ঈশ্বরের বরপুত্র মারাদোনা ও সেই সাদাকালো জাদুবাক্সটা...
Maradona and Nostalgia of Black and White Television: যে পৃথিবীতে লীলা মজুমদারকেও ইতি টানতে হয়, সেখানে কি এ হেন অদ্ভুতুড়ে অনন্তকাল চলতে পারে? অতএব, পাখার ব্লেডে আঘাত খেল জার্মান চাম, মারাদোনা যেই না পাসটি বাড়ালেন...
আমার জীবনে টিভি যখনই এসেছে, কোনও না কোনও খেলার গা বেয়ে। যেমন ’৮৬-র এক বিকেলে হঠাৎ দেখলাম, বাবা অফিস থেকে একটু আগেই বেরিয়ে গিয়ে, গাড়ি করে মস্ত একটা বাক্সে কী যেন নিয়ে উপস্থিত। তার আবার এমন বপু যে তিন-চার জন মিলে তাকে পরম যত্নে ঘরে এনে তুলছে। মা অলরেডি যেখানে রাখা হবে তা পাট পাট করে ঠিক করে ফেলেছে। বাড়িতে টিভি এসেছে, ভাল কথা, তখনও ঠিক ভেতর থেকে উত্তেজনা আলপথ ডিঙিয়ে ধেয়ে আসছে না। কিন্তু সবার মধ্যে, মানে অফিসের বাকিদের মধ্যে যে হেতু একটা বাড়তি উন্মাদনা দেখছি, তাই আমিও নিয়মের লঙ্ঘন খুব একটা করছি না। কার্ডবোর্ডের বাক্স খোলা-টোলা হচ্ছে, ভেতর থেকে কী বেরোয় তাতে আমি মজে, ও মা, সহসা বাইরে শুনি অন্য হুজ্জুত। ছুটে গিয়ে দেখি, বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুর ন্যায় স্থির। না, ইনফ্যাক্ট ঝড়ের রাতে প্রদীপের সলতের মতো স্থির বলাটাই সমীচিন বোধহয়!
অ্যান্টেনা নামক এক বস্তুকে একটা আখাম্বা লোহার পাইপের টঙে বেঁধেছেঁদে আরও আরও আকাশমুখী করা হচ্ছে কি না! তাই ক্যাপ্টেন অমিতকুমার ভট্টাচার্য নিজ পজিশন থেকেই একটু বাঁয়ে, না দেড় পা ডাঁয়ে, আহা স্টপ, কী মুশকিল স্টপ মানেই থামবি?- গোছের নির্দেশ/দিকনির্দেশ দিয়ে চলেছে আর ডান হাতের এইচএমটি ঘড়িটির দিকে কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু মনে তাকাচ্ছে। বাবা যে প্রাণপণ অধৈর্য, এমনটা আদপেই নয়, আফ্টার অল পরীক্ষা পাস করা ক্রিকেট আম্পায়ার ছিল। ফলে সকাল টু প্রায় সন্ধে রোদে দাঁড়িয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়াটা হ্যাবিট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে দিনকার ঘনিয়ে আসা সন্ধে কি আর যে সে সন্ধে? কানাঘুষো শুনেছি, ও রাতে নাকি কোন ঈশ্বরের বরপুত্র নামবে গোলকধামে! তাই আপাতত আঁধার নামার আগেই অ্যান্টেনা-ম্যান্টেনা যুৎসই অবস্থায় এনে ফেলে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কোণার্ক টিভি’র শাটার খুলে অসংখ্য সাদাকালো ঝিরঝির সাঁতরে পাড়ি দিতে হবে তো মেক্সিকো! যেখানে কাঠফাটা রোদে নামবে সেই দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা…আহা, উপরে উল্লিখিত সেই বরপুত্র।
আরও পড়ুন: বুনো গন্ধের ঝোঁক ধরিয়েছিলেন গুহমশাই
