পরিবেশ রক্ষার মার্কশিটে ডাহা ফেল, কেন এই অবস্থা ভারতের?

আমাদের দেশ পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এই বছর ডাহা ফেল করেছে, দেশবাসীর মুখ লজ্জায় নিমজ্জিত করে সবার নিচে স্থান পেয়েছে।

গত ২৫ বছরে কার্বন নিঃসরণ প্রায় অর্ধেকের বেশি কমিয়ে ফেলেছে সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমবে ৭০ শতাংশ এবং সম্পূর্ণভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে। রাজধানী আরও দ্রুত গতিতে এই কাজ করছে, আর তিন বছরের মধ্যে সে বিশ্বের প্রথম নেট জিরো রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বায়োমাস প্রযুক্তি এবং বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই অসামান্য সাফল্য আনতে পারছে সরকার। ২০১৯ সালে দেশের প্রায় ৪৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল বায়ুশক্তির দ্বারা। শুধু তাই নয়, বর্জ্য, বিশেষ করে প্লাস্টিকজাত বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিশ্বে সবচেয়ে ভালো কাজ করেছে সরকার। সরকার বায়ুদূষণ রোধেও উল্লেখযোগ্য ফলাফল পেয়েছে। বিশেষ করে সাইকেলের ব্যবহারকে তারা অনেক বেশি উৎসাহ দিয়েছে এবং তাতে অনেক ফল পেয়েছে। সেই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য বজায় রাখতে কড়া আইন প্রণয়নের সঙ্গে তার সঠিক প্রয়োগও করেছে এবং চূড়ান্ত সাফল্য এসেছে। সেই কারণেই ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের Environmental Performance Index বা EPI তে ৮২.৫ পেয়ে প্রথম হয়েছে সেই দেশ। বলা হচ্ছে ডেনমার্কের কথা, যার রাজধানী কোপেনহেগেন। আর ভারত?

ভারত এই গবেষণায় পেয়েছে ১৮.৯, যা সর্বনিম্ন।আমাদের দেশ পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এই বছর ডাহা ফেল করেছে, দেশবাসীর মুখ লজ্জায় নিমজ্জিত করে সবার নিচে স্থান পেয়েছে। কিন্তু তাতে কী? আমাদের দেশের সরকার অনেকদিন ধরেই অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করে বসে রয়েছেন। দেশহিতে কোনও কাজ করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু কোনও অভিযোগ উঠলে সোজা অস্বীকার করা- সে মানবাধিকার-সংক্রান্ত রিপোর্টই হোক, বা পরিবেশ-সংক্রান্ত।

পরিবেশ মানবজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি বিষয়, বা বলা যায়, মানবজাতির জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই বিষয়ে ডাহা ফেল করে সরকারের প্রতিক্রিয়া? ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অবৈজ্ঞানিক। সরকারের বক্তব্য, এই রিপোর্ট অসম্পূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে ভারতের কার্বন নিঃসরণ উন্নত দেশগুলির থেকে অনেক কম থেকেছে বরাবর। তাছাড়া এই রিপোর্টে যে ৪০টি বিভাগের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তার মধ্যে জঙ্গল এবং জলাভূমিকে ধরাই হয়নি বলে ভারত সরকারের দাবি। সেই সঙ্গে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বা নবায়ণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ভারতের নীতিকে খাটো করে দেখানো হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে, EPI 2022-তে পুরনো তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ই-জঞ্জালে ভরেছে কলকাতা, নরকে চোখ বুজে আছেন আপনি?

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় যদিও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যে তারা ঐতিহাসিক তথ্য নয়, বর্তমান নীতি নির্ধারণ এবং তার প্রয়োগের ওপরেই বেশি জোর দিয়েছে এবং তার ভিত্তিতেই মূল্যায়ন করেছে। তা সে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণই হোক বা বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রই হোক।

এ তো গেল গবেষণা এবং তার ভিত্তিতে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু যদি আমরা দেখি আমাদের সরকার সত্যিই কতটা পরিবেশবান্ধব, তাহলে কীরকম বাস্তবতা চোখের সামনে এসে দাঁড়াবে আমাদের? এখানে বলে রাখা খুব প্রয়োজন যে, সরকারি ঘোষণা এবং তার পরিণতি কিন্তু এক বিষয় নয়।

শুরুতেই উল্লেখ করা প্রয়োজন, দেশের পরিবেশ বাজেটের কথা। চলতি অর্থবর্ষে পরিবেশ মন্ত্রকের জন্যে বরাদ্দ অর্থ হল মাত্র ৩০৩০ কোটি টাকা। তার প্রায় সাত গুণ অর্থ বেশি খরচ করে তৈরি হচ্ছে দেশের নতুন সংসদ ভবন। যদিও সেই অর্থের পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কোথাও দাবি করা হয়েছে যে প্রকল্পের আনুমানিক খরচ হবে ১৩,৪৫০ কোটি টাকা। যদি তাও ধরা যায়, তাহলেও দশ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ হচ্ছে সংসদ ভবন এবং এসপিজি ভবন নির্মাণের জন্য। এখানেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত, সরকারের কাছে কোন বিষয়ের গুরুত্ব বেশি।

