ইয়েতি সত্যিই আছে? বিশাল পায়ের ছাপ আসলে কার, যে রহস্যের কিনারা করতে পারেনি বিশ্ব

The truth of Yeti: ব্রিটিশ অভিযাত্রী এরিক শিপটন এক রহস্যময় ছবি তুলেছিলেন। বলা হয়, ইয়েতির পায়ের ছাপ ছিল সেটি!

হিমালয় পর্বত। যা দুর্গম, সেখানেই রহস্য, যেখানে রহস্য সেখানেই ভয়। আর যেখানে ভয় সেখানেই কাহিনি। নেপাল পর্বতের সেই রহস্যের এক অন্য নাম। হিমালয় এবং নিজেদের জনজাতিকে জুড়ে নেপালের আনাচেকানাচে এমন অনেক গল্পকথা ভেসে আসে যার ইতিহাস কোথায়, সত্যতাই বা কী ইয়ত্তা মেলে না। তবে এসবকে 'গল্প' বলে উড়িয়ে দিতে মোটেও চান না নেপালের মানুষ। নেপালিরা এই রহস্যে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন অদেখা, অব্যক্ত অস্তিত্বে। যেমন বিশ্বাস করেন, ইয়েতিতে। ইয়েতির গল্প, বা ইয়েতির ভয় পাহাড়ে নতুন কিছু নয়। ইয়েতি বা তুষারমানবের কাহিনি এমন এক রহস্য যার সত্যতা আজ অবধি যাচাই করা যায়নি। নেপাল, ভুটান এবং তিব্বতের হিমালয় অঞ্চলে নাকি ইয়েতির বসবাস। কিংবদন্তি অনুযায়ী, ইয়েতি কোনও রহস্য বা অলৌকিক বিষয় নয়। ইয়েতি চরম বাস্তব এবং ইতিহাসে এর অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে। ইয়েতির রহস্য জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তখন সিন্ধু উপত্যকা জয় করতে রওনা দিয়েছেন। স্থানীয়দের মুখে গল্প শুনে ইয়েতিকে দেখার ভীষণ ইচ্ছা হয়েছে তাঁর। নানারকম চেষ্টাচরিত্র করেও তিনি ইয়েতি দেখতে পেলেন না। যাকে দেখাই যায় না, তাকে এত বিশ্বাস করেন কেন মানুষ? ব্রিটিশ অভিযাত্রী এরিক শিপটন এক রহস্যময় ছবি তুলেছিলেন। বলা হয়, ইয়েতির পায়ের ছাপ ছিল সেটি!

ইয়েতির উৎপত্তি

হিমালয়ের সংস্কৃতিতে ইয়েতি নিয়ে নানা কাহিনি রয়েছে। ১৯৫১ সালে, ব্রিটিশ অভিযাত্রী এরিক শিপটন মাউন্ট এভারেস্ট পর্যন্ত একটি বিকল্প পথের সন্ধানে রওনা দেন। তাঁর যাত্রাপথে তিনি একটি অস্বাভাবিক পায়ের ছাপ দেখেন এবং এটির একটি ছবি তোলেন। বলা যেতে পারে, ইয়েতি সেই প্রথম বিশ্বজনীন রহস্য হয়ে ওঠে। এভারেস্ট অভিযাত্রী এরিক শিপটন মাউন্ট এভারেস্টের পশ্চিমে অবস্থিত মেনলুং হিমবাহে এই ছবিটি তুলেছিলেন। সেই বিশালাকার পায়ের ছাপটি ছিল ১৩ ইঞ্চি লম্বা! ইয়েতি সেইসময় এত আলোচ্য হয়ে ওঠে যে নেপাল সরকার ১৯৫০ এর দশকে ইয়েতি শিকারের লাইসেন্স জারি করে দেয়! বলাই বাহুল্য, ইয়েতি শিকার করার সৌভাগ্য হয়নি কারও।

