প্রজননে সক্ষম হবে রোবট, অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন বিজ্ঞানীরা

অসম্ভব সম্ভব করে দেখালেন ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্ট, টাফটস ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। ২০২১ সালের শেষের দিকে গড়ে তুললেন বিশ্বের প্রথম প্রজননে সক্ষম রোবট, যাকে বলে 'জে়নোবট'।l

বংশধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে, জিনকে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রজনন আবশ্যক। বিভিন্ন জীবে প্রজননের ধরন বিভিন্ন। কোনও কোনও জীব ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনে যৌন জননের মাধ্যমে অপত্যের জন্ম দেয়। কোনও নিম্ন শ্রেণির এককোশী জীব আবার নিজেরাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দু'টি অপত্য কোশের জন্ম দেয়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে অযৌন জনন। আবার বেশ কিছু জীবের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গাছে, নিজের শরীরেই ওই জীবের অপত্য গজিয়ে ওঠে। যাকে বলে অঙ্গজ জনন।

কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবেছিলাম, রোবট প্রজননে সক্ষম হবে? তা-ও জীবিত রোবট, যা কি না ওপরে উল্লেখ করা সমস্ত প্রজননের ধরন থেকে আলাদা?

সেই অসম্ভবই সম্ভব করে দেখালেন ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্ট, টাফটস ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। ২০২১ সালের শেষের দিকে গড়ে তুললেন বিশ্বের প্রথম প্রজননে সক্ষম রোবট, যাকে বলে 'জে়নোবট'।

আরও পড়ুন: মৎস‍্যপ্রিয় বাঙালির দুঃস্বপ্ন! ভারতে হঠাৎ লক্ষ লক্ষ মাছের মৃত্যুর নেপথ্যে কারণ কী

তবে তার এক বছর আগেই, অর্থাৎ ২০২০ সালে চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহারের উদ্দ্যেশ্যে 'জে়নোবট' নামের এই জীবিত রোবটগুলিকে তাঁরা তৈরি করেছেন এক প্রজাতির ব্যাঙের ভ্রূণের কোশ থেকে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে, সেই জে়নোবটকে প্রজননক্ষম বানিয়ে তুললেন তাঁরা ২০২১ সালের শেষের দিকে। জে়নোপাস লেভিস এদের বিজ্ঞানসম্মত নাম, আর থেকেই নাম হয়েছে জে়নোবট।

তবে কথায় বলে বই কাঠ থেকে তৈরি হলেও, বই কখনওই নিজে গাছ হয়ে ওঠে না। ঠিক তেমনই, জীবন্ত কোশ দিয়ে তৈরি হলেও, এই কোশ-সমষ্টিকে প্রাণী কখনও বলা চলে না। জীবিত কোশ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং জৈবিক কার্য সম্পাদনে সক্ষম প্রাণীতে উত্তীর্ণ হতে গেলে পেরোতে হয় অনেকগুলি ধাপ।

আর সেই ধাপগুলি যেহেতু এই কোশ-সমষ্টিকে পেরোয়নি, তাই এই কোশের সমষ্টি আর জীবের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে এদের নির্মাণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে, রোবটই বলা হচ্ছে তাদের।

"জে়নোবট চিরাচরিত কোনও রোবটও নয়, আবার কোনও নতুন প্রজাতির প্রাণীও নয়। এটা নতুন ধরণের যন্ত্রাংশ: যা জীবিত, আবার যাকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণও করা যায়", দ্য ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্টের প্রেস রিলিজে় ভারমন্ট ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী এবং রোবটিকস-বিশেষজ্ঞ ড. জশুয়া বনগার্ড জানাচ্ছেন।

জে়নোবট ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজে ব্যবহৃত কাচের প্লেটে সাঁতার কাটে, আর তার চারপাশে ঘুরে বেড়ানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোশকে জড়ো করে নিজের মুখের ভেতর। জে়নোবটের মুখের সঙ্গে প্যাক-ম্যানের হুবহু মিল পাওয়া যায়। আর এই মুখের ভেতর শয়ে শয়ে কোশ জড়ো করার পর, সেই কোশগুলি নিজেরাই এক-একটা জে়নোবটে পরিণত হয়। আবার সেই জে়নোবটগুলি-ই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোশের সন্ধানে বেরিয়ে, তাদের জড়ো করে পরবর্তী প্রজন্মের জে়নোবটে পরিণত করে।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির উইজ় ইনস্টিটিউটের একটি প্রেস রিলিজে় ড. জশুয়া বনগার্ড জানাচ্ছেন, "যদি ঠিকমতো নকশা তৈরি করা যায় জে়নোবটের, তাহলে তারা নিজে থেকেই নিজেদের প্রতিলিপি বানাতে থাকবে।"

