মাথা নাড়ানো মানেই সম্মতি! কোথা থেকে বাংলায় এল 'হ্যাঁ' শব্দটি?
Origin of Yes Word in Bengali: হ্যাঁ-কে আরবিতে বলে 'নাম'। ল্যাটিনে বলে 'ইটা' আর ফরাসিতে বলে 'উই'।
এবারের আলোচ্য শব্দ 'হ্যাঁ' বা 'হাঁ'। এটি যে অব্যয়, সে ব্যাপারে সব অভিধানই একমত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ হাঁ-এন্ট্রিতে জানাচ্ছে, 'অব্য[আঁ- হাঁ, হি হাঁ, ঠ হাং, 'হ'(ঢাকা); Dravidian- 'am' yes(Caldwell, 579]। অর্থ, ১ স্বীকার, সম্মতি। ২ আহ্বানে উত্তর দেওয়ার শব্দ ৩ সম্বোধন।
হাঁ মানে যে মুখব্যাদানও হয়, তা তিনি অন্যত্র বলেছেন।
দ্রাবিড়ীয় ব্যুৎপত্তির কথা লিখতে গিয়ে কল্ডওয়েল সাহেবের কথা লিখেছেন হরিচরণ। বস্তুত কল্ডওয়েল, গুন্ডার্ট আর কিটেলের অধ্যাবসায় আর গবেষণা ছাড়া বাংলায় প্রচলিত দ্রাবিড় শব্দগুলির হদিশ পাওয়া যেত না। Rev. R Caldwell তাঁর বই 'A Comparative Grammar of The Dravidian or South Indian Family of Languages-এ বিস্তারিতভাবে সব কিছু লিখেছেন বাংলায় তথা সংস্কৃত ভাষায় দ্রাবিড় শব্দের প্রাচুর্যের কারণ ব্যাখ্যা করে। তেমনই Rev. H Gundert তাঁর প্রবন্ধ 'On the Dravidian Element in Sanskrit (Journal of the German Oriental Society) লিখে আমাদের দ্রাবিড়যোগ সুনিশ্চিত করেছেন। আর এক সাহেব Rev. F. Kittel তাঁর লিখনশলাকা 'On the Dravidian Element in Sanskrit Dictionaries(Indian Antiquary, January 1873) দিয়ে বাঙালির দক্ষিণী জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেছেন।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, বাংলাভাষায় প্রচলিত দ্রাবিড় শব্দগুলির মধ্যে দু'শোর মতো শব্দ এসেছে সংস্কৃতের মাধ্যমে, তৎসম ও তদ্ভব রূপে। এই শব্দগুলি মূলত সাহিত্যের শব্দ। এই গোত্রের শব্দ দ্রাবিড় থেকে সংস্কৃতে গৃহীত হয়েছিল অনেক আগে, বৈদিককালের সূচনা থেকেই গ্রহণ-প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঋগ্বেদে মোট সাতাশটি দ্রাবিড় শব্দ পাওয়া গেছে। রামায়ণ-মহাভারতের যুগেও দ্রাবিড় থেকে শব্দগ্রহণ অব্যাহত ছিল, তা চলেছে আধুনিক কাল পর্যন্ত। কল্ডওয়েল, গুন্ডার্ট, কিটেল তাঁদের নিজ নিজ তালিকা দেন দ্রাবিড় থেকে গৃহীত শব্দের। পরবর্তীকালে অধ্যাপক টি বারো আরও কিছু শব্দের সন্ধান পান। সংস্কৃতবাহিত হয়ে বাংলায় আসা শব্দগুলি ছাড়াও আরও প্রচুর সংখ্যক দ্রাবিড় শব্দ বাংলায় প্রচলিত। এগুলি বাংলায় প্রবিষ্ট হয়েছে বাঙালির দ্বিভাষিক পর্বে। পাশাপাশি দু'টি ভাষায় কথা বলার ফলে আর্যভাষীদের মুখের ভাষায় প্রচুর সংখ্যক দ্রাবিড় শব্দ ঢুকে যায় আর দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী বঙ্গে এসে আর্যভাষা পুরোপুরি গ্রহণ করলে তাঁদের নিজ আদিভাষার অনেক শব্দ নতুন গৃহীত আর্যভাষায় স্থান পায়। এই ভাবেই বাংলাভাষার দ্রাবিড়সম্পৃক্তি ঘটেছে।
