'জীবনের নোংরা দিকটা আমার ছবিতে যথেষ্ট উঠে এসেছে': সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ রায়ের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সত্যজিৎ দাশগুপ্ত, বর্তমানে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীবিদ্যা চর্চা কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ লিগাল এইড সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত। 'শনিবারের চিঠি'-তে (নব পর্যায়, ১ম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা, ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৪) প্রকাশিত হয়েছিল এই লেখাটি। এশিয়াটিক সোসাইটি-র মান্থলি বুলেটিন মে ২০২২, ভলিউম এলআই, পাঁচ নম্বর ইস্যুতে এর সম্পাদিত রূপ প্রকাশিত। মূল লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হল বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত রেখে। নামকরণ সম্পাদকীয় দপ্তরের।
সত্যজিৎ দাশগুপ্তর বিবৃতি:
এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম বেশ কিছুকাল আগে। সেসময় আমি একটি প্রবন্ধ রচনার কাজে সবেমাত্র হাত দিয়েছি। বিষয় ছিল, বাংলা ছায়াছবির তিন অগ্রণী পরিচালক (সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন) তাঁদের ছবিতে বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসের নানান দিক কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্যজিৎবাবু তখন কলকাতায় ছিলেন না। উনি ব্যস্ত মানুষ, তাই একটি চিঠিতে বিস্তারিতভাবে আমার প্রয়োজনের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে ওঁর কাছে সময় চেয়েছিলাম। তার অল্পদিন বাদে ফিরে এসেছিলেন। ফোনে সময় ঠিক করে দিনসাতেক বাদে একদিন সকাল সোয়া আটটা নাগাদ ওঁর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে গিয়ে দেখি, উনি কাজ করছেন। সামনে একটি কাঠের স্ট্যান্ডের মতো এবং কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে সেই স্ট্যান্ডের মাথায় লাগানো বোর্ডের ওপর টুকরো টুকরো কাগজ সেঁটে দিচ্ছেন। চতুর্পাশে বই। বিশাল জানলাটা দিয়ে রোদ আসছিল অনেকখানি। আমার সঙ্গী জয় দাশগুপ্ত সেখানে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা ঘোরানোর তোড়জোড় করতেই উনি বললেন, তা প্রবন্ধে ছবি কী হবে? আর বললেন, আমি কিন্তু কাজ করতে করতেই কথা বলে যাব। মাঝে মধ্যে তীব্র চোখে হাতের কাজ থামিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকছিলেন। মাঝখানে কিছুক্ষণ আলোচনা বন্ধ ছিল। দু'-জন মহিলা ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন কোনও একটা বক্তৃতার প্রস্তাব নিয়ে।
প্রশ্ন: আপনার চিন্তা-ভাবনাকে অনেক কিছুই প্রভাবিত করে থাকবে এই সুদীর্ঘ সময়ে। এই ‘ইন্টালেকচুয়াল’ ব্যাপারটি থেকেই শুরু করা যাক। মারী সীটনকে আপনি বলেছিলেন যে, এমনকি কলেজে উঠেও আপনি চারপাশের জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তেমনভাবে সজাগ হয়ে ওঠেননি এবং শান্তিনিকেতনে যাবার পরই মস্ত বড় একটা পরিবর্তন এসেছিল। আমার মনে হয় শিল্পচিন্তার মধ্যে হিউম্যানিজম কিংবা ওই যেটাকে বলা যায় এনলাইটেন্ড লিবারেলিজম্ এসবের মধ্যে যে ধারাটা চলে আসছে তারও সূত্রপাত ওই সময়টাতেই হয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার অন্য অনেক কিছুই হয়ত যোগ-বিয়োগ হয়ে থাকবে, তো এইখান থেকেই শুরু করছি।
সত্যজিৎ রায়: এখানে ব্যাপার হচ্ছে... একটা কথা আপনাকে বলব? আমরা নিজেদের ইনফ্লুয়েন্সটা কিন্তু সেভাবে অ্যানালাইজ করি না। ওটা বার করা হচ্ছে সমালোচকদের কাজ। কোত্থেকে কিভাবে ইনফ্লুয়েন্সড্ হয়েছি সেটা ওভাবে বিশ্লেষণ কোনও শিল্পী করে বলে আমার মনে হয় না। বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা বাড়ে। পড়াশুনা বাড়ে। নানারকম সবকিছু বেড়ে যায়। জ্ঞানের গোটা পরিধিটাই অনেকখানি বেড়ে যায়। সেখান থেকে মানুষের অভিজ্ঞতা অনেকটা সমৃদ্ধ হয় স্বাভাবিকভাবে এবং সেইসব অভিজ্ঞতার ছাপ শিল্পীর কাজের মধ্যে পড়তে থাকে। কিন্তু সে বিষয়ে যদি নির্দিষ্ট করে বলতে বলা হয় যে ঠিক কে কে বা কি কি জিনিস ইনফ্লুয়েন্স করল সেটা বলা খুবই মুস্কিল।
প্রশ্ন: আচ্ছা এই যে আপনি মনে করেন যে শান্তিনিকেতনে থাকাটা আপনার জীবনে একটা বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল সেই গোটা প্রক্রিয়াটার ভেতর রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব কতখানি?