জে়নোবট বানাতে ব্যাঙের ভ্রূণের যে কোশগুলি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি আসলে বড় হয়ে ব্যাঙাচির শরীরের বাইরের ত্বকে রূপান্তরিত হত। "কিন্তু সেই কোশগুলিকে একদম নতুন ধরনের কাজে লাগাতে পেরেছি আমরা", ইউনিভার্সিটির উইজ় ইনস্টিটিউটের একটি প্রেস রিলিজে় জানাচ্ছেন টাফট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মাইকেল লেভিন। তিনি এই গবেষণার নেতৃত্বও দিয়েছেন। যেন ত্বক ছাড়াও, সেই কোশগুলির যে অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, তার সম্যক প্রমাণ এই জে়নোপড।

ড. লেভিন আরও জানাচ্ছেন, "এই কোশগুলির জিনের গঠন আর ব্যাঙের (জে়নোপস লেভিস) জিনের গঠন একই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই কোশগুলি ব্যাঙাচির ত্বকে পরিণত হয়নি। এই কোশগুলি সামগ্রিক বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে অবাক করা কিছু কাজ করছে।"

পূর্বের গবেষণাগুলিতে ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্ট, টাফটস ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জে়নোবটকে খুব সহজ কিছু কাজ করানোর জন্য ব্যবহার করেছিলেন। দেহের এক অংশ থেকে আরেক অংশে কোনও ওষুধকে পৌঁছে দেওয়া ছিল যার মধ্যে অন্যতম কাজ। দ্য ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্টের প্রেস রিলিজে় ড. জশুয়া বনগার্ড ২০২০ সালেই জানিয়েছিলেন, "এ যেন জীবন্ত এক যন্ত্র, যেমনটা আগে কখনও তৈরি হয়নি।"

কিন্তু তখনও তাঁদের কাছে অজানা ছিল, খোদ এই জীবন্ত যন্ত্রেও একদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে প্রজননক্ষম হয়ে উঠবে।

ড. বনগার্ডের ছাত্র ড. স্যাম ক্রিগম্যানের মতে, "এখানে ব্যাঙের কোশগুলি-ই নিজেদের প্রতিলিপি গড়ে তুলছে। কিন্তু সেই প্রতিলিপিকরণের ধরন ব্যাঙের দেহের নিজস্ব কোশের প্রতিলিপিকরণের থেকে একেবারেই আলাদা। এমনকী, কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদও এইভাবে নিজেদের প্রতিলিপি গড়ে তোলে না, বা প্রজননে অংশগ্রহণ করে না।"

এক-একটি জে়নোবট তৈরি হয় প্রায় তিন হাজারটি কোশ দিয়ে। আয়তনে এক মিলিমিটারের কাছাকাছি এক-একটি জে়নোবট। এই কোশগুলির সমষ্টিকে কী আকার দেওয়া যায়, সেই নিয়ে কম্পিউটার অ্যালগরিদমের সাহায্যে করা হয়েছিল বিস্তর নাড়াচাড়া। কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে এই জে়নোবটগুলির বিভিন্ন আকার দেওয়া যায়। কিন্তু কাচের পাত্রে সাঁতার কাটতে পারবে একনাগাড়ে, সেই গুণটি থাকতে গেলে কিছু নির্দিষ্ট আকার দিতে হবে জে়নোবটগুলিকে। শুধু তাই নয়, সাঁতার কাটতে কাটতে কোশ সংগ্রহ করে, নিজেদেরই প্রতিলিপি বানাতে হবে। এই গতিভিত্তিক প্রতিলিপিকরণকে বলা হচ্ছে 'কাইনেম্যাটিক রেপ্লিকেশন'।

সেই অসংখ্য আকার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে দেখা গেল, প্যাক-ম্যান আকৃতির জে়নোবটই সবচেয়ে ভালো পারবে কাইনেম্যাটিক রেপ্লিকেশনের পদ্ধতিকে সফল করতে। গবেষকদের মতে, কাইনেম্যাটিক রেপ্লিকেশন আণবিক স্তরে দেখা গেলেও, আগে কখনও কোশীয় স্তরে দেখা যায়নি। এই গবেষণাতেই প্রথম দেখা গেল হাজার-হাজার কোশের সমষ্টিও আদতে কাইনেম্যাটিক রেপ্লিকেশনে সক্ষম।

 

More Articles