আরও পড়ুন- সেনানায়ক জন্ম দিলেন আস্ত বাংলা শব্দ? যেভাবে এল ‘জাঁদরেল’ শব্দটি
যাই হোক, মূল বিষয়ে ফেরা যাক। হ্যাঁ বা হাঁ শব্দটি যে দ্রাবিড়মূল তা দৃঢপ্রত্যয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস অবশ্য অতটা আত্মবিশ্বাসী হতে পারেননি। তিনি হাঁ-শব্দের ব্যুৎপত্তিতে লিখেছেন, [সং হর্ম্ম (হাই) > হা, হাঁ] অর্থ, ১ বি, মুখব্যাদান ২ অব্যয়, স্বীকারোক্তি ৩ স্মরণার্থে ৪ নিবারণার্থ ৫ ডাকে সাড়া দিবার শব্দ ৬ অবধারণে, সন্দেহমোচনে, নিশ্চয়ে। ৭ আত্মপ্রসাদলাভে, সন্তোষ বা তৃপ্তি অর্থে। অর্থাৎ সকলপ্রকার হাঁ বা হ্যাঁ-য়ের পশ্চাতেই তিনি সংস্কৃত হর্ম্ম বা তদ্ভব হাই দেখেছেন।
সংসদ বাংলা অভিধান হাঁ বা হ্যাঁ শব্দের কোনও ব্যুৎপত্তির ঝুটঝামেলায় যেতে চায়নি। অব্যয়বাচক শব্দ বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। সংসদ অভিধান লিখেছে, "হাঁ, হ্যাঁ অব্য. সম্মতি স্বীকৃতি প্রভৃতিসূচক সাড়া; সত্যতা। অর্থাৎ নেতির বিপরীত জবাবসূচক।"
বাংলাদেশের বাংলা আকাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান (জামিল চৌধুরী সম্পাদিত) হাঁ শব্দের ব্যুৎপত্তিতে লিখেছে, "হাঁ [হি.] অব্য. ১ সম্মতিজ্ঞাপক শব্দ ২. সাড়া ৩ যাথার্থ্য সঠিকতা প্রভৃতি জ্ঞাপক শব্দ ৪ ঘনিষ্ঠ সম্বোধনে ব্যবহৃত শব্দ।" অর্থাৎ দ্রাবিড় ব্যুৎপত্তি মানেননি অভিধানকার। অভিধানকার হিন্দিকে মাথায় স্থান দিয়েছেন। হিন্দিতে শব্দটি কোন ভাষা থেকে এসেছে, তা নিয়ে কিন্তু অভিধানকারের মাথাব্যথা নেই। মুখব্যাদান অর্থে অন্য 'হাঁ' বাংলা প্রচলিত থেকে এসেছে বলে জানানো হয়েছে।
গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত 'বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান'-এ হাঁ শব্দের অস্তিত্ব নেই। সবই হা। হা[ধন্যাত্মক] বি, হতবুদ্ধি অবস্থা। "বিবি হা শব্দ নির্গত করিয়া হাঁ করিয়া রইলেন। ভবানী ১৮২৮। ২ অব্য অনুতাপ ও নৈরাশ্যব্যঞ্জক শব্দ।'হা মূঢ় মনুষ্য! তুমি কি ইহার অপেক্ষা আর শ্রেষ্ঠতর কৌশল মনেতেও কল্পনা করিতে পার"? অক্ষয়, ১৮৪৪। ৩ অব্য সম্বোধনে।৩ অ সম্বোধনে। হা বিধাতা, ছেলেবেলা হতেই এমন দুর্বল হৃদয় লইয়া...(রবীন্দ্র, ১৮৭৫)।
অদ্ভুত ব্যাপার, সম্মতি অর্থে হ্যাঁ শব্দের কোনও উল্লেখ নেই এই অভিধানে। তাহলে বিবর্তনের ফলে সম্মতিপ্রদানসূচক শব্দটি কি নৈরাশ্যব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে এখানে? নাকি অন্য কোনও গূঢ় ব্যঞ্জনা আছে? মোহাম্মদ হারুন রশিদ সংকলিত আরবি -ফারসি- উর্দু- বাংলা অভিধানে হাঁ শব্দটির অস্তিত্ব নেই। হ্যাঁ-কে আরবিতে বলে 'নাম'। ল্যাটিনে বলে 'ইটা' আর ফরাসিতে বলে 'উই'।
