ব্যান্ডেজ জড়িয়ে একটা সময় আবার ঘুমোতে গেল
Year Ender 2023 : তেমন কিছু কি ঘটেছিল এই বছর? হয়তো ১০০ বছর আগে ঘটেছিল। নজরুল ইসলাম 'বিদ্রোহী' কবিতাটি লিখেছিলেন।
বর্ষাশেষে নবীন চাঁদের মতো স্তনের দিকে তাকিয়ে বাঙালি কবি একদা পয়ার লিখতেন। সেই চাঁদে একটি যন্ত্রযান অবতরণ করার পর আমাদের মনে হয়, আমাদের আর পাঁচিল রইল না। আমরা মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহাকালমাঝে খবরের কাগজ ও সংসদভবন প্রতিষ্টা করতে পারব। তারপর যথারীতি 'অটাম ফেস্টিভাল’, বাঙালির বর্ষশেষ এগিয়ে আসতে থাকে। আমরা ২০২৩ পার হয়ে এলাম। ১৯৮৪ নয়। আসলে খ্রিস্টের মৃত্যুর পর কল্কি এসে দাঁড়াবার পরে এতবার এত বছর ঘুরে গেছে যে আজ গতকাল যদি আগামিকালের মতো হয়, তবে তেমন করে বলার কিছুই থাকে না। এই বছরের দিকে তাকালে আমার মনে হয় যে, ব্যান্ডেজ জড়িয়ে একটা সময় আবার ঘুমোতে গেল। ইতিমধ্যেই ক্রিকেটের ফাইনালে ভারত পরাজিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। আর গাজাতে আমরা চোখ হারিয়েছি। আসলে আমরা কী হারিয়েছি বা কী পেয়েছি তা বলার বিশেষ পরিসর নেই। আকাশ থেকে কুসুম বৃষ্টির মতো মৃত শিশুদের জন্য টফি নেমে আসছে। আগুনের সেই রাংতা দেখা আর বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে আকাশছোঁয়া ক্যাচ মিস করার মধ্যে পার্থক্য আমাদের জীবনে বিশেষ কিছু আর নেই। শুধু মাঝে মাঝে পার্টি, বিবৃতি ও রক্তদানের মধ্যে নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হয়, একদা আমরাও হয়তো লিখতে চেয়েছিলাম। গান বা নাটক। ছবির দিকে তাকানোর অধিকার আমাদেরও বোধহয় ছিল। এখন হাড়কাটা গলির মতো এই শহরে হাঁটতে গেলে দেখি, বেশ্যার প্রেম বলাবাহুল্য, পসরা। যদিও, আমরা যারা তাঁর কাস্টমার তাদের লজ্জা তা নয়, আমরা একটা গুহায় লুকিয়ে পড়তে চাইছি বছর জুড়ে, আপাতভাবে তা যোনি হতে পারে, খ্যাতি হতে পারে, কিন্তু সবচেয়ে স্পষ্ট কথা স্পষ্টভাবেই বলা ভালো। আমাদের পাপ কারেন্সি নোটের মধ্যে ছাপা আছে।
আরও পড়ুন- রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়া যিশুর যন্ত্রণাকে এঁকেছিলেন নন্দলাল, যামিনীরা
তেমন কিছু কি ঘটেছিল এই বছর? হয়তো ১০০ বছর আগে ঘটেছিল। নজরুল ইসলাম 'বিদ্রোহী' কবিতাটি লিখেছিলেন। এখন ধর্ম ও নাস্তিকতা করমর্দন করে ওই কবিতার স্মরণে সেমিনার থেকে সেমিনারে। আমার আর মনেও পড়ে না, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা' যে বছর প্রকাশিত হয় কলকাতায়, সেবছরই লন্ডনে আলডাস হাক্সলের 'আইলেস ইন গাজা' উপন্যাসটিও ছাপা হয়। দৈবাৎ, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মুখপুস্তকে গাজার অন্ধত্ব মনে রাখেননি। আমরা কিছুই মনে রাখিনি। যা আমাদের দেখার কথা ছিল না তা আমরা দেখে ফেলেছি এবং অন্ধ হয়ে গেছি ইদিপাসের মতো। একথা আর আমাদের আইপ্যাডে মুদ্রিত নেই। আমাদের স্মৃতি নেই, আমাদের ভবিষ্যতও নেই। আমাদের একজন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি একটি