আশ্চর্য রঙের মানুষের কলোনি
Year Ender 2023 : এই হিম-সকালেও আশপাশের গাছ ও অন্যান্য জায়গা থেকে এক-দেড়শো পায়রা উড়ে উড়ে আসছে, ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে দানা। যেন বিকাশ ভট্টাচার্যের ছবি!
বছর শেষে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি গোটা বছরে দু-তিনটে ভুল সম্পর্ক, এক দেড়খানা মতো বন্ধুবিচ্ছেদ, মৃত্যুশোক, নানারকমের দৈন্য অনেক সময়েই মনকে ঘিরে রেখেছিল কিন্তু সেটাই সব নয়। পাকে পাকে যেমন লতা গাছকে জড়িয়ে ধরে, এখন উল্টো পাকে সেই বন্ধন খুলে দেখে নেওয়া আলোছায়ার ঢেউ, বাতাসের স্পষ্ট শ্বাস। এর ভিতরেও উঁকি দিয়ে গেছে আতপচাল ধোয়া জলরঙের আলপনা। এই আলোর স্বরূপ জীবনে কীভাবে আসে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি।
এক একদিন তো এমন হয় যে, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখা যায় কোনও একটি গান মনকে অধিকার করে রেখেছে। গত তিন চারদিন রবীন্দ্রনাথের "কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি" গানটি আমাকে দু'হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। বিশেষত,
"মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার, তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার--
সুর তবু লেগেছিল বারে-বার মনে পড়ে তাই আজি॥"
কবীর সুমনের গাওয়া এই অংশটির ঘোর, অস্ফূট বেদনা থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছি না।
এই পুরনো বছর অনেক কিছুর সঙ্গে স্বয়ং আশ্চর্যকে দান করেছে অনেকবার। আর তাতেই তো বেঁচে থাকার সার্থকতা। চারটি ছোট ছোট ঘটনার কথা বলি, চারটি ঘটনাই ঘটেছে শীতকালে, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস মিলিয়ে। সামান্য আয়ুতে এইসব হলো অপরূপ লিপিচিত্রমালা।
প্রথম ঘটনা ঘটে নভেম্বরে। বাড়ি থেকে বেশ খানিক দূরে বন্ধুর বিয়েতে নেমতন্ন পেয়ে সন্ধেবেলার বাসে চেপেছি। হাইরোডের দু'পাশে আদিগন্ত খোলা মাঠ। জনমনিষ্যি নেই। বাস চলেছে। পাকুড়গাছের নীচে বাসস্টপে বাস থেমেছিল চা-পানি খাওয়ার জন্য। আবার চলছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম, তিন চারজন মানুষ খেজুর গাছের ছায়ায় ঢাকা ছোট এক বাগানে বসে শবদেহ কবরস্থ করবে বলে আয়োজন করছে। জনা কয়েক লোক ওখানে বসে আছে। সামান্য দূরে আরও কয়েকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। আকাশে তেরছা চাঁদের আলো ভারবাহী উটের মতো শ্রান্ত। চোখে লেগে রইল অমন শান্ত স্তব্ধ শোকের ছবি। বাস চলছে।
গ্রামে পৌঁছলাম। নভেম্বরের বলীয়ান ঠান্ডায় কুয়াশা ঝুলছে দশদিকে। যে বাড়িতে নেমতন্ন সেখানে এখনও পথেঘাটে ইলেকট্রিক আলো আসেনি। কিছু কিছু মাটির দোতালা বাড়ি চোখে পড়ে। ফলন্ত শস্যের খেত।
বিয়েতে বরযাত্রী বা কনেযাত্রী এলে টিফিনে বাক্সে বাজারজাত, দোকানে তৈরি খাবার নয়, বাড়িতে বানানো মিষ্টি, কাটা ফল, সরবত দেওয়া হয়। ভোজের আয়োজনে আলুপোস্ত, খাঁটি ছানার তৈরি মাঝারি সাইজের সুন্দর রসগোল্লা চোখে পড়ে। রাত্রি ন'টা সাড়ে ন'টার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যায়।
বন্ধুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে, খাওয়াদাওয়া শেষে মাথায় মাফলার বেঁধে, সোয়েটার পরে হাঁটতে বেরিয়েছি ওই গ্রামের এক ভাইয়ের সঙ্গে। খেয়াল করি গ্রামে ঢোকার মুখেই বিরাট বড় এক দিঘি, আসার সময় অন্ধকারে খেয়াল করিনি। দিঘির পাড়ে শান বাঁধানো ঘাট। ছায়া করে আছে জায়গাটা বিশাল এক বটগাছ। চাঁদের অল্প অল্প আলোতে চারিদিকে আলোআঁধারির জাফরি ঘনিয়ে আছে। মুখোমুখি বসে আছি দু'জনে।
আমি ওকে শুধালাম, ইতিউতি ফুল পড়ে আছে, গাছের নীচে পুজো-আচ্চা হয় নাকি?
