বুনো গন্ধের ঝোঁক ধরিয়েছিলেন গুহমশাই
Moonlit Night at Saranda forest and Buddhadev Guha: ক্রমাগত ঝিঁঝিঁর ডাক, পাইড পাইপারের ওই সুর আর সে হৃদি ভেসে যাওয়ার আয়োজন… পরে জেনেছি, আমায় ফের ঘুমের মোহনায় নিয়ে গিয়ে ফেলা সে সুর, নিধুবাবুর টপ্পা।
তখনও অতশত বুঝতাম না, স্বাভাবিক, রাত দশটার বহু আগেই খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়। মানে আমি তখন কোলে চড়ার বয়স আর ‘এখন আর কোলে চড়ে না’-র থ্রেশোল্ডে আরকী! ফলে বুঝতেই পারছেন যে বোঝার কথা না, অমন অ্যাডভেঞ্চারাস ও ভয়াবহ হুজুগে বাঙালি কেন ও কী ভাবে এই আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়াল! প্রায় নির্বিঘ্নে বয়ে যাওয়ার পূর্ণিমা রাতকে একা হাতে ওই গুহমশাই খেপিয়ে দিয়ে, পাল পাল বাঙালিকে নিয়ে চললেন কিরিবুরু’র দিকে। এবং এক জনকেও ভাবতে দেখলাম না, যে হোয়াই? বা নিদেনপক্ষে, হে বাঙালি, খানিক চমকাও! ও মা, সে গুড়ে বালি। হাসিমুখে সবাই হাল্লা চলেছে যুদ্ধ মোডে। কেউ কেউ আবার আগামীর উচ্ছ্বাস অ্যান্টিসিপেট করে ইতিমধ্যেই এক কলি-দু’কলি শ্যামল-মানবেন্দ্র গুনগুনিয়ে ফেলছিলেন। না, মানে আমি তখন ওসব বুঝবই বা কী করে, তা ছাড়া ঘুম-চটা আমার মেজাজ তিরিক্ষি। আসলে মা আর বাবা ওই ইতিউতি গুনগুন শুনে প্রাণপণ ধরার চেষ্টা করছিল, অ্যাকচুয়ালি গানটা কী হতে পারে। আর একটু হলে সুর (??) শুনে ২০ কোয়েশ্চেন্স-এর মতো দাঁড়াচ্ছিল ব্যাপারটা। সে যাক গে, আমার মতো খানকতক বাচ্চা জাস্ট বোঝার চেষ্টায় ব্রতী ছিল, কাদের হাতে গিয়েছে রাজপাট! প্রগাঢ় দূরদর্শিতার লক্ষণ, বলাই বাহুল্য। তো, আমাদের জিপে মা-বাবা, খচাকাত্তিক আমি ছাড়াও পিছনে ঢাউস হাঁড়ি-খুন্তি-বাসন-কোসন, নিশুত রাতে চরাচরকে আপন ঢকরঢকর শোনাতে শোনাতে চলল। মুনলাইটে জঙ্গল-মাঝে পিকনিক হবে কি শুকনো মুখে? ওই পাঞ্জাবি-ঢোলা পায়জামা পরা মানুষটা আগের একটা গাড়িতে, কোন যাদুবলে কে জানে কোথা থেকে কেজি কেজি মাংস করায়ত্ত করে গুপ্তধনের মতো আগলে, লিডিং দ্য ওয়ে।
আর পিঁপড়ের সারি হয়ে আমরা অনুসরণকারী। সারান্ডার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সে প্রহরেও জেগে থাকা রাস্তা, অল্প বিষন্ন কোনও একাকী নারীর নির্বিকার সিঁথির মতো যেন। হয়তো সারা দিন বনান্ত খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ। আগামীর সূর্যস্নাত উঠোনে গিয়ে ফের দাঁড়ানোর পূর্বে খানিক জিরিয়ে নেওয়ার মৃদু বাসনা নিয়ে বেচারি যেই না থিতু হতে উদ্যোগী হয়েছিল, অমনি ধারবর্তী শুকনো পাতায় শিরশিরানি তুলে বেরিয়ে যায় ছোট টাউনের অজস্র জোনাকিফুল। ক’বিঘে আনন্দের তরে। এক সময় সে ক্যারাভ্যান শেষের ইশারা বুঝে গা ছেড়ে দেয় অদৃশ্য খড়ি দিয়ে টানা ক্ষণস্থায়ী সে আরামাঞ্চলে। হাঁড়িকুড়ি নামে, নামে আলু-পেঁয়াজ, নামেন লোকাল হেমন্ত-মান্না-ও (হ্যাঁ, পথ যত দীর্ঘ হয়েছে, শ্যামল-মানব জার্সি পাল্টে সুর ধরেছেন হেমন্ত-মান্না’র)! নেমেছিলাম নিশ্চিত ফেরৎ-ঘুমে বিভোর কোলে চড়া আমিও।
আরও পড়ুন: কৃপাসিন্ধু মাংসঠাকুর ও গুহমশাইয়ের রাতবিরেতের ফোন
অতঃপর ঝোপ সাফা করে ইঁট-কাঠের সংসার, মাংসে হলুদ, পেঁয়াজ-রসুন ছেঁচে তৈয়ার, ও দিকে তেলেবেগুনে আরম্ভ হয়েছে কড়াই-খুন্তি সম্বাদ, যেটা এক্সপেক্ট করছেন হ্যাঁ সেটিও, কিছু জন পানীয়ে ভর করে অলরেডি ডুবোজাহাজ এবং মাথার উপর ফিটকিরিতে জল লাগলে যেমন জ্যোৎস্না ঠিকরে বেরোয়, তেমন প্রশ্রয়ী, আলাপী এক চাঁদ-ও। কাব্যের ভূবন ছাড়া তার কথা আর কেই বা তেমন ভাবে বলুন না, একটু নয় হাতখুলে খরচ করলই আলো। ক’দিনই বা কালাহান্ডির ক্ষুধাসর্বস্ব কাতরতা মেখে মেখে বাড়ি ফিরতে ভাল্লাগে…
আর একটা কথা হঠাৎ খেয়াল পড়ল। এই যে কেমন অবলীলায় লিখে ফেললাম না — যেটা এক্সপেক্ট করছেন পাঠক, হ্যাঁ সেটিও… এক দল পানীয়ে ভর করে ইত্যাদি ইত্যাদি — মনে করে দেখলাম, আমাদের ওই আশির কোঠায়, অন্তত বরবিলে, পিকনিকের মূল সুর কখনওই গেলাস-বোতল হত না। আমার যেমন মনে আছে, একটু বড় হয়ে এক বার বাবার অজান্তেই দেখে ফেলেছিলাম আহলুওয়ালিয়া আঙ্কেলের আন্ডারগ্রাউন্ড সেলার। সেলার কথাটা জেনেছি যদিও কলকাতায় এসে। তো, সেটাই বলছি, আহলুওয়ালিয়া আঙ্কেল সে কালে ট্রাকের ব্যবসা করে পর্বতপ্রমাণ টাকা করেছিলেন। ’৮৭ সালে মনে আছে, শিবকাশী থেকে স্পেশাল লোক এসে বাজি ফাটিয়ে দিয়ে যেত দিওয়ালিতে। শুনেছি তখনই খরচ ৫০,০০০ টাকা। এই আহলুওয়ালিয়া আঙ্কেলের সন্ধে নাগাদ গাল লাল-লাল ঘাম-ঘাম হয়ে যেত নাকি আর চোখে পলাশফুলের রং। কিন্তু তন্ন তন্ন করে মনে করেও তেমন উচ্চপর্যায়ের কারওকে সে রাতে চাঁদের তলায় পেলাম না। দয়া করে এখানে বাঙালি-পাঞ্জাবি ভাগ বা পাঞ্জাবি অর্থেই মদ্যপ-টদ্যপ খুঁজতে যাবেন না, কারণ সে ক্লাসিফিকেশন অতীব ফালতু।
মায়ের কাছে পরে শুনেছি, সে রাতে মাদুর বিছিয়ে রাতভর ধীমে আঁচের ওমে কেমন নতুন করে আপন শিকড়কে আগলে রাখার মনোবল পেয়েছিল বরবিলে ভেসে আসা কত বাঙালি। প্রকৃত অর্থেই এ বনভোজন যেন হয়ে গিয়েছিল সেই পাইড পাইপারের মেলা, যেখানে তিনি অনুসরণকারীদের এনে, বসিয়ে, যত্নে এক বীজমন্ত্র শিখিয়ে যান। তার পর ফেরৎ পাঠিয়ে দেন নিজ নিজ চৌহদ্দিতে। দিয়ে বলেন, কে বলে তুমি শিকড় ছেড়ে এসেছ এইখানে? নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আর কবেই বা দেখবে বাপধন? আপন ছায়ায় কী ঢাকা পড়ে আছে, খানিক ঝুঁকে পড়ে দেখো তো! গুহমশাই সম্ভবত রাতের আলোয় দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে যখন এ সব বলেছিলেন, নিজেকে কি কোথাও কাবুলিওয়ালা রহমৎ মনে হয়েছিল তাঁর? সে অন্তরমহল বোঝার ডিস্ট্যান্সে ছিলাম আমি, কিন্তু ওই যে বললাম, তখন অতশত বোঝার বয়সটাই যা হয়নি…নইলে, রাত বাড়ার সঙ্গে এক সময় যখন প্রবল ক্র্যাঙ্কি হয়ে পড়েছিলাম আমি, এক বার মা, এক বার বাবা, এক বার অন্য এক কাকিমা (দুঃখিত ঝাপসা হয়েছে স্মৃতি, দীর্ঘ শহরবাসের হেতু) নিয়ে হেঁটে শান্ত করার চেষ্টায় কিছুটা ব্যর্থই, তখন গুহমশাই মায়ের কাছ থেকে আমায় চেয়ে নিয়েছিলেন। আর কোলে করে অদ্ভুত একটা সুর গেয়ে গেয়ে জঙ্গলের সে ধারটায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, সেই দূরের পাহাড়। ক্রমাগত ঝিঁঝিঁর ডাক, পাইড পাইপারের ওই সুর আর সে হৃদি ভেসে যাওয়ার আয়োজন…দূরের পাহাড় শান্ত হয়ে পড়া আমায় না দেখুক, করেছিল নিশ্চিত দৃষ্টিবিনিময় তাহার সঙ্গে। পরে জেনেছি, আমায় ফের ঘুমের মোহনায় নিয়ে গিয়ে ফেলা সে সুর, নিধুবাবুর টপ্পা।
গুহমশাইয়ের আশ্চর্য ক্ষমতা আমার এটুকুই মনে আছে আর মনে আছে প্রায় ভোর হওয়ার মুহূর্তে আমরা ফিরছি যখন, সেই একই অঙ্গে হেমন্ত-মান্না-মানব-শ্যামলদের মুখে জন্মের বিষাদ। বিসর্জনের তিথি যেন। কারণ, গুহমশাই সে দিনের ট্রেনেই বেরিয়ে যাবেন। তিনি ফিরে যাওয়ার পর একটা মায়ার ঘের বাস করেছিল বহু দিন, এখন বুঝি, বরবিলে। আমার অবশ্য তখন সে ঘেরের চেয়ে অধিক ঝোঁক সেই বুনো গন্ধে, যা জংলি আগাছার থেকে অল্প ক্ষণের ধার চেয়ে গুহমশাই আমায় ধরিয়ে গিয়েছিলেন। কে জানে, সেই থেকেই আমি জঙ্গলের সোঁদা গন্ধের অ্যাডিক্ট হয়ে গেলাম কি না। বারে বারে শুধু মনে হয় যাই উড়ে সে সবুজে। খুঁজে খুঁজে ফিরি তাই আজও ঠিক সেই স্থান, যেখান থেকে আগাছা তুলে পাইড পাইপার নিয়েছিলেন অমোঘ সে আঘ্রাণ। নাকি বিলিয়েছিলেন দেদার, আমাদেরই, বিশেষ করে আমায় তো বটেই। এ ভাবেই কি তিনি চুপিসাড়ে কনভার্ট করেছিলেন আরও এক জনকে, আপন ধর্মে? হয়তো বা।
আরও পড়ুন:অতল খাদের আহ্বান থেকে হতভাগাদের মুক্তি নেই
জঙ্গল নিয়ে এমন রোম্যান্টিক সাতকাহন দিস্তে দিস্তে আওড়াচ্ছি এখন বটে, মা থাকলে না দিত গাঁট্টা। আর বাবা জাস্ট তাকাত। আর সে তাকানোতেই আমি ফিরে যেতাম আর এক জঙ্গলে। প্রহর আবার সেই শেষ রাত। বাস-এ করে আসছি কলকাতা। ওহ্, আইসিং অন দ্য কেক হল গিয়ে শীতকাল। মিনিমাম ৮/৯ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাইরে। সাধারণত টাটানগর থেকে বা এক-দু’বার চাইবাসা হয়ে চক্রধরপুর থেকে ট্রেন ধরতাম। ইস্পাত বা স্টিল, বম্বে মেল বা গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস, কিন্তু সে বার কী একটা কারণে, বাস-এ। পথে একটা অঞ্চল ছিল, যেখানে বেশ কয়েক বার বাস থামিয়ে ডাকাতি হয়েছিল (না, মাওবাদী বিপদ নয়, তা অনেক পরের ঘটনা, তখন আমি খাস কলকাত্তাইয়া), ফলে ব্যবস্থা ছিল যে ওই স্ট্রেচখানি পুলিশের দুটো গাড়ি বাসের আগে আর একটা পিছনে থেকে পার করিয়ে দেবে। তার আগে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রাস্তার হোটেলে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে সবার, আমি ছোটো, তাই আমার জন্যে বাড়ি থেকেই। খাওয়ার পর যেই না রোমহর্ষক (এখন শুনতে তাই, তখন হাড়হিম করা) সে স্ট্রেচে ঢুকল বাস, আমি কাঁচুমাচু মুখে মা-কে বলেছিলাম, বাস থামাও…
এ পর্বে আপাতত এইখানেই থামি, বুঝলেন!