বঙ্গবন্ধু-জিয়াউর রহমানের রক্তাক্ত লাশ, খুনির বিবরণে লেখা কথা ও RAW কর্তার সতর্কতা
প্রসেনজিৎ চৌধুরী: আধুনিক ভারত অর্থাৎ স্বাধীনোত্তর ভারতের গুপ্তচর বাহিনি ও গোয়েন্দা বিভাগের পিতা হিসেবেই থাকূেন রমেশ্বরনাথ কাও। 'র' (RAW) প্রধান হিসেবে যে সব ঘটনার কথা তিনি অল্প হলেও প্রকাশ করেছিলেন তার নির্যাস হলো এটুকুই- অযথা আস্ফালন নয়। লোক দেখানো বাগাড়ম্বর তো নয়ই। একজন গুপ্তচরের পেশাগত জীবনে ঘটে যাওয়া রোমহর্ষক ঘটনাগুলি অবসর জীবনেও তেমন প্রচার করার দরকার নেই। গোপনীয়তার শর্ত মেনে চলাই দস্তুর। এই দস্তুর কি এখন ততটা মেনে চলা হয়? প্রশ্ন থাকবে।
তবে কাও সাহেব একটু হলেও মুখ খুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে খুনের বিষয়ে। চাঞ্চল্যকর সেই বিবরণের পর এটাই জানা গিয়েছে, অন্তত দু'বার শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করেছিল ভারত সরকার। তাতে প্রত্যক্ষ অংশ নেন আর এন কাও।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনির অভ্যুত্থানে খুন হন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্ত্রী সন্তানরা সহ পরিবারের বাকি আত্মীয়রা। ঢাকায় না থাকার কারণে বেঁচে যান মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা।
বিশ্বজোড়া আলোড়ন ফেলে দেওয়া বঙ্গবন্ধু খুনের সংবাদে স্তম্ভিত হয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাৎপর্যপূর্ণ, ইন্দিরাকেও খুন করা হয়। অমৃতসরে অপারেশন ব্লু স্টার চালানোর পরে তাঁকেও সতর্ক করা হয়েছিল। তবে তিনিও সতর্কতা উপেক্ষা করেন।
ইন্দিরার অতি বিশ্বস্ত ছিলেন 'র' (RAW) প্রধান রমেশ্বর নাথ কাও। ইন্দিরা হত্যার পরে ১৯৮৯ সালে ইংরাজি 'Sunday' সাপ্তাহিক 'র' ভূমিকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনর কিছু অংশে ক্ষোভ জানান আর এন কাও। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে তা জানতে পারে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ। ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে অতি গোপনীয়তা রেখে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে দু'বার সেই সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়েছিল।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের সেই সতর্কবার্তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের 'জাতির পিতা'। সহাস্য ভরাট কণ্ঠে তিনি বলতেন, বাংলাদেশের বাঙালিরা আমার কিছু করবে না। আবার নিজের চারপাশে ঘুরঘুর করা কয়েকজনকে নিয়ে প্রকাশ্যেই সন্দেহ করতেন।
কাও লিখেছিলেন, মুজিবুর রহমানের কাছে অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়ার চমকপ্রদ কথা। তাঁর প্রতিবেদন পড়ে চমকে যায় আন্তর্জাতিক মহল।
১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সহ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর মিলেছিলে কাও বর্নিত ঘটনায়। তবে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা পরে বিভিন্ন সময়ে নিজেরাই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। তাদের কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। আরও কয়েকজন পলাতক এখনও।
র কর্তা আর এন কাও লিখেছেন কেমন করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনির একাংশ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সলতে পাকিয়েছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর খুনের বিবরণটি লিখেছেন পাকিস্তানেরই সাংবাদিক পরে ব্রিটেনের নাগরিকত্ব নেওয়া অ্যান্টনি মাসকারেনহাস। সেও চরম রোমহর্ষক।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনা যে গণহত্যা চালাচ্ছে তার ভয়াবহ বিবরণ প্রকাশ করেছিলেন খোদ পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্টনি মাসকারেনহাস। পরে স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে দুটি সামরিক অভ্যুত্থানে দুই রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে খুনের বিবরণ তিনি লিখেছেন 'Bangladesh: A Legacy of Blood' (বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ) বইতে। প্রবল সাড়া জাগানো এই বইতে মাসকারেনহাস অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ সেনাকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে মুজিব খুনের পর ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানকে গুলি করে খুন করা হয়। তবে জিয়াউর খুনের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে মুজিব খুনের সময় ততকালীন সেনা অফিসার জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ করেছেন মাসকারেনহাস। খুলিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তিনি লিখেছেন ১৯৭৫ সালের সেই রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের কথা। সেই সূত্রে উঠে এসেছে মুজিবুর রহানকে খুনের খবরটি পাওয়ার পর অর্থাৎ ঘটনার দিন জিয়াউর রহমানের আচরণ। বইতে সপরিবারে মুজিব হত্যার পর পরবর্তী রাষ্ট্রপতির কুর্সি দখল, বাংলাদেশ সেনার মধ্যে পারস্পরিক বিদ্রোহ, ঢাকার বঙ্গভবন জুড়ে দুপক্ষের যুযুধান পরিস্থিতি সবমিলে 'বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ' বইতে রোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন অ্যান্টনি মাসকারেনহাস।
র প্রধান আর এন কাও লিখেছিলেন মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে সতর্ক করার বিষয়ে। কেমন ছিল সেই মুহূর্ত ? তাঁর বর্ণনাটি বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে অনুবাদ হয়েছে। কাও লিখেছেন,
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে আমি ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা যাই। এই সফরকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়ার সময় আমি তাঁকে পায়চারি করতে করতে বঙ্গভবনের বাগানে যেতে অনুরোধ করি। সবার অগোচরে নিয়ে গিয়ে আমি আমার তথ্য তাঁকে জানাই যে তাঁর জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে। তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, ওরা সবাই আমার নিজের ছেলে। আমাকে আঘাত করবে না। আমি তর্কের মধ্যে না গিয়ে বললাম, আমাদের তথ্য নির্ভরযোগ্য এবং এই ষড়যন্ত্রের যেসব তথ্য পেয়েছি, তা বিস্তারিত পাঠাতে পারব।
রমেশ্বরনাথ কাও লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে আমি একজন কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠাই। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে যেসব তথ্য ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ পেয়েছে তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে জানান। আমরা জানতে পারি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনির দুটি ইউনিট, বিশেষ করে গোলন্দাজ (আর্টিলারি) ও অশ্বারোহী বাহিনি (ক্যাভালরি) তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে শেখ মুজিব আমাদের সব সতর্কতাই উপেক্ষা করেছিলেন।
সৌজন্যে:
- The conspiracy behind the assassination of Bangabandhu: The Daily Star Bangladesh
- Sheikh Mujibur Rahman had ignored RAW alert ahead of bloody 1975 coup: Economic Times
- Bangladesh: A Legacy of Blood, by Anthony Mascarenhas