অদ্ভুত অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন যেখানে প্রতিটি চলমান মুহূর্তই স্থির ও বাস্তব কিন্তু মুহূর্তগুলি বিচ্ছিন্ন। ফলে তিনি জীবন্মৃতেরও অধিক এক দশক কাটালেন। আমরা প্রতি বছরই যা কাটাই তাতে সাংবাদিক, মন্ত্রিসভা, বেশ্যা প্রণয়িনী, সকলেই কোলাহল করে। আমাদের কবিতা ও যশ, আমাদের পুরস্কার ও তিরস্কার সবই রাস্তায় ঠোঙা হয়ে উড়ে বেড়ায়। আজ এই তাপদগ্ধ বর্ষা ও বসন্তহীন শহরে কোনও লাভ নেই বলে যে, আমার যেদিন গেছে কেটে চোখের জলে! আমাদের চোখের সামনে সর্বনাশ সমুৎপন্ন, তা মধ্যপ্রদেশে অথবা মধ্যপ্রাচ্যে জেনে পরিত্রাণ নেই অথচ আমরা স্থাণুবৎ, প্রলয়ের অপেক্ষায় আছি। বোধশূন্য মানুষ, অসাড় মানুষ আবার কবে শব্দের থেকে চুম্বন খুঁজে পাবে, কবরের থেকে পুনরুত্থিত হবে তা আমি জানি না। কিন্তু যুদ্ধ আর ক্রিকেট আমাদের দরজায় কড়া নেড়ে গেল। আমরা গহন ঘুমের ঘোরে তা টের পেলাম না। এটুকুই আমার ২০২৩।
আরও পড়ুন- এই কেফিয়ের একটি সুতোও যেন গাজার না হয়…
প্রত্যেকেই এক একভাবে শহরে এসেছিল। অপূর্ব কুমার রায় বা ডাক্তার শশী দাস। তারা যথাকালে ফিরে গেছে। আমাদের জন্য যা আছে তা উচ্ছিষ্ট প্রাদেশিকতা। একদা রামমোহন রায় খোঁড়া পায়ে ব্রিস্টল বন্দরে উপনীত একটি ফরাসি জাহাজকে অভিবাদন জানাতে গিয়েছিলেন সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্মারক বলেই। তাঁর উত্তরসূরিরা ওটিটি সিরিজ দেখে ও পরকীয়া বিষয়ে স্নাতকোত্তর গবেষণা করে। কলকাতা থেকে যে ট্রাম উঠে যাচ্ছে সেই লাইনে জীবনানন্দ দাশের রক্তের দাগ নিয়ে আর বাঙালি চিন্তিত নয়, তার যাবতীয় গবেষণা নিযুক্ত হয়েছে শোভনা নাম্নী এক রমণীর প্রতি। এই পারিবারিক কেচ্ছায় একদিন প্রতিদিন তার রোমে রোমে হর্ষ উৎপাদিত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি মূলত ভ্রাতৃজায়ার সঙ্গে রমণের জন্য, একথা বাঙালি বুঝে গেছে। আর বাঙালি এও বোঝে যে তার পক্ষে ইউটিউবে খাবার রেসিপি ও কিছু মুচমুচে রসিকতা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে জানে সে রামকিঙ্কর নয়, তাই তাকে মিম বানাতে হয়। এই যে সীমানা জানা বাঙালি, যার চতুর্থ সীমানা নেই সে তো আমিও। যে জিজ্ঞাসাচিহ্নে ধুলো পড়ে যাচ্ছে সেই ধুলোতে আমিও চাপা পড়ে আছি। আজ আর কেউ পত্রালাপ করে না অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে। যেসব ইমেল যায় ও আসে তাতে ভোরের আলোয় সত্যের মুখ আর দেখা যায় না। সমস্ত জীবনকে এক খঞ্জ বাসাবাড়ি মনে হয় যেখানে একদা অনেক ফুল্লকুসুম ও দীপমালা ছিল। আজ যার মুখে সুরভিত কঙ্কালের হাসি। এই অন্ত্যেষ্টি আর সম্ভোগ যখন এক হয়ে গেছে, ঈশ্বর পরিত্যক্ত এই জনপদে যখন কিছুই অননুমোদিত নয় তখন অবিরত ব্যোমকেশ, কিরিটি রায় ও ফেলুদার প্রজনন ছাড়া আমাদের কীই বা করণীয় আছে? আমাদের ঈশ্বর নেই, মার্ক্স নেই, ভোটাধিকার আছে। আমরা চলমান অশরীরী। তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে মৃত্যু থেকে আরও গভীরতর মৃত্যুর দিকে চলে যাব।