কোনও কথাই নতুন নয়, এই কথাটাই বুঝেছি

Year End 2023 : প্রতি বছরই মনে হয় মাথার উপর একটা তাক খালি হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ আমরা একা হয়ে যাচ্ছি, ফাঁকা হয়ে যাচ্ছি।

বাহাত্তর চ্যানেলের আগে, মানে প্যালিওলিথিক যুগে, মানে আশির দশকে আমার ছাত্রজীবনে একটি টিভি-চ্যানেল নতুন উঠেছিল। নাম তার ডিডি থ্রি। সেখানে মাঝে মাঝেই নাসিরউদ্দিন-স্মিতা পাটিল জাতীয় আর্ট ছবি দেখান হত। আর ন্যাশনাল চ্যানেলে এক নব্য টিভি-অনুষ্ঠান আমাদের প্রাণ ছিল। আমাদের তখন ডিডি ওয়ান, ডিডি টু আর নতুন ওই থ্রি, এই তিনটিই মাত্র চ্যানেল। তা সেই শুক্রবার সন্ধের নতুন শো-এর নাম 'দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক'। প্রণয় রায় নামে এক উঠতি যুবা আমাদর মেধা ও হৃদয় শাসন করছেন তখন। টেলিভিশন বিষয়টি তখনও নতুন। ওই আর কি ধরণী যখন তরুণী ছিল স্টাইলে।

যে কথা বলতে এত বেশি গৌরচন্দ্রিকা, তা হল, বৎসরান্তে ওই ন্যাশনাল চ্যানেলে প্রণয় রায়ই শুরু করেন এক অনুষ্ঠান। ৩১ ডিসেম্বর রাতে সেইটি দেখবার জন্য আমাদের প্রাণ আকুলি-বিকুলি করতে শুরু করল প্রায় প্রতি বছরই। অসাধারণ সেই 'দ্য ওয়ার্ল্ড দিস ইয়ার'। এক বছরে কী কী ঘটে গেছে তার খতিয়ান। দেখতে দেখতে আমরা বলতে থাকতাম, ওই দেখ, জানুয়ারিতে যে সেই দাঙ্গাটা ঘটেছিল, ভুলেই তো গিয়েছিলাম! আর এবছর কি শিল্প জগতের সমস্ত রথী-মহারথীকেই যেতে হল? অহো! ওই সিনেমাটা অসাধারণ হয়েছিল! আরিব্বাস জুহি চাওলার এই লুকটাই ট্রেন্ডিং ফ্যাশন ছিল নাকি? এইসব আর কি! গোটা একটা বছরের সারা পৃথিবীর যুব-আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক ক্যু থেকে সামাজিক ক্যু, সবই দেখা হত এক লপ্তে।

আজ অসংখ্য চ্যানেলের অসংখ্য বার্তা, প্রতিটি খবরের কাগজের পাতাজোড়া ওই ধরনের ক্লিপিং, সেই একটি চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানের মজাটাকেই নষ্ট করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন:তিরচিহ্ন: যশোধরা রায়চৌধুরী

সত্যি করে ভেবে দেখলে যত বয়স বাড়ছে তত বুঝতে পারছি─আসলেই কি কিছু এসে যায়? পয়লা জানয়ুারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর─ব্র্যাকেটের মধ্যে বেঁধে রাখা এক একটা বছর শুধু একটা তারিখ বা সংখ্যার চেয়ে বেশি কোনও অর্থ কি রাখে আদৌ? প্রতি বছরই মনে হয় মাথার উপর একটা তাক খালি হয়ে যাচ্ছে। বয়স্ক মানুষেরা চলে যাচ্ছেন। ক্রমশ আমরা একা হয়ে যাচ্ছি, ফাঁকা হয়ে যাচ্ছি । কিন্তু এও তো নিয়তি-নির্দিষ্ট এবং অমোঘ। নতুন কিছু নয়, শুধুই পুনরাবৃত্তি। দেখতে দেখতে বছরগুলো হু হু করে বেরিয়ে যায়, খুব জোরে টান দেওয়া ফিল্মের ছবির মতো দ্রুত। ছবিগুলো অস্পষ্ট। ছোটবেলায় যেমন ছিল, জন্মদিন পালন। বড়বেলায় এসে বছরের জন্মদিন পালন। আমাদের ছোটবেলার নিশানা দেওয়া দেওয়া খোপগুলো তৈরি করেছে কে? জন্মদিনগুলোই তো?