সবচেয়ে কাছাকাছি উচ্চারণ অবশ্য আর্মেনিয়ান ভাষায়। সেখানে হাঁ বা হ্যাঁ-র সমার্থক শব্দ 'আয়ো'। আয়ো থেকে আঁ হয়ে তা থেকে হ্যাঁ বা হাঁ হয়ে যেতেই পারে। ভারত তথা বাংলায় আর্মেনিয়ানদের অস্তিত্ব কয়েক হাজার বছরের। এ বঙ্গে মুর্শিদাবাদের সৈদাবাদে একটি, চুঁচুড়ায় একটি, কলকাতায় তিনটি ও পুরুলিয়ায় একটি আর্মেনিয়ান চার্চ এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। পটলের 'ডোলমা' তো বাঙালির ভাষা-হেঁশেলে আর্মানিরাই ঢুকিয়েছিল। কলকাতায় ব্রিটিশপূর্ব আর্মেনিয়ান কলোনির কথা লিখে গেছেন আর্মেনিয়ান ঐতিহাসিক তথা গবেষক মেসরোভ জ্যাকব শেথ। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও সেই মতের সমর্থক ছিলেন। তাই আর্মেনিয়ান 'আয়ো' থেকে আঁ হয়ে হ্যাঁ তথা হাঁ হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
আরও পড়ুন- সংক্রামক রোগ থেকে জন্ম আলস্যের? কীভাবে এল ‘কুঁড়ে’ শব্দটি?
অশোক মুখোপাধ্যায়ের সমার্থ শব্দকোষে হ্যাঁ শব্দটির প্রতিশব্দগুলি হল, "আচ্ছা, বিলক্ষণ, অবশ্যই, নিশ্চয়ই, ঠিক আছে, আচ্ছা বেশ"। সংস্কৃত 'অস্তু' থেকে অচ্ছ হয়েই নাকি আচ্ছা। এমনটাই জানাচ্ছে সংসদ বাংলা অভিধান। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধান কিন্তু বলছে [সং.প্রাকৃত='যা ইচ্ছা'] থেকেই এসেছে আচ্ছা।
এই আচ্ছা-র রূপভেদ আছে। প্রাদেশিক উচ্চারণে 'আইচ্ছা' যেমন হয়, তেমনি 'হাচ্ছা'-ও হয়। সাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ক্রীতদাস ক্রীতদাসী, সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী, কলেরার দিনগুলিতে প্রেম, স্বর্গের নির্জন উপকূলে ইত্যাদি গ্রন্থে সংলাপের মধ্যে কখনও কখনও আচ্ছার জায়গায় 'হাচ্ছা' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটাকে সন্দীপনী কেতা বা স্টাইল বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গীয় 'ঘটি' উচ্চারণে এটা হতে পারে। সন্দীপনবাবু নিজেও এ-বঙ্গীয় ছিলেন, হাওড়ায় জন্মেছিলেন। এ দেশিয় কথ্যভাষায় তাঁর জ্ঞান অপরিসীম। আচ্ছা থেকে হাচ্ছা হয়ে তা থেকে সংক্ষেপে হাঁ বা হ্যাঁ হয়েছে কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
তবে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য মতটি পাওয়া যাচ্ছে ড. সত্যনারায়ণ দাশের লেখা 'বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ (ব্যুৎপত্তিকোষ)' অভিধানটিতে। হাঁ, এই অব্যয় শব্দটি এসেছে কন্নড় বা গৌড়া কন্নড় 'হাঁ' শব্দ থেকে। অর্থ সম্মতিসূচক অভিব্যক্তি। দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর গৌড়া সম্প্রদায়ও এ বঙ্গে এসেছিল হাজার হাজার বছর আগে। তারাই হাঁ-নামক সম্মতিজ্ঞাপক শব্দটিকে বাংলায় নিয়ে আসে। শব্দটি অস্ট্রিকভাষী বাঙালি সাদরে গ্রহণ করে।