ও বলল - না, তবে শ্মশানবন্ধুরা এই গাছকেই কোল দেয়।
মনে পড়ল, বোলপুর থেকে ফেরার পথে এমন এক দৃশ্য দেখেছিলাম একবার। সাদা থান পরা কিছু লোক শ্মশান থেকে ফেরার পথে বড় বটগাছকে জড়িয়ে ধরে থাকছে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। এখন বুঝতে পারলাম কারণ।
এদিককার গ্রামে যখন কোনও মানুষ মারা যায়, দাহ করে ফিরতি পথে সরাসরি তারা বাড়িতে ঢুকতে পারে না। কিছুক্ষণ গাছকে জড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে। জীবিত মানুষের প্রচণ্ড শোক ও দাহ গাছ গ্রহণ করে। তার জন্যই বোধহয় বটের ছায়া এমন শীতল। তারা ফোটা আকাশের নীচে ঝুরি নামা, আদিম এক দুঃখহরণ গাছের খোঁজ পেয়ে চমক লেগেছিল। সেই সন্ধে স্পষ্ট দাগ রেখে গেছে।
আরও পড়ুন- ইউনিট টেস্ট আর শুকতারা! পাড়াগাঁয়ের টিউশনই ছিল না-জানা গল্পের ক্লাস
দ্বিতীয় ঘটনা, প্রথম ডিসেম্বরের সপ্তাহখানেকর মধ্যে। বাজারে গেছি সকালবেলা, দেখতে পেলাম সামনে বসে আনাজ বিক্রি করা মানুষটি বলছে - আমার মতো সরল মানুষ কেউ নেই গো এই বাজারে, আমার কাছে এসো। বলতে বলতে হাসছে।
কাঁচা আনাজের পাশাপাশি বকফুল, বাদামভাজা, পেয়ারা, কামরাঙা, হাঁসের ডিম এসবও রেখেছে। সবসময় কথা বলছে তুক মিশিয়ে, আনন্দ করে।
একজন খদ্দের কাঁচা পেঁপে কিনতে কিনতে বলল, বাজারের এ ধারটাতে এত ঠান্ডা পড়েছে কেন কে জানে বাপু!
হেসে সে বলে - আকাশ থেকে এখানে বড়লোকদের ফ্রিজ ভেঙে পড়েছে তাই।
একথা বলেই বলছে, জ্যান্ত পেয়ারা নিয়ে যাও খলবল করছে, আর এই বাদাম পদ্মাপাড়ের বালিতে ভাজা, হেব্বি খেতে।
এই লোকটি একদিন আমার এক বন্ধুকে বেশ খানিকটা আলু এমনিই দিয়ে বলেছিল বাড়িতে মাংস দিয়ে জুত করে রেঁধো, আর আমাকে একটু দিয়ে যেও কিন্তু মনে করে, চাখব। পুরোটাই মজা করে বলা।
বন্ধু বলল - আমি গঙ্গার ধার থেকে এতদূর আসব মাংস দিতে? তুমি যেও একদিন। আর পয়সা নাও সবজির।
লোকটি বলে - পয়সা দিও না, তুমি বরং মাংস রান্নার পর একপিস মাংস আমার নাম করে কোনও প্রাণীকে খাইয়ে দিও, তাহলেই আমার খাওয়া হবে।
আমার জানাশোনার মধ্যে এমন একজন মানুষ বসবাস করে, যার এমন এক মন আছে, একথা জেনে শীতকালকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম।
তৃতীয় কথকতা প্রথম শীতের সন্ধেবেলাতেই হয়েছিল। শীতকালে এখন পাড়া গ্রামে সার্কাস, ম্যাজিক, জাদুখেলার চল কমে গেছে। কিন্তু অন্তরীক্ষে নিয়ত জাদু হয়ে চলেছে। চলেও সবসময়। চাঁড়ুল গ্রামের নদীতীর থেকে ফিরছি। একা নই, দু'জন বন্ধু আছে। অকারণের সাইকেলে ভ্রমণ। ফিরতি পথে আমার বন্ধু দর্জির কাছে জামা সেলাই করতে দিল, শবরী সিনেমাহলের কাছে দোকান।
হানিফ চাচার দোকান। চলাতে সামান্য অসুবিধা, রোগা চেহারা, চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। একমনে সারাদিনমান থেকে সন্ধে-রাত অবধি সেলাই মেশিনের সামনে কাজ করে। এখন ওঁর স্ত্রী বসে আছেন। ক্ষয়াটে মলিন চোহারা। আলোর সামনে বই পড়ছেন। কাপড়ে মাথা ঢাকা। জ্বলজ্বলে চোখের চাচা নেই এখন। চাচা না থাকলে চাচিই দোকান সামলান, টুকটুক করে সেলাই ফোঁড়াই করেন। আর বই পড়েন। এই ছোট্ট দোকানঘর থেকে বই পড়ে চাচি উড়াল দেয়। শিকড়ের ডানা হয়।