একের পর এক জন্মদিন, কিম্বা নিউইয়ার, এক এক ধরনের ঔপনিবেশিক খেয়াল অথবা 'চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি' বলে কোনও জাতীয়তাবাদী তেড়ে-ফুঁড়ে উঠতে পারেন এখন! রাস্তায় মাইলফলকের মতো, মানুষের সভ্যতার তৈরি কৃত্রিম ক্যালেন্ডারের মতো, মাইল-কিলোমিটার-মিটার-লিটার-গ্যালনের মতো, বছর-মাস-সপ্তাহের হিসেবের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্মৃতিকেও মাপে মাপে কেটে বসানোর চেষ্টা আসলে কত যে ভুল! কোনও স্মৃতি জ্বলজ্বল করতে থাকে, যেন এই সেদিন, কোনও স্মৃতি থাকেই না, অথবা ভাবলে মনে হয়, যেন বড্ড বেশি দূর। এই তো সেদিন আমার বাড়িতে এসেছিল দু-তিনটি কিশোর। সন্দেশ পত্রিকার 'পত্রবন্ধু চাই' বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে চিঠি লেখা পত্রবন্ধু থেকে প্রথম 'ছেলেবন্ধু’-তে, যাকে বলে দেঁড়েকশে, ‘উত্তীর্ণ’ হয়েছিল। একজন এখন টিভি পার্সোনালিটি, একজন ফিল্ম-বিশেষজ্ঞ। তো, সেই বন্ধুদের পাঠানো চিঠি, রঙিন লেফাফা, আমার ছাপছোপ মারা চিঠি লেখার কাগজগুলো, একেবারে তামাদি এখন। একদা আমাদের কত না সৃষ্টিশীলতা চুঁইয়ে দিয়েছি নিজেরা গ্রিটিং কার্ড তৈরিতে, কাগজ কেটে আঠা দিয়ে লাগিয়ে। সব তো মনে হচ্ছে এই সেদিন ঘটেছে। অথচ মাধ্যমটা, এই কাগুজে চিঠি, হাতে পাঠানো চিরকুট, গোলাপি কাগজে লাল অক্ষরে লেখা পেরেমপত্তর, নববর্ষের 'প্রণাম লইও' সহ হলুদ পঁচিশ পয়সার পোস্টকার্ড, আর জন্মদিনে বন্ধুকে পাঠানো হাতে তৈরি নববর্ষের গ্রিটিং কার্ড, সব শুদ্ধু এই মাধ্যমটাই শেষ, অবলুপ্ত, এক্সটিংক্ট। ডোডোপাখির মতো।

আরও পড়ুন: দূরে থাকা মানে বিচ্ছিন্ন থাকা নয়, শঙ্খ ঘোষের চিঠিতে স্মৃতির ঘর

যেভাবে সেই রথের মেলায় হাতের ওপর লাগানোর জলছবিগুলো অথবা বইটইতে লাগানোর প্লাস্টিকের স্টিকার এখনও পুরনো বইয়ের আলমারিতে দু-একটা লাগানো আছে। বইয়ের ভাঁজে রাখা সুতো দিয়ে বানানো রাখী, টুথব্রাশ নিয়ে বসে বসে প্রায়শই পালিশ করতাম যেগুলো। রথের দিন, রাখীর দিন ফেসবুকে গোছা গোছা ছবি আর দিবসের শুভেচ্ছা পোস্ট করার চাইতে এই দিবস-পালনগুলো অনেক বেশি ঘেঁষাঘেঁষির, ওমের, উষ্ণতার বলে, ওগুলোও এক একটা নতুন করে জন্মদিন-বড়দিন-নিউইয়ার ডে ছিল যেন, ছোটবেলা থেকে বড়বেলায় এগোনোর।

এখনো কত কাছের হয়ে আছে সেই সব মুহূর্ত, যেগুলোতে লেগে থাকে শিশিরের মতো উজ্জ্বল সব ভালবাসা, হাসি আর আনন্দের ফোঁটা। আর কত দূরে চলে গেছে ভুলভাল সম্পর্ক, হেরে যাওয়া, ঠকে যাওয়া, বিশ্রি লাগার অনুভূতিরা। সময় ও স্মৃতির এই বিশ্বাসঘাতকতা, ভালগুলো মনে রাখা আর খারাপগুলো ভুলে যাওয়ার অবধারিত বিশ্বাসঘাতকতা, আমাকে তীব্রভাবে মনে করায়, সময় কত ইলাস্টিক। স্মৃতি আসলে চ্যুইংগাম। টেনে লম্বা হয়ে গায়ে লেপ্টে থাকে, কিছুতেই ফুরোয় না। চ্যুইংগাম বলতেই মনে হল কী যেন একটা নতুন কথা বল্লুম। কলার উঁচু করার আগেই আবার মনে হল, ওটাও তো রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন কোনও না কোনও গানে, অথবা কোনও না কোনও কবি কোনও কবিতায়, অথবা সালভাদর দালির গলে যাওয়া ঘড়ির ছবিটাও মাথায় এসে যেতে পারে কারও, আর অমনি আমার বলাটা হয়ে যাবে টুকলি।

আমার কথাটা যে আদৌ নতুন নয়, কোনও কথাই যে আদৌ নতুন নয়, সব কথাই আসলে আগের কারও না কারও কোনও না কোনও ভাবা-কথা-ছবির কপি─এটাই সত্যি। হুশ করে কেটে যাওয়া কুড়ি-পঁচিশ-তিরিশ-পঞ্চাশ বছর ঠেঙিয়ে এসে এটুকুই জেনেছি।

 

More Articles