আমি তো ছাই প্রথমে কিছুই বুঝছিলাম না, যে অত রাতে আবার কে খেলতে নামে! মানে ওকে! পর দিন সকালবেলা আমার মতো স্কুল না-ই বা থাকল, তাই বলে রাতে? এ সব উত্তর অবশ্য পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না, কারণ ততক্ষণে অফিসের কয়েক জন- বিনয়কাকু, পাণ্ডাকাকু, দত্তকাকু, বিরোদাদা, তা ছাড়াও আশপাশ থেকে আন্টিকাকু, বাপ্পাদাদারাও এসে জমে গেছে, সোফায়, খাটে, কার্পেটে। আর মা সবার জন্যে তৈরি করছে রস্না, গ্লাসভর্তি কমলা। শুনলাম এটা খেলা-পূর্ববর্তী অধিবেশন, রাতে নাকি ফের চড়াও হবে! কিন্তু ততক্ষণে আমার যে বহুজন মাঝেও ব্যক্তিগত নীল নির্জন-প্রাপ্তি হয়েছে। টিভি’র সে নীল অধিকতর হয়েছিল, ছবির গ্লেজ থেকে বাঁচতে কাচের উপরে লাগানো আর একখানি স্ক্রিনগার্ডের হেতু। 'স্ক্রিনগার্ড' শব্দটি অবশ্য বরবিল কেন, তখন কলকাতায়-ও আমদানি হয়নি, শিওর। আমি সেই আদি মুহূর্তে নিজেকে তো আর দেখিনি, কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারি, আমি শাটার-খোলা অন্য ভুবনের দিকে ঠিক মুখ হাঁ করে তাকিয়ে থাকিনি। তাকে দেখেছিলাম মাঝপথে স্কুল জয়েন করা নতুন ক্লাসমেটের মতোই। যাকে টিচার পাশে বসালে, ধীরে সব কিছু চিনিয়ে-বুঝিয়ে দিতে হয়।
ক্রমে এই চেনানো-বোঝানোর দায়িত্ব অবশ্য ও-ই নিয়ে ফেলল। আমি তখন বিকেলবেলা থেকেই বায়না করে মা’কে দিয়ে টিভি আর বুস্টার চালিয়ে নিতাম, শুধু শাটার খোলার প্রক্রিয়াটিই আমার তুলকালাম ম্যাজিকাল মনে হত। প্রকৃত চিচিং ফাঁক। ঘরঘর করে সানমাইকা দেওয়া শাটার দু’দিকে সরে গেলেই তো ফেড ইন করবে সেই অগুনতি সাদা-কালো ডট। যেন অপার হিপনোসিস। অতঃপর আমি অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকব সে গহিন তলে। চরাচর ছেয়ে ফেলা অনিয়ন্ত্রিত জলীয় বাষ্পের মতো নীল আভা অধিগ্রহণ করবে আমার সত্তা। নেহাৎ দেখার মন নেই, থাকলে নিশ্চিত দেখতে পেতাম আমাদের প্রকাণ্ড বারান্দায় উঁকি মেরে সারিবদ্ধ পাখি-জোনাকি, জানলার শিকে নাক ঠেকিয়ে নাগালে আনতে প্রয়াসী ভিনগ্রহী এ আলোর নাচন। আমারই কি খেয়াল থাকত, অনন্ত ঝিরঝির কখন 'রুকাওয়ট কে লিয়ে খেদ হ্যায়' পেরিয়ে স্থান দিয়েছে ‘কৃষিদর্শন’-কে? কতক্ষণ যে নল থেকে জল পড়ে চলেছে আর সে জল খাত বয়ে ঠিক পর্যাপ্ত ভিজিয়েছে কৃষকের ক্ষেত, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ কস্মিনকালেও ঢোকেনি কানে, তবুও কেউ আমায় টিভি’র সামনে থেকে উঠে চলে যাওয়ার দোষে দোষী সাব্যস্ত করতে পারবে না, চ্যালেঞ্জ। আমার স্কুল সেন্ট মেরি’জ থেকে দুপুর নাগাদ যখন ফিরতাম, বাড়ি আসার একটু আগে থেকেই কেমন যেন বোধ হত, খানিক বেশি আলো না বাড়ির চার পাশটায়? কেউ মানুক না মানুক, বিশ্বাস না করলেও আমার থোড়াই কেয়ার, আমি দেখেছি সে আলোর ছটা। এবং আজও জানি, সে আভার নেপথ্যে কী বা কে। জানি না আজও সেই বড় চামচিকেটা বেঁচে আছে কি না। সরি, ওদের লাইফ স্প্যান কত, খেয়াল নেই। কিন্তু ও থাকলে ঠিক বলত, ওই নীল আলো কীভাবে ভোলাত পুরনো অভ্যাস।