সত্যজিৎ রায়: না, সেই দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমি সেরকম ভাবে বলিনি। আমার প্রভাব যেটা এসেছিল সে ব্যাপারে ফাইন আর্টসের ডিপার্টমেন্টে আমার মাস্টারমশাইদের ভূমিকাটাই প্রধান ছিল। এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সরাসরি কোনও একটা সম্পর্ক ছিল বলে আমার মনে হয় না। নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এঁদের নাম সকলের আগে করতে হয় তাহলে। এটা যে সব সময় শুধু শিক্ষকদের কাছ থেকেই এসেছে তাও নয়। আমার বন্ধুবান্ধব যাঁরা তখন ওখানে ছিলেন কিংবা শান্তিনিকেতনের বাইরে তাঁদের প্রভাব রয়েছে আমার ওপর। তারপর নিজের পড়াশুনা তো ছিলই। ওখানে খুব ভাল একটা লাইব্রেরী ছিল আমাদের এবং ফিল্মের ওপর সিরিয়াস্ বইগুলো আমি ওখানেই প্রথম পড়ি। যেমন পল্ রথা কিংবা স্পটেস্ উডের বইগুলো। তারপর সত্যি কথা বলতে কি, ভারতীয় শিল্পের ঐতিহ্য সম্বন্ধে আমার যে ধারণা সেটাও ওই শান্তিনিকেতনেই এসেছিল কেননা সেই ট্র্যাডিশনটার সঙ্গে সেরকম পরিচয় শান্তিনিকেতন যাবার আগে আমার ছিল না।
আরও পড়ুন: সায়েন্স ফিকশন ফিল্মে মানুষের তৈরি যন্ত্রই মানুষের শত্রু
প্রশ্ন: এই ভারতীয় ঐতিহ্যের ব্যাপারে আমার মনে হয় যে রেনেসাঁসের সঙ্গে সম্পর্কিত যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা বোধহয় প্রথম থেকেই আপনার মধ্যে ছিল ডমিনেন্ট ট্রেইট হিসাবে ?
সত্যজিৎ রায়: হ্যাঁ, সেটা ছিল। পূর্ব এবং পশ্চিমের ভেতরে একটা সিনথিসিসের ব্যাপার...
প্রশ্ন: এই সিনথিসিসের ব্যাপারটাকে আমি যদি এভাবে ব্যাখ্যা করি যে মূলতঃ আপনি একজন হিউম্যানিস্ট হিসাবেই বরাবর শিল্পের ভেতর এক্সপ্লোর করেছেন... একটা সীমানা টেনে না দেওয়ার যে...
