ক্ষমতার লাথি খাওয়া নাস্তিক দর্শনকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন আকবর
Akbar and Chárváka Philosophy: যে দর্শন পছন্দ হয় না, ভগবানের নাম যেখানে নেই- তাকেই 'ইহসুখবাদী' ছাপ মেরে দাও।
ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী লোকায়ত ধারার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী ছিলেন চার্বাকরা, যাদের আর্বিভাব ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মমতের সমসময়েও এই নাস্তিক-বস্তুবাদী দর্শনের অবশেষের খোঁজ পাওয়া যায় খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতকে। কিন্তু ষোড়শ শতকের শেষে, এই চার্বাকরা পুনরায় দেখা দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবরের ফতেপুর সিক্রির রাজদরবারে এবং তারা অংশগ্রহণ করেছিলেন বিবিধ ধর্মদর্শনের মধ্যে আয়োজিত একটি বিতর্কসভায়। ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শনের এই সমান্তরাল ইতিহাস- ইউরোপিয় আধুনিকতার তাত্ত্বিকদের কাছে বহুদিন অবধি অপরিচিত ছিল।
স্টিফেন গ্রিনব্লাট রচিত- The Swerve: How the World Became Modern (২০১১) বইটি ইউরোপিয় বস্তুবাদের আদিযুগ প্রসঙ্গে জনমানসে পুনরায় চর্চার সূত্রপাত ঘটায়। রেঁনেসা থেকে উদ্ভূত আলোকায়ন-প্রক্রিয়ার উপর প্রাচীন বস্তুবাদী দার্শনিক ডেমোক্রিটাস, লুক্রেটিয়াস, এপিকুরাসদের প্রভাব পুনরালোচিত হতে শুরু করে। কিন্তু সেই আলোচনাগুলি কেবলমাত্র ইউরোপিয় পরিপ্রেক্ষিতেই থেমে যায়। আকবরের দরবারি বিতর্কসভায় চার্বাকদের আগমনের আখ্যান প্রশ্ন তোলে গ্রিনব্লাটের প্রতিপাদ্যের প্রতি- ইউরোপের মতো মুঘল আমলেও কি বস্তুবাদের 'নবজাগরণ' ঘটেছিল? রেঁনেসাকে বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বোঝার জন্য, বহু ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে একইসময়ে বস্তুবাদের সমান্তরাল চর্চাকে লিপিবদ্ধ করার জন্য, পাশ্চাত্যের চশমায় এশিয়দের জ্ঞানচর্চাকে দেখার ভঙ্গিকে প্রশ্ন করার জন্য এই ঘটনাটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। এই কাজটিই করেছেন হানা চ্যাপেল ওয়েজেহস্কি, তাঁর 'East- West Swerves:Cārvāka Materialism and Akbar’s Religious Debates at Fatehpur Sikri' প্রবন্ধে।
আরও পড়ুন- মজেছিলেন আকবর থেকে রানি ভিক্টোরিয়া! খিচুড়ির অবাক করা ইতিহাস আজও অজানাই
১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর নিজের রাজদরবারে বিভিন্ন ধর্মীয় মত ও দার্শনিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্কের পথ খুলে দিয়েছিলেন। এই বহুত্ববাদী কথোপকথনে সুফি, সুন্নি, শিয়া প্রভৃতি ইসলাম-পন্থার সঙ্গে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন হিন্দু, জৈন, পারসিক, জরাথ্রুস্টিয়, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের। আবুল ফজল আকবরনামায় জানিয়েছেন, এই বিতর্কসভায় উপস্থিত ছিলেন চার্বাক-গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। হেনরি ব্যাভেরিজের সম্পাদনায় আকবরনামার অনুবাদ (১৯৭৭) থেকে জানা যাচ্ছে, আবুল ফজল উপস্থিতির তালিকায় লিখছেন- 'Sufi philosopher, orator, jurist, Sunni, Shia, Brahmin, Jati, Siura, Carbak, Nazarene, Jew, Sabi, Zoroastrian, and others'..
এপিকুরাসের দর্শন যেমন খ্রিস্টিয় পশ্চিমাবিশ্বে দেহাত্মবাদী/সুখবাদী দর্শন হিসাবে পরিচিত, এই বেদান্তবাদী দেশে চার্বাকের পরিচিতিও তেমনই। আবুল ফজলের সাক্ষ্য এই দার্শনিক-সম্প্রদায়ের একদা লুপ্তধারার সম্পর্কে ও পুনরুত্থানের ইতিহাস সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টান্ত হাজির করে। অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ্যবাদের করাল গ্রাসের মুখেও চার্বাকরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি। দুভার্গ্যবশত, সেই বিতর্কসভায় চার্বাকরা কী বলেছিলেন তা নথিভুক্ত হয়নি। যদিও, আকবরনামার তৃতীয় খণ্ডে আবুল ফজল নাস্তিক ধারা হিসেবে চার্বাকদের খানিক বর্ণনা দিয়েছেন। যদিও, হিন্দুদের অন্যান্য গোষ্ঠী নিয়ে তিনি বেশ কয়েক পৃষ্ঠা লিখলেও চার্বাকদের নিয়ে লিখেছেন মাত্র কয়েকটি বাক্য। আবুল ফজল লিখছেন-
'Chárváka, after whom this school is named, was an unenlightened Brahman. Its followers are called by the Bráhmans, Nástikas or Nihilists. They recognize no existence apart from the four elements, nor any source of perception save through the five organs of sense. They do not believe in a God nor in immaterial substances, and aff i rm faculty of thought to result from the equilibrium of the aggregate elements. Paradise, they regard as a state in which man lives as he chooses, free from the control of another, and hell the state in which he lives subject to another’s rule. The whole end of man, they say, is comprised in four things: the amassing of wealth, women, fame and good deeds. They admit only of such sciences as tend to the promotion of external order, that is, a knowledge of just administration and benevolent government. They are some what analogous to the sophists in their views and have written many works in reproach of others, which rather serve as lasting memorials of their own ignorance.'