সত্যি এ ভাবেই দিন ফুরোনোর, সাঁঝ গড়ানোর অপেক্ষা শিখে ফেললাম, দশ-ও কি তখন পেরিয়েছি? নীতি রবীন্দ্রন, তেজেশ্বর সিং, ঊষা আলবুকার্ক, সুনীত ট্যান্ডন, গীতাঞ্জলী আইয়ার অদ্ভুত এক নিয়মানুবর্তীতার পরিচয় দিয়ে সন্ধে নাগাদ, আবার রাতেরবেলায় ঠিক চলে আসেন। খবর বলেন কিন্তু আমি কোথাও ঠিক ধরতে পারি, কী দাপট! বরং বলি কী অনায়াস দাপট। কোথাও কোনও আস্ফালন নেই, কোনও দেখনদারি, চকমকি ইত্যাদি কিন্তু আমি দূরবর্তী হলেও এক রকম আত্মীয়তা বোধ করি। যেন তাঁরা পরমবন্ধুর ঘুরতে আসা জ্যাঠামশাই। কালো মোটা ফ্রেমের চশমার ওপর দিয়ে যাঁদের চাহনি দেখলেই প্রথমেই থতমত জাগে প্রাণে, কিন্তু একটু খুঁটিয়ে বুঝতে চাইলে বোঝা যায়, এ খেলায় আসলে তাঁদের প্রশ্রয়ই ছিল। কে জানে, প্রশ্রয়ের তেপান্তর আমাদেরই হয়তো চেনা হয়নি ঠিক অর্থে। তাই তো কখন যে হাত সরিয়ে নিতে হয়, কখনই বা আরও গা এলিয়ে দেওয়ার ক্ষণ, বুঝে উঠতে পারলাম না ফলে ওই ঐশ্বরিক নীল আভা-ও আনমনা এক প্রহরে অভিমানী হৃদয় নিয়ে এক কাপড়ে ছেড়ে গেল বসতভিটে।
আরও পড়ুন: কৃপাসিন্ধু মাংসঠাকুর ও গুহমশাইয়ের রাতবিরেতের ফোন
মাফ করবেন, আমি কী যে বলি, লিখি... আপনারা কেউ কেউ পড়েন হয়তো, আমার যে কোথায় ভুল হল, কেন যে নীল আলো গেল নিভে, কী দোষে সে আমাদের চৌহদ্দি পেরিয়ে গেল অদৃশ্যে, সত্যি আপনারাই বা কেমন করে ধরে দেবেন আমায়, তবুও আপনারা কী ভাল, আমার এ গুজগুজানি শুনে চলেন। আসলে আমার ঘোর বিশ্বাস, সায়েন্স ফিকশানেই নয়, বাস্তবেও ফেলে আসা কত মধুমাস আদতে যায় না ফেলা। ওরা চরকা কেটে চলে নিভৃতে। অপেক্ষারত, নিশ্চিন্দিপুরে অপু ফেরার। কারণ, ফিরতে তো হবেই। ফেরা, কখনও না কখনও তো হবেই। বেট লড়ব। আর ফিরলে, সে দিনের সেই রেকর্ড আবার ঘুরবে টার্নটেবিলে। দেখা যাবে, ’৮৬-র বিশ্বকাপ। একটা ঘর নীলে নীল। সোফায়, কার্পেটে, খাটে, বাবা আর অন্য দাদা-কাকুরা। মা, সেই রাতেও রস্না নিয়ে আসছে, তার পর বসে রুমেনিগে’র বল হোল্ড করা দেখছে, পাশের ঘরে আমি আধো-ঘুমে, পরের দিন ছুটি হলে, আমিও জেগে মেক্সিকো’র রোদবেলায়। এ হাফ থেকে ও হাফে উঠছি, নামছি, চোখে সত্যিই ঝিলমিল লেগে যাচ্ছে আর মাঝেমাঝেই ভয়ে চোখ বুজে মাথাটা নামিয়ে নিচ্ছি। ইংরেজিতে যাকে বলে ডাক্ করা। কারণ, ঠাকুরানির পাহাড় থেকে কি না কে জানে, বারান্দা বেয়ে সেই চামচিকেটা নীলের চক্রব্যূহে ঠিক ঢুকে পড়ত আর পাখার চারপাশে এক বারও ধাক্কা না খেয়ে চক্কর কাটত। প্রথম দিন হ্যাট হ্যাট করে তাড়ানোর চেষ্টা হল, সে উড়ে পালাল আবার কখন উড়ে এসে জুড়েও বসল। নেক্সট দিন, ও মা, আবার হাজির সে। তার পর দিন আবার। এক দাদাস্থানীয় হঠাৎ আবিষ্কার করল, চামচিকে শুধুই জার্মানির খেলার দিন আসে। বিশ্বাস করুন। এবং জার্মান চামচিকেটি কোনও দিনই বাঁইবাঁই করে ঘুরে যাওয়া পাখায় কাটাও পড়ে না। অদ্ভুত। কিন্তু যে পৃথিবীতে লীলা মজুমদারকেও ইতি টানতে হয়, সেখানে কি এ হেন অদ্ভুতুড়ে অনন্তকাল চলতে পারে? অতএব, পাখার ব্লেডে আঘাত খেল জার্মান চাম, ফাইনালের দিন, মারাদোনা যেই না সেই ছোট গল্পের শেষের মতো পাসটি বাড়ালেন বুরুচাগাকে।
আর বছর ৬ পরেই তো ও ঘরে ধূসর এক পাণ্ডুলিপির অশুভ মহরৎ হবে।
যে ঘরে আমার ফেরা, ঘোর নিয়তি।