সত্যজিৎ রায়: এখন সিনথিসিসের সঙ্গে সেটার সম্পর্ক আছে কিনা জানি না। সেটা হয়ত আমার নিজের অবজারভেসেনের একটা ক্ষমতা, মানুষ চেনার ক্ষমতা বা প্রবণতা। সেটা হয়ত কিছুটা রক্তের মধ্যেও থাকে। আমার ফ্যামিলিতেও হয়ত সে জিনিসটা ছিল খানিকটা। এও হতে পারে। এটা তো আর শুধু পড়াশুনা করেই দেখা যেতে পারে এমন তো নয়। তবে ফিল্ম যখন করতে যাচ্ছি, ফিল্মের আগে তো আমার টেনডেনসিস্ কোনদিকে বা কি তার কোনও পরিচয় কোনও কিছুতে পাওয়া যায়নি কেননা শিল্পী হিসেবে আমার প্রথম কাজ সিনেমা পরিচালক হিসেবেই... তার আগে যেগুলো করেছি, সে কমার্শিয়াল আর্টসই হোক আর গ্র্যাফিক আর্টসই বলুন, তার মধ্যে যে জিনিসটা ফুটে উঠেছিল সেটা হচ্ছে দেশী আর বিলাতীর একটা সংমিশ্রণ, সেটা নিশ্চয়ই ফুটে উঠেছিল। তার প্রথম পরিচয় পাওয়া যাবে আমার তখনকার গ্র্যাফিক কাজে বা আমার বই এর মলাট, আমার বিজ্ঞাপন, আমার ক্যালিগ্রাফি এসবের মধ্যে। যেখানে দেশী আর বিলাতী দুটো দু-দিকের ট্র্যাডিশন সম্বন্ধে একটা এ্যঅয়ারনেস্ সেটা পাওয়া যাবে। কিন্তু তারপর সত্যি করে মানুষের প্রতি আমার এ্যাটিটিউড, সেটাকে লিবারেলিজম্ বা হিউম্যানিজম যাই বলা যাক না কেন, সেটার ছাপও গ্র্যাফিক আর্টসে খুব একটা পড়ে না... সেটা আস্তে আস্তে সিনেমার ভেতর দিয়েই ফুটে উঠেছিল হয়ত।
প্রশ্ন: হ্যাঁ, এবার তাহলে ছবির কথাতেই আসা থাক। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক্স নিয়ে বেশ কয়েকখানা ছবি করেছেন আপনি, সেখানে আবার রবীন্দ্র সাহিত্যের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইসব ছবিতে একটা ‘ক্লাসিসিজম’ মানে যেসব মানুষ, যেসব জীবন আপনি ধরেছেন সেখানে একটা স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। কোনও কোনও সমালোচকের মতে ক্লাসিসিজমই আপনার ট্রিটমেন্টকে নান্দনিকভাবে সূক্ষ্ম একটা জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে মানুষের চরিত্রের কতগুলো কদর্য দিক খুব স্পষ্ট ভাবে ধরা পরে না। এরকম একটা অভিযোগ সম্পর্কে আপনি কি বলেন?
সত্যজিৎ রায়: চরিত্রের এইরকম সব কদর্য দিক আমার ছবিতে যথেষ্ট আছে। এখন কদর্যতা এখানে কিসের? চোখের সামনে যেটা একেবারে সোজাসুজি প্রকট হয়ে পড়ছে নাকি ব্যবহারের একটা কদর্য রূপ যেটা আভাসে ইঙ্গিতে ছবির মধ্যে আসছে? চোখের সামনে জীবনের যে নোংরা ছবিটা যেটাতে এক ধরনের ক্লিন্নতা বা এক ধরণের... যেমন বস্তির জীবন ধরা যেতে পারে, সেটা হয়ত সেরকম ভাবে আমার ছবিতে নেই। কিন্তু, যেমন আমার মনে হয় প্রথম ছবিতেই সর্বজয়া এবং ইন্দিরের সম্পর্কের মধ্যে যে ব্যাপারটা রয়েছে সেটাকে এককথায় যথেষ্ট