আরও পড়ুন- বাঙালির ইয়েতি অভিযান, সিনেমা নয়, এই গল্পটা সত্যিই…

অনেকের অবশ্য বিশ্বাস, ইয়েতি আসলে একটি সাধারণ কালো ভালুক। কিন্তু পায়ের ছাপের ছবিটি এতটাই সহজ বা সাধারণ তো ছিল না। নিজের চোখে ইয়েতি দেখার অসংখ্য দাবি জানিয়েছেন নানা মানুষ। অন্যান্য নানা অভিযাত্রী এবং শেরপারা আরও নানা রকমের পায়ের ছাপের ছবি তুলে নিয়ে আসেন ঠিকই, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই তাতে প্রমাণিত হয়নি। এক্সপ্লোরার ব্রায়ান বাইর্নও ১৯৫৯ সালে অরুণ উপত্যকায় ইয়েতির পায়ের ছাপ খুঁজে পান। ইতালির পর্বতারোহী রেইনহোল্ড মেসনার আবার সত্যি করে ইয়েতি দেখেছেন বলে দাবিও করেছিলেন।

ইয়েতি দর্শন

মেসনারের দাবি, তিনি প্রথম ইয়েতি দেখেন ওই ১৯৮৬ সালে টাইবারের আশেপাশে কোথাও। তিনি হাঁটতে বেরিয়েছিলেন এবং পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সন্ধ্যার সময়, তিনি হঠাৎ লক্ষ্য করেন তাঁর সামনে এক বিশাল বড় এবং অন্ধকার ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। অনেকটা মানুষের মতোই কিন্তু তার গতি দ্রুত এবং সে অত্যন্ত শক্তিশালী। সেই রাতেই মেসনার নাকি ফের ইয়েতি দেখতে পান। সেই ইয়েতি প্রায় ৭ ফুট লম্বা! মেসনার এই অদ্ভুত প্রাণীটির প্রতি এমন আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যে তারপর টানা ১২ বছর ধরে হিমালয়ের অঞ্চল জুড়ে ইয়েতি খুঁজে বেড়ান।

আরও পড়ুন- আদিম মানুষের পায়ের ছাপ মিলেছে এখানে, অবাক করবে হিমালয়ের চেয়েও বহু বহু প্রাচীন এই পাহাড়

কিন্তু হিমালয়ে অসংখ্য ভ্রমণের পরে, ১২ বছরের গবেষণা থেকে তিনি যে সিদ্ধান্তে এসেছেন তা বেশ হতাশাজনক। মেসনার বলছেন, শেষ পর্যন্ত লাসা এবং কারাকোরাম অঞ্চলে ইয়েতিকে আরও বেশি করে দেখেছিলেন তিনি। তাঁর মতে এটি একটি পাহাড়ি ভালুক মাত্র। আর একজন অভিযাত্রী, আর্নস্ট শেফার ১৯৩৯ সালে জার্মান রাইখের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি গোপন অভিযানের অংশ ছিলেন। ইয়েতি রহস্যের তিনিও একই উত্তর দেন। জনশ্রুতি আছে যে, নাৎসি অভিযাত্রী আসলে এমন একটি প্রাণীকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন যাকে স্থানীয়রা ইয়েতি বলে দাবি করেছিল। কিন্তু শেফারের মতে, আসলে সেটা এক বড় তিব্বতি ভালুক ছিল।

আধুনিক যুগে ইয়েতি

ইয়েতি হিমালয় সংস্কৃতির এক অংশ। ভারত, ভুটান, নেপাল এবং তিব্বতের হিমালয় জুড়ে ইয়েতি এক বিস্ময়, ইয়েতি এক বিশ্বাস। নেপালে চাইলে বিলাসবহুল ইয়াক এবং ইয়েতি হোটেলে ঘর ভাড়া নিতে পারেন। ইয়েতি এয়ারলাইন্সে চড়তে পারেন। ইয়েতি তুষারমানব, নাকি ভালুক নাকি অন্যই কিছু তার রহস্য পুরোপুরি সমাধান হয়নি। তবে যেখানে ভয়, যেখানে রহস্য সেখানে সেই ভয়ের উৎস তো কিছু থাকবেই। ইয়েতি নেই, নাকি আছে- এই উত্তর কেবল জানে হিমালয়।

More Articles