এই অনুবাদটি এইচ. এস.জ্যারেটের (১৯৮৩)। জ্যারেট বলছেন চার্বাকদের সম্পর্কে ফজলের ব্যাখা সম্পূর্ণ জায়েজ কারণ ভগবদ্গীতায় এই সম্প্রদায়কে ধিক্কার জানানো হয়েছে।
আরও পড়ুন- ‘অন্ধকার বলে কিছু নেই, আছে আলোর অভাব’, বলতেন আজীবন মার্কসবাদী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
এটা এখনও ধোঁয়াশার যে, তিনি সত্যিই নিজে বিতর্কসভাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন কিনা, নাকি সমাজের প্রচলিত মতামতগুলি থেকেই চার্বাকদের সম্পর্কে মতামত তৈরি করছিলেন। কিন্তু, সাধারণত মুক্তমনা হিসাবে পরিচিত আবুল ফজল তাই করেছিলেন যা চার্বাকদের সঙ্গে সকল প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান করা হয়েছিল। সে প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর চার্বাকচর্চা বইটিতে লিখেছিলেন-
"চার্বাকসূত্র এখনও অবধি পাওয়া যায়নি। তবে বিরোধী পক্ষের কাব্য-নাটক ইত্যাদিতে ব্যঙ্গরূপ (প্যারোডি) পাওয়া যায়। ... চার্বাকমত ধর্মবিরোধী, ইহলোকসর্বস্ব, সুতরাং ইন্দ্রিয়সুখ ছাড়া এরা কিছু বোঝে না- এই বিকৃতি শুরু করেন বৈদান্তিক কৃষ্ণমিশ্র আর শ্রীহর্ষ। জৈন ঐতিহ্যে 'কলিকালসর্বজ্ঞ' হেমচন্দ্র থেকে চার্বাকদের হেয় করার জন্য তাদের ভোগসর্বস্ব বলে দেখানো শুরু হয়। ...যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা- ব্যপারটা এইখানেও এইরকম। যে দর্শন পছন্দ হয় না, ভগবানের নাম যেখানে নেই- তাকেই 'ইহসুখবাদী' ছাপ মেরে দাও।" (পৃ: ৮৫-৮৬)
একইসঙ্গে একথাও স্বীকার্য যে, সম্রাট আকবরের বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল ও সহনশীলতাই এমন প্রান্তজনের নাস্তি-দর্শনকে রাজসভার বিতর্কে ঠাঁই দিয়েছিল। এবং, হতেও পারে তাঁর দরবারের উলেমাদের রাজনৈতিক দখলদারি কমাতে, নিজের বহুত্ববাদী ধর্মচর্চাকে অব্যাহত রাখতে তিনি চার্বাকদের তর্কবিদ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর Studies on theCārvāka/Lokāyata.(২০০৯)- বইটিতে চার্বাক প্রসঙ্গে লিখেছিলেন-
"in as much as it shows that this system had definitely become a ‘lost philosophy’ by the sixteenth century and even the best pundits of north India had little idea of its tenets."
প্রকৃতই টীকাকার সদানন্দের 'বেদান্তসার' ও রামতীর্থের 'বিদ্বানমনোরঞ্জনী' এই বইদু'টি, যেখানে চার্বাকমতকে ভ্রান্ত বলা হয়েছিল সেগুলিই উত্তর ভারতে বেশি জনপ্রিয় ছিল। জনার্দন গানেরি তাঁর 'Emergentisms, Ancient and Modern.' (২০১১) প্রবন্ধে দেখিয়েছেন রামতীর্থের টীকাটিপ্পনীর প্রভাব উনিশ শতকের প্রাচ্যবাদীদের বিপুল প্রভাবিত করেছিল। রামতীর্থের বইটি প্রকাশিত হয় ১৮২৮-এ, ১৮৩২-এ ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে, ১৮৩৫-এর মধ্যেই হয়ে যাচ্ছে জার্মান অনুবাদ। ১৮২৭-এ হেনরি কোলব্রুক সাহেব, এই বইয়ের সূত্র ধরেই লন্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটিতে বক্তৃতা করছেন, ভারতীয় বস্তুবাদী, লোকায়ত দার্শনিক বৃহস্পতি প্রসঙ্গে। এটাও ভেবে দেখার, নাস্তিক-বিরোধী বৈদান্তিকের টীকা থেকে পশ্চিমাদের ভারতীয় বস্তুবাদ প্রসঙ্গে বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। এহেন, সদাপ্রত্যাখাত, ক্ষমতার লাথি খাওয়া দর্শনকে বাদশাহ আকবর ক্ষমতায় কেন্দ্রস্থলে নিজের কথা বলবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।