এরপরেই নজর দেওয়া প্রয়োজন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ এবং শহরগুলিতে বায়ু দূষণের ওপর। দেশের প্রায় ৩২টি শহর বিশ্বের সবথেকে বেশি দূষিত ৫০টি শহরের তালিকায় পড়ে। বাতাস এখানে এত দূষিত যে যাঁরা ধূমপান করেন না, তাঁদের ফুসফুসও ধুমপায়ীদের মতই ক্ষতিগ্রস্ত। এই দূষণ কমানোর জন্য এখনও কোনও সদর্থক নীতি চোখে পড়ছে না। দূষণ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে একবার ব্যাবহারযোগ্য প্লাস্টিক ২০২২ সালের মধ্যে তিনি নিষিদ্ধ করবেন। ২০২২ সালের ছয় মাস অতিক্রান্ত। ভারত সরকারেরই রিপোর্ট অনুসারে ভারত বছরে ৩৫ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে, যার অধিকাংশই গিয়ে জমা হচ্ছে জলাভূমিতে, বিশেষ করে সমুদ্রে। অবৈজ্ঞানিক?

কয়লা গোটা বিশ্বে একটি বহুলচর্চিত বিষয়। কয়লার উৎপাদন এবং ব্যবহার কমানোর দিকেই জোর দিচ্ছে গোটা বিশ্ব। একথা একটি শিশুও জানে যে, কয়লা থেকে কী পরিমাণ দূষণ হয়, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। ভারত সরকার এহেন কঠিন পরিস্থিতিতে আরও ৪০টি নতুন কয়লাখনির অনুমোদন দিয়েছে এবং সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, সেগুলি নিলামে উঠবে, কিনবে প্রাইভেট সংস্থারা। অবৈজ্ঞানিক?

কয়েকটি প্রকল্পের বিষয়ে এবার বলা যাক। যেমন কেন-বেতয়া নদী সংযোগকারী প্রকল্প। এই প্রকল্প বুন্দেলখণ্ডের খরা-কবলিত এলাকায় চাষিদের সুবিধা করবে বলে সরকারের দাবি। এই প্রকল্পের জন্য কাটা হতে চলেছে প্রায় ২৩ লক্ষ গাছ।

মধ্যপ্রদেশে একটি জঙ্গল আছে, যার নাম বক্সওয়াহা। সেখানের মাটির তলায় নাকি হিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রায় গোটা জঙ্গল কেটে খননের পরিকল্পনা রয়েছে, যার জন্যে বলি হতে পারে প্রায় ২ লক্ষ গাছ।

মুম্বইয়ের আরে জঙ্গল। শহর থেকে একটি দূরে অবস্থিত। ঘন জঙ্গল। সরকারের সেখানেই একটি মেট্রো শেড বানানোর প্রয়োজন পড়েছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সবই হয়েছে, কোনও লাভ হয়নি। জঙ্গল নিধন নিজের গতিতে চলেছে।

উত্তরাখণ্ডের চারধাম রাস্তা প্রকল্প। বারো হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাস্তা সংযোগ এবং সম্প্রসারণ হবে। পরিবেশবিদরা বারবার সতর্ক করছেন, ওই প্রক্রিয়ায় হিমালয়ে নির্মাণকাজ না চালাতে। শুধু পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, মাটি আলগা হবে ভয়ানকভাবে। আশঙ্কা বাড়বে ধসের। যে গাছগুলি পাহাড়ের মাটি-পাথরকে ধরে রাখে, তার নির্বিচারে নিধন চলছে।

আসামে একটি চা বাগানকে ধ্বংস করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে, বিমানবন্দরের কাজে। ৩০ লক্ষ চা গাছ এবং বাগানে থাকা ছায়া-প্রদানকারী হাজার হাজার গাছ কাটা হয়েছে সেই কাজে। প্রায় ১৯০০ মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন, এবং পরিবেশের ক্ষতি? অতুলনীয়। সেই সঙ্গে বলা দরকার, প্রতি বছর আসামে ভয়ংকর বন্যা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশের নিধন সেই বন্যার তীব্রতা বাড়িয়ে তুলছে এবং সরকারের তরফ থেকে কোনও পদক্ষেপ নেই।

অবৈজ্ঞানিক?

শহরাঞ্চল বা মফসসলের জলাভূমিগুলো অপরিকল্পিত নগরায়নের গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে চলছে নির্বিচারে গাছ কাটা। শিল্পাঞ্চলগুলিতে সংস্থাগুলি নিজেদের মর্জিমতো নদী, পুকুরের দূষণ ঘটাচ্ছে, আইন আছে নামমাত্র। তাদের কোনও শাস্তিই হচ্ছে না। নিশ্চিন্তে তারা নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

গ্রামগুলিতে অবস্থা আরও শোচনীয়। নজরদারির কোনও জায়গাই নেই সেখানে। কৃষি আমাদের অর্থনীতির এক বড় অংশ, কিন্তু সেই কৃষিকাজকে পরিবেশবান্ধব করার কোনও প্রকার চিন্তাভাবনা সরকারের নেই।

আরও অনেক বিষয়, অনেক প্রকল্প আছে, যার উল্লেখ এই লেখায় সম্ভব হলো না। শুধু এই কথা বলা যায়, সরকার এই গবেষণার ফলাফল এত সহজে উড়িয়ে দিলেও, নাগরিক হিসেবে সাধারণ মানুষের সজাগ থাকা খুব প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা সরকারের ফোকাস সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে, যাতে আমাদের মানবজাতির কোনও উন্নতি না হলেও ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন ঘটবে। এই ব্যবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। নাহলে বিপদ আসন্ন।

More Articles