। পরের টেস্টে কিন্তু রাহানে নিজের জায়গা ফেরত পান। করুণ তারপর আর মাত্র তিনটে সুযোগ পেয়েছিলেন। রাহানেকে জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে তখন অধিনায়ক কোহলি বলেছিলেন, একটা পারফরম্যান্স অন্য একজন খেলোয়াড়ের কয়েক বছরের পরিশ্রমের মূল্য চুকিয়ে দিতে পারে না।১ আজ রাহানের ফর্ম নেই, দল থেকে বাদ পড়েছেন বলে অনেকেই কোহলির এই মন্তব্য পড়ে নাক সিঁটকাবেন। কিন্তু সেদিন রাহানের গড় ছিল প্রায় পঞ্চাশ। সুতরাং কোহলি ভুল কিছু বলেননি। তবে দু বছরের মধ্যেই ঋষভের নড়বড়ে কিপিং আর একটা শতরান যে কী করে ঋদ্ধিমানের চার বছরের মসৃণ কিপিং আর তিনটে শতরানের চেয়ে বেশি মূল্যবান হয়ে গেল, সে এক রহস্য।
আরও বড় রহস্য হল ব্যোমকেশে আপ্লুত কলকাতা শহরের সংবাদমাধ্যমের এই রহস্য উন্মোচনে উৎসাহের অভাব। সৌরভকে বাদ দিয়ে গ্রেগ চ্যাপেল দুর্গার অসুর হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় ফেলুদার ছবি করার সত্ব সন্দীপ রায় ছেড়ে দিলে, আর রিমেক হুজুগ থাকলে, নির্ঘাত মন্দার বোসের নাম রাহুল দ্রাবিড় করে দেওয়া হত। এ যুগে কিন্তু কলকাতার সংবাদমাধ্যমে কোহলি বন্দনায় ছেদ পড়েনি। তাঁর ট্যাটু থেকে হেলথ ড্রিঙ্ক, প্রেম-অপ্রেম সবই বাঙালিকে ষোড়শোপচারে খাওয়ানো হয়েছে। এমনও নয় যে বাংলার গৌরব সৌরভ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান বলেই ঋদ্ধির ব্যাপারটা মানিয়ে নেওয়া হয়েছে। কারণ সৌরভ বোর্ড সভাপতি হয়েছেন ২০১৯ সালে; ঋদ্ধিমানকে যখন দু নম্বর করে দেওয়া হল, তখন বোর্ড বলে প্রায় কিছুই ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত অ্যাড হক কমিটির মাথা হিসাবে বোর্ড চালাচ্ছিলেন বিনোদ রাই। তিনি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল থাকাকালীন মনমোহন সিং সরকারের প্রতি যতটা কড়া ছিলেন, ঠিক ততটাই শিথিল ছিলেন কোহলি-শাস্ত্রীর টিম ম্যানেজমেন্টের প্রতি।
আসলে ভারতীয় ক্রিকেট কোনোদিনই পুরোপুরি ক্রিকেটিয় যুক্তি মেনে চলে না, আর ভারতীয় সাংবাদিকতা বহুদিন হল সাংবাদিকতার যুক্তি মেনে চলে না। ক্রিকেট সাংবাদিকতা তো নয়ই। এ দেশের ক্রিকেট সাংবাদিকতার মহীরুহরা সেই সৌরভ, শচীনদের সময় থেকেই খেলাটিকে ভুলে বাণীতে মনোনিবেশ করেছেন। সৌরভের নয়নাভিরাম কভার ড্রাইভের বিশ্লেষণে নয়, তাঁদের ওস্তাদি ছিল সৌরভ অমুক জায়গা থেকে তমুক জায়গায় যেতে যেতে গাড়িতে কী বললেন তার স্টেনোগ্রাফি করায়। ক্রিকেট সাংবাদিকতাকে সফলভাবে গসিপ সাংবাদিকতায় পরিণত করা হয়েছে গত শতকের শেষ থেকেই।
এখন মুশকিল হল, চেতেশ্বর পূজারা, রাহানে, ঋদ্ধিমানের মত লোকেরা ক্রিকেট খেলতে শিখেছেন। আক্রমণাত্মক ইংরেজি বলতে শেখেননি; বলিউডি নায়িকার সাথে প্রেম করতে পারেননি; মাঠে নেমে স্রেফ ক্যাচ ধরে, স্টাম্পিং করে আর রান করে চলে আসা যে কর্তব্য নয় তা-ও বোঝেননি। ফলে তাঁদের গ্ল্যামার নেই। যার গ্ল্যামার নেই তার খেলা সম্পর্কে লেখার ক্ষমতা আমাদের সাংবাদিকরা হারিয়েছেন, পাঠকের অভ্যাসও নষ্ট করে দিয়েছেন। এখন ঋদ্ধিমান বাদ পড়েছেন বলে আপনি যতই সহানুভূতি দেখান, বিরাট কী খেলেন, টুরের মাঝের বিরতিতে অনুষ্কাকে নিয়ে কোথায় গেলেন --- এসব লিখলে আপনি হামলে পড়ে পড়বেন। ঋদ্ধিমান কোন অনুশীলনের জোরে যশপ্রীত বুমরার ঘন্টায় নব্বই মাইল গতিতে ধেয়ে আসা প্রচণ্ড সুইং হওয়া বলও অক্লেশে তালুবন্দি করেন তা নিয়ে লিখলে আপনার পানসে লাগবে। সৌরভ কেবল বাঙালি নন, তাঁর গ্ল্যামার ছিল। কালোকোলো বেঁটেখাটো রোগাসোগা ঋদ্ধির সেটা নেই। আছে বিরাটের, আছে রবি শাস্ত্রীর। তাঁরা ফোন ধরা বন্ধ করে দিলে আমাদের সাংবাদিকরা চোখে অন্ধকার দেখবেন। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগ; বাংলা কাগজে, সাইটে বা চ্যানেলে বিরাটের সমালোচনা করে রিপোর্টার নিশ্চিন্তে তাঁর সাথে হেঁ হেঁ করতে যাবেন, সে গুড়ে বালি। ঠিক বিরাটের কানে পৌঁছে যাবে, অমুক জায়গায় তমুক কথা লেখা হয়েছে। আর সহিষ্ণুতায় এই প্রজন্মের তারকারা একেবারে শজারুপ্রতিম। ওসব ঝামেলায় কে পড়তে যাবে বাপু? কী জানি তা দিয়ে তো আর সাংবাদিকতা হয় না এ যুগে, হয় কাকে চিনি তা দিয়ে। বিরাট, রবিকে চিনলেই লাভ। ঋদ্ধিমানকে তো যে টিভিতে খেলা দেখে সে-ও চেনে।
অর্থাৎ যে গ্ল্যামারাস, ক্ষমতাশালী -- তার সাতখুন মাফ।
কিন্তু জনরুচিকে সবসময়, সব বিষয়ে ইচ্ছে মতো চালনা করতে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী পারেন না; ক্রিকেট মাঠের উডওয়ার্ড, বার্নস্টাইনরা তো কোন ছার। তাই এই মুহূর্তে ঋদ্ধিমানের বাদ পড়া নিয়ে কিঞ্চিৎ লেখালিখি করতেই হচ্ছে। হাজার হোক, বাঙালি ক্রিকেটার বংশে বাতি দিতে উনিই তো ছিলেন। তাঁকে বাদ দেওয়ায় জাতির ভাবাবেগ বিলক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের ক্রিকেট সাংবাদিকরা বাজার বোঝেন। ঋদ্ধিমানের চোখের জল বিকোবে ভাল। অতএব দ্রাবিড়কে খলনায়ক বানানোর প্রকল্প আবার চালু হয়েছে। যখন ঋদ্ধিমানের হয়ে কলম ধরা উচিত ছিল তখন এঁরা নিদ্রামগন ছিলেন, এখন গগন অন্ধকার করে প্রমাণ করতে নেমেছেন, আটত্রিশে পা দিতে চলা ঋদ্ধিমানকে বাদ দেওয়া ঘোরতর অন্যায়।
সদ্য ভাষা শহিদ দিবস গেল বলে ঋদ্ধিকে শহিদ ঠাওরাতে যতই মন চাক, ক্রিকেটিয় যুক্তি কিন্তু অন্য কথা বলে। ঋষভের ব্যাটিং গড় এখন প্রায় চল্লিশ, ঋদ্ধিমানের তিরিশও নয়। উপরন্তু গত বছরের অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্রিসবেনে যে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছেন ঋষভ, মানতেই হবে সে ইনিংস খেলা ঋদ্ধিমানের পক্ষে সম্ভব নয়। ঋষভের কিপিংয়েও উন্নতি হয়েছে সম্প্রতি। তার কারণ হয়ত ঋদ্ধি স্বয়ং। দ্রাবিড়কে খলনায়ক বানানোর জন্য এক সাংবাদিক সম্প্রতি রবি শাস্ত্রীর ইয়াব্বড় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ঋদ্ধিকে এক নম্বর থেকে দু'নম্বর করে দেওয়া কোচ সেখানে তাঁকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন এমন টিমম্যান দেখা যায় না। নিজে খেলতে পাবে না জেনেও হাতে ধরে ঋষভকে শিখিয়েছে। তাকে এভাবে বিদায় করা অনুচিত।
অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটে কী করে কিপিং করতে হয় একজন জানত না। তা সত্ত্বেও তাকে খেলানো হয়েছে এবং তাকে খেলতে শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে, যে খেলতে জানত। এখন কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করা হচ্ছে। দ্রাবিড়কে মগনলাল মেঘরাজ বানাতে হবে বলে এক বাঙালি সাংবাদিক এই অশ্রু বিসর্জনের পরিসরটি তৈরি করে দিলেন।
সাংবাদিকদের দোষত্রুটি নিয়ে এত কথা লেখার কি কোনো দরকার আছে? সত্যিই দ্বিধায় ছিলাম। দ্বিধা কাটিয়ে দিল ঋদ্ধিমানের একটি টুইট। ১৯ তারিখ সকালে এক টুইটে ঋদ্ধিমান জানালেন, এতক্ষণ যাঁদের নিন্দা করছি তেমনই এক “শ্রদ্ধেয়” সাংবাদিক সাক্ষাৎকার চেয়েছিলেন। তিনি পাত্তা দেননি বলে সাংবাদিকটি গ্যাংস্টারের কায়দায় হুমকি দিয়েছেন, ফল ভাল হবে না। এই সাক্ষাৎকার-সর্বস্ব সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার যতটা ক্ষতি করেন, ততটাই ক্ষতি করেন ক্রিকেটারদের এবং ক্রিকেটের। এঁরাই অফসাইডের রাজা সৌরভকে বোঝাতেন, যে অত সহজে বাউন্ডারি মারতে পারে তার রানিং বিটুইন দ্য উইকেটসে উন্নতি না করলেও চলে। এঁরাই সৌরভের টেকনিকের ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা ধারাভাষ্যকারদের বাঙালিবিরোধী প্রতিপন্ন করতেন। ফলে সৌরভের শর্ট বল খেলার দুর্বলতা রয়েই গেল, নইলে তাঁর মতো প্রতিভাবানের টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র হাজার সাতেক রান আর ৪২ গড় নিয়ে কেরিয়ার শেষ করার কথা নয়। ফলে এই সাংবাদিকদের কুপ্রভাব নিয়ে যতদূর সম্ভব লেখা দরকার বইকি। আগে কেউ ঋদ্ধির মত চ্যাট ফাঁস করে দিয়ে এঁদের কাঠগড়ায় তোলেনি। হয়ত সোশাল মিডিয়া ছিল না বলে তা করা সম্ভবও ছিল না। এখন শোনা যাচ্ছে, বোর্ড নাকি ঘটনার তদন্ত করবে।
সে তদন্তে অবশ্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকটির শাস্তির সম্ভাবনা কম, উল্টে ঋদ্ধিরই শাস্তি না হলে হয়। কারণ সাংবাদিকরা কেবল নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতেই শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটার, কোচ, কর্তাদের চাটুকারিতা করেন তেমন নয়। ওঁরা চাটুকারিতা যথেষ্ট পছন্দ করেন এবং ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত নানা এজেন্ডা চরিতার্থ করতে এই সাংবাদিকদের ব্যবহার করে থাকেন। ফলে এই সাংবাদিকদের একেকজন প্রবল ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। নইলে একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারকে এমন হুমকি দেওয়ার ক্ষমতা হবে কী করে?
ঋদ্ধিমানের মত নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেটারের দল থেকে বাদ পড়লে মনখারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনার উত্তাপ কেটে গেলে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, এই বয়সে রিজার্ভ কিপার করে না রেখে তাঁকে সোজাসাপ্টা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দিয়ে দ্রাবিড় যথার্থ কাজই করেছেন। ২০ তারিখ ইডেনে ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের পর সাংবাদিক সম্মেলনে দ্রাবিড় পরিষ্কার বলেছেন, তিনি চাননি ঋদ্ধির মত একজন সংবাদমাধ্যম থেকে বাদ পড়ার খবরটা জানুন।৩ বরং সিনিয়র ক্রিকেটারকে আলাদা করে “তোমাকে আর নিতে পারছি না” বলার সৌজন্য ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে খুব কম টিম ম্যানেজমেন্ট এবং নির্বাচন কমিটি দেখিয়েছে। ঋদ্ধি অভিমান করে বলছেন “আমাকে ঘুরিয়ে অবসর নিতে বলা হয়েছে”। তাঁর অভিমানে যে সাংবাদিকদের মাঠের বাইরের মশলাই রান্নার একমাত্র উপকরণ, তারা ছাড়া আর কারো লাভ হচ্ছে না। ভারতীয় ক্রিকেটের দুর্ভাগ্য,সচিন তেন্ডুলকরকে গোটা দুয়েক রেকর্ড ভাঙার জন্য ২০১১ বিশ্বকাপের পরেও খেলতে দেওয়া হয়েছিল। আর মহেন্দ্র সিং ধোনিকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল তিনি প্রবল প্রতাপশালী ক্রিকেট কর্তার কোম্পানির লোক বলে। নইলে ৩৭-৩৮ বছর বয়সের লোকের জায়গা সর্বোচ্চ স্তরের ক্রিকেটে অবশিষ্ট নেই।
আইপিএল সর্বোচ্চ স্তরের ক্রিকেট নয়।
তথ্যসূত্র:
১। https://www.youtube.com/watch?v=TWo4DYl22rU
২। https://twitter.com/Wriddhipops/status/1495076230713917441?t=hqTKT22qFoRW80_xrnUnrw&s=03
৩। https://threadreaderapp.com/thread/1495463271419240451.html