দোকানঘরে জামাকাপড়ের স্তুপের কাছে দেখি, খবরের কাগজের বিশেষ কিছু পাতা কেটে রাখা। দুটো পুজোসংখ্যা। কথা বলে জানা গেল, নিয়মিত পড়েন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। যখনই সুযোগ পান বই পড়েন। গত পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'কবীরের প্রেম পেয়ালা' উপন্যাসটি বার চারেক পড়েছেন। আলো বেড়ে গেল সন্ধেবেলার। এমন কথাবার্তা শুনলে বুকের ভিতরটা কেমন ভরে যায়।
মনে পড়ল, পড়েছিলাম, কবীরের মৃত্যুর পর সে হিন্দু না মুসলিম ধর্মের প্রশ্ন উঠেছিল। মরদেহের কোন মতে শেষকৃত্য হবে এ বিষয়ে দ্বন্দ্ব। তখন কবীরের দেহ ফুলে বদলে গেছিল। এই শান্ত মুখের কাপড় সেলাই করা চাচির সামনে দাঁড়িয়ে ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সন্ধেটা বদলে গিয়েছিল। নীল দিগন্তে কতরকম ম্যাজিক যে ঘটে।
আরও পড়ুন- গোপন ভিডিও থেকে অসভ্য অসভ্য খেলা! পাড়াগাঁয়ের যৌনতার ক্লাসরুম কেমন ছিল
চতুর্থ ঘটনা ঘটল ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কলকাতা যাব বলে ভোরবেলা উঠেছি। জমাকাপড়, মুড়িজল গুছিয়ে তৈরি। ভালো করে মানুষজন জাগেনি। সাইকেলে স্টেশনে এসে টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে আছি।
ওভারব্রিজের কাছে একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা ফতুয়া গায়ে, কাপড় লুঙির মতো করে পরা, মোটা ধূসর রঙের চাদর জড়ানো। এসবই দেখতে পেলাম কাছে এগিয়ে এসে। নীল কুয়াশার মধ্যে এই অবয়ব।
বৃদ্ধ মানুষটি হাতের ঝোলা থেকে গমদানা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছেন স্টেশনের পাথরের মেঝেতে। এই হিম-সকালেও আশপাশের গাছ ও অন্যান্য জায়গা থেকে এক-দেড়শো পায়রা উড়ে উড়ে আসছে, ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে দানা। যেন বিকাশ ভট্টাচার্যের ছবি!
সকালবেলা এমন একটি দৃশ্য দেখলে স্বভাবতই মন ভালো হয়ে যায়, আলো হয়ে যায়। এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই শুনতে পেলাম গুঞ্জন। বৃদ্ধ বিড়বিড় করে করে কিছু বলছেন। কাছ গিয়ে শুনি, বলছেন - আমি কিন্তু চোখে দেখতে পাই না, আমাকে কেউ ধাক্কা মারবেন না, সাবধানে হাঁটবেন ওরা কিন্তু খাচ্ছে, আয় আয় আয়...
এই কথা বারবার ঘুরেফিরে বলছেন। তারপর দানা একসময় ফুরোল। অন্য একজন লোক এসে অন্ধ মানুষটিকে ধরে ধরে নিয়ে গেল। জানতে পারলাম, এই মানুষকে প্রতিদিন একজনকে ধরে ধরে স্টেশনে দিয়ে যায়। আর দৃষ্টি লেপেপুছে যাওয়া এই মানুষ, সন্তান সন্ততির মতো পায়রাদের দানা খাওয়ান। আকাশে দেখলাম কল্যাণ রঙের আলো উঠেছে।
এরাই আমার সারা বছরের অর্জন। এইসব মানুষের কথা ভাবলে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে, দু' গ্রাস ভাত বেশি খেয়ে একটি বিড়ি ধরাতে সাধ হয়।
আজ যখন এই লেখা লিখছি দেখছি, লেখায় এরা স্থান বদল করছে। দুঃখহরণ গাছে অন্ধ মানুষের হাতে দানা পায়রাদল এসে বসতি করছে। ঠিক পাশের গ্রামেই থাকতে আসছে আনাজ বিক্রি করা লোক, বই পড়া চাচি।
এত শুষ্ককঠিন, রসহীন মানুষের ভিড়ে গড়ে উঠছে আশ্চর্য রঙের মানুষের কলোনি। লেখাই এসব করতে পারে। অনেক ক্ষয়ের ভিতরে লেখাই তাই আলো, লেখাই আনন্দ।
নতুন বছরের শুরুতে যে লেখা, যে গান আমাকে বাঁচিয়েছে তাকে নমস্কার। এই শীতেই বাংলা ভষার নামে কয়েকটি ফুলগাছ লাগাব বলে ঠিক করেছি।