রূঢ় বলা যেতে পারে, খুবই রূঢ়, যেরকম রূঢ় বাস্তব হয়ত আমাদের বাংলা ছবিতে খুব বেশি দেখানো হয়নি। কাজেই ওই অভিযোগটা আমার কাছে তেমন একটা জোরালো মনে হয় না আদৌ। তারপর এখন যদি চোখের সামনেও কিছু দেখানোর প্রয়োজন হয় সেও তো ‘সদগতি’তে দেখানো হয়েছে, তবে আমার নানা রকম বিষয় সম্বন্ধে একটা উৎসাহ ছিল, কৌতূহল ছিল কাজেই অনেক সময় আমি এমনও করেছি যেটাকে বাইরের চোখ দিয়ে দেখলে আপাতদৃষ্টিতে সবসময় খুব সুন্দর মনে হয়। যেমন চারুলতা, আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি। এমনিতে চোখের দিক দিয়ে দেখতে গেলে সেখানে কোনরকম মলিনতা নেই কিন্তু মনের দিক দিয়ে যথেষ্ট আছে। আমি তো সব সময় দুটোকে দুরকম ভাবে ধরি, ওই চোখ আর মনের মধ্যে দুটো আলাদা জিনিসকে আমি ধরতে চেয়েছি বরাবর। মানুষের মনের মধ্যে অনেক মলিনতা থাকতে পারে যেটা কোনদিনই আমার ছবি থেকে বাদ পড়েনি। মনস্তত্ত্বের দিকটায় আমি জোর দিয়েছি বলতে পারেন।
প্রশ্ন: আমিও সেটাই বলছিলাম। সমালোচকদের বক্তব্য হল যে, জীবনকে একেবারে নগ্নরূপে দেখবার ব্যাপারটা নিয়ে কোথায় যেন আপনার একটা অস্বস্তি এসে যায় মানে আপনার যে সৌন্দর্যবোধ, যে একটা কাব্যিক সূক্ষ্মতা সেসবের সাথে কোথায় যেন ঠিক খাপ খায় না। সত্তরের দশকে এখানকার মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্কট নিয়ে যে ছবিগুলো করেছিলেন সেগুলোকে মূল্যায়ণ করতে গেলেও এই কথাটা মাথায় রাখলে ভাল হয় বলে আমি মনে করি।
সত্যজিৎ রায়: তা সেসবের সঙ্গে কাব্যিক সূক্ষ্মতা বা নান্দনিক ব্যাপারগুলোর কি সম্পর্ক আপনি ইমপ্লাই করতে চাইছেন? মানে আপনি কি বলতে চাইছেন যে আমি ওই আপনার কথায় যা কিছু কাব্যিক নয় কিংবা প্রচলিত অর্থে নান্দনিক ভাবে সুন্দর নয় অর্থাৎ কিনা জীবনের তথাকথিত একেবারে রূঢ় বা কদর্য দিকগুলো এড়িয়ে যেতে চেয়েছি? খুব গোড়ার দিকের ছবিতেও যেমন ‘দেবী’ ছবিটাতে যথেষ্ট ‘স্ট্রং’ বিষয়বস্তু ছিল এবং তার ট্রিটমেন্টের মধ্যেও কোনরকম ছাড়ান ছিল না। কোনোদিক দিয়ে কোনও আপোস করতে চাইনি সেখানে। কিন্তু তারপরে মোটামুটি যে ধরণের বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করেছি তাতে হয়ত ওই যেটাকে আপনি বলছেন রূঢ় বাস্তব সেটা ছিল না। সে প্রশ্নও সেখানে ওঠেনি। কিন্তু পরে সত্তরের দশকে আমার নিজেরই মনে হয়েছিল যে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজের কতগুলো সমস্যার দিক তুলে ধরা যায় এবং তার একটা কারণ হচ্ছে ওই সময় কতগুলো বিশেষ বিশেষ গল্প আমার চোখে পড়েছিল।
প্রশ্ন: প্রতিদ্বন্দ্বী, জনঅরণ্য এইসব ছবির কথা বলছেন নিশ্চয়ই?
সত্যজিৎ রায়: হ্যাঁ, সেই ছবিগুলোর কথাই ধরা যাক। যে সময়টায় আমার মনে হয়েছিল এবং বিশেষ করে শহরের অবস্থাটাও এমন ছিল, যেমন নানারকম সমস্যার মধ্যে শহরের চেহারাটাও এমন হয়েছিল যাতে মধ্যবিত্তের সমস্যাগুলো একটু বেশি করে যেন বাইরে বেরিয়ে আসছিল। সব ব্যাপারগুলোই একটু বেশি প্রকট হয়ে উঠছিল। ফলে আমার মনে হয় তখন যে সেগুলো নিয়ে ছবি করা যেতে পারে। তখন আপনা থেকেই সে তাগিদটা অনুভব করেছিলাম আমি।
প্রশ্ন: মোটামুটিভাবে বলা যায় উচ্চ মধবিত্ত জীবনই আপনার সেসব ছবির বিষয়বস্তু হয়েছে। যেমন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘জনঅরণ্য’ ...
সত্যজিৎ রায়: প্রতিদ্বন্দীটাকে ঠিক উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যায় না। বরং ‘সীমাবদ্ধ’কে আপার মিডল্ ক্লাসের ছবি বলতে পারেন। আচ্ছা আপার মিডল্ ক্লাস বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন বলুন তো?
প্রশ্ন: মানে আমি বলতে চাইছিলাম যে মধ্যবিত্ত সমাজের নীচের দিকে যে জীবন সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত আপনার ছবিতে সেভাবে আসেনি।
সত্যজিৎ রায়: ও বুঝতে পারছি। সেটা আমি এখনও সে ধরনের বিষয়বস্তু আছে এমন গল্প পাইনি তাই করিনি। এ ব্যাপারে আমার যে কোন বিশেষ বাধা বা আপত্তি আছে তা তো নয়। গল্প পেলেই করব। মানে কথা হল যে, একই সঙ্গে তো আর সবকাজ করা যায় না। ওটা আস্তে আস্তে হতে থাকে।
প্রশ্ন: আচ্ছা আমি একটু অন্যদিকে সরে যাচ্ছি। জনঅরণ্যে আপনি যেভাবে শেষ করেছিলেন ব্যক্তিগতভাবে সেটা আমার খুব ভাল লেগেছিল। যা ঘটছে চারপাশে তাকে মেনে নেওয়া কিংবা তার সঙ্গে একটা আপোস করা এ ব্যাপারটা মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকের চরিত্রের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তো সেই কমপ্রোমাইজের ঘটনাকেই সেখানে আপনি তুলে ধরেছিলেন। অনেকে আবার প্রতিবাদের দিকটাকেও বড় করে দেখিয়েছেন। আমার মনে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কমপ্রোমাইজ করাটাই আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের যুবককে ভাল করে চিনিয়ে দেয়।
সত্যজিৎ রায়: কমপ্রোমাইজ মানে আমি তো কোনওদিন কোথাও কোনও সমাধান বাতলে দিইনি। আমার যেটা মনে হয়েছিল যে সমস্যাটাকে তুলে ধরাটাই হচ্ছে বড় ব্যাপার। সলিউশনের দিকে তো আমি কোনদিনই যাইনি কারণ সলিউশন তো আমাদের জানাও নেই অনেক ক্ষেত্রে। কাজেই আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমস্যাটাকে পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলে তার থেকে দর্শকদের সচেতন করা এবং আমি মনে করি এইটাই একজন শিল্পীর সঠিক কাজ হওয়া উচিত। আগবাড়িয়ে কোনোরকম কিছু সাজেস্ট আমি কোনোদিন করিওনি, করতে পারবোও না, আর সেটা করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না।
প্রশ্ন: আপনি একজন সচেতন শিল্পী। চারদিকের ঘটনাসব একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল মন নিয়ে দেখে যাচ্ছেন। মধ্যবিত্ত জীবনের কোন কোন দিকগুলো নিয়ে এই মুহূর্তে ছবি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
সত্যজিৎ রায়: মধ্যবিত্ত জীবন... আমি ওরকম কিন্তু সমস্যা দিয়ে আরম্ভ করি না। কি কি সমস্যা আছে, অতএব সেই সব সমস্যা দিয়ে ছবি তুলতে হবে বা সেইসব সমস্যার সমাধান করতে হবে এভাবে কিন্তু আমি দেখছি না ব্যাপারগুলোকে। একটা তো সমস্যা রয়েছেই, যেটা বেকারত্বের সমস্যা, সেটা কোনোদিন শেষও হবে না এবং এ নিয়ে চিরকালই ছবি তোলা যাবে। এর বাইরেও যা দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সে তো সবই রয়েছে। এক্কেবারে ঘটমান কালের কথা যদি ধরি, ইনফেকশন্ বলা যেতে পারে, পপুলেশন্ বলা যেতে পারে। আবার একবারে কলকাতার কতগুলো নির্দিষ্ট সমস্যা রয়েছে। কিন্তু ওই যা বললাম, সমস্যার কথাটা আগে ভেবে এই সমস্যা নিয়ে এবারে তাহলে ছবি তোলা যাক - সেরকম কিন্তু মনোবৃত্তি আমার নয়। গল্পের মধ্যে এবং সেটা শুধু যে সমস্যা নিয়েই গল্প হবে তা না। তার ভেতর বাইরের অনেক কিছু জিনিস এসে যাবে। সমস্ত ব্যাপারটাকে একটা ম্যাক্রোকসমিক্ ভাবে দেখানো হবে।
প্রশ্ন: আচ্ছা আপনি নকশাল বাড়ি আন্দোলন নিয়ে কোনও ছবি করেননি কেন? সম্প্রতিকালে বাঙালী মধ্যবিত্ত যুবকদের একটা অংশত এই আন্দোলনের দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিল এবং হয়ত খানিকটা এখনও হচ্ছে। নতুন এবং পুরোনো বাঙালী পরিচালকদের অনেক ছবিতে এই আন্দোলনের ব্যাপারটা এসেছে বারবার টুকরো টুকরো ভাবে।
সত্যজিৎ রায়: আমার তো মনে হয় না ওই ধরনের কোনও সরাসরি রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আদৌ কোনও ছবি করা যায় খোলাখুলিভাবে এদেশে। সেনসরশিপ আমাকে দেবেই না সেটা করতে।
প্রশ্ন: এটাই সবথেকে বড় বাধা ?
সত্যজিৎ রায়: একেবারে বৃহত্তম অসুবিধা সেটা। আর তা না হলে খানিকটা করে, অন্যরা যেরকম করেন, খানিকটা করে এগিয়ে যান আবার পিছিয়ে যান, ওভাবে করে তো কিছু হয় না। সম্ভবই না এটা করা। কেউ করেও না, করতে পারেও নি এবং করতে পারবেও না কোনদিন।
প্রশ্ন: আচ্ছা আজকাল কি একটুখানি লিবারেল মনে হচ্ছে এই সেনসরশিপের হাবভাব? একটু বেশি সহ্য করা হচ্ছে এরকম বলা যায় কি?
সত্যজিৎ রায়: কই, কিসের থেকে সেরকম কনক্লুশন টানবো আমি?
প্রশ্ন: আমি অনেকদিন আগে আপনার লেখায় পড়েছিলাম যে, আপনাকে বোধহয় বলা হয়েছিল যে সাদা টুপী মানে গান্ধী টুপীকে করপশনের প্রতীক করে দেখানো যাবে না এবং সেটাকে কালো করে দিতে হবে।
সত্যজিৎ রায়: হ্যাঁ, সেটা তো হয়ই। মানে সেনসর বললে তো একটা মনোলিথিক্ কিছু বোঝায় না। সেটা তো বছরে বছরে বদলায় বা বেশ কিছুদিন পরপরই পাল্টে যায়। সেগুলো কতগুলো মানুষের সমষ্টিত এবং তাদের মধ্যে কিছু কিছু লোকের বেশ বুদ্ধি থাকে আবার কিছু কিছু লোকের থাকেনা। সবই নির্ভর করে কারা বোর্ডে আছেন তার উপর। ব্যক্তিই এখানে আসল কথা। কাগজে লেখা নিয়মকানুনের ওপর এটা দাঁড়ায় না। ব্যক্তিগত বুদ্ধি-বিবেচনার ওপরই কাজগুলো হয় বা হয় না। এক এক সময় এমন হয় যে সেনসরবোর্ডে কিছু বুদ্ধিমান লোক রয়েছে যাদের বলে বোঝান যায়। এর উল্টোটাও হয় কখনও কখনও। এমন নয় যে কোনও পলিসি খুব শক্তভাবে ওপর থেকে তেমন ভেবেচিন্তে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন: সমকালীন চলচ্চিত্রের সমস্যা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। আপনি কি মনে করেন যে আপনি একটি বৃহৎ দর্শক গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন? এই প্রশ্নটা জরুরী এই জন্য যে এর থেকেই আমরা একটা বিষয় নিয়ে ভাবনা শুরু করতে পারি যে, সত্য এবং বিকৃত রুচির সিনেমাকে রুখতে হলে কি করা প্রয়োজন।
সত্যজিৎ রায়: আমি তো সারা বাংলাদেশের অডিয়েন্সের কথা বলতে পারব না। আমি যেটুকু জানি যে কলকাতায় একটা অডিয়েন্স তৈরি হয়েছে গত বিশ-পঁচিশ বছরে এবং নিঃসন্দেহে সেটা বেড়েও গিয়েছে যেটাকে আমার ছবির দর্শক বলা যেতে পারে। আমি যে কোনও ছবিই করি না কেন তারা দেখতে যাবে, এটা আমি জানি। কাজেই কলকাতার একটা দর্শকগোষ্ঠীর ওপর আমি মোটামুটিভাবে নির্ভর করে ছবি করতে পারি, এটুকু বলা যেতে পারে। এখন তারপর শহরের বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা আমার পক্ষে জানা একেবারেই সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: আচ্ছা এই যে দর্শক যেটা বেড়েছে বলছেন সেটাকে কি আপনি মোটামুটিভাবে বোদ্ধা মানে ছবি ভালোবাসেন, বুঝতে চান...
সত্যজিৎ রায়: সেই শ্রেণীর দর্শক সংখ্যা বেড়েছে। সেটা বেড়েছে অবশ্যই। তবে তার পাশাপাশি বুদ্ধিহীন দর্শক যে একেবারে কমে গেছে তা নয় কারণ কাগজে চিঠিপত্র থেকে অনেক সময় বুঝতে পারি যে এখনও সেরকম দর্শক বহু আছে। কিন্তু আমার মনে হয় কিছুটা ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টের জন্য এবং কিছুটা এ ধরনের ভালো ভালো ছবি দেখানোর জন্য কিছু সংখ্যক দর্শক আছে যারা ভালো ছবি, সিরিয়াস্ ছবি দেখতে প্রস্তুত।
প্রশ্ন: আমারও পরের প্রশ্ন সেই বিষয়ে– এই ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট আমাদের এখানে যথেষ্ট এফেক্টটিভলি এগিয়ে যাচ্ছে কি?
সত্যজিৎ রায়: আমার তো বছরে একটা করে ছবি, কাজেই আমার ছবি দিয়ে বিচার করতে গেলে বছরে একবার করে মাত্র সুযোগ পাই এই মুভমেন্টের ট্রেন্ডটা বোঝবার।
প্রশ্ন: না মানে সমষ্টিগতভাবে যদি বিচার করেন, অন্যান্য যেসব প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে...
সত্যজিৎ রায়: বহু নতুন ছবি তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে যেগুলো বাজারে এখনও দেখানোই হয়নি। তাছাড়া সব জিনিসটা তো পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। যেমন ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যাপারটা, দেখানোর ব্যাপারটা। এসবই ছবি তৈরির সঙ্গে ভীষণভাবে ইন্টারলিঙ্কড। আমার মনে হয় যারা এইসব সিরিয়াস ছবি তৈরি করছে তাদের ছবি দর্শকদের সামনে উপস্থিত করা খুব দরকার। যদ্দিন না সেটা হচ্ছে এবং বেশ ব্যাপকভাবে হচ্ছে তদ্দিন সেটা বিচার করবারও সুযোগ কোনোরকম পাওয়া যাবে না। দর্শক শ্রেণী কি রকম তৈরি হল সেটা বোঝারও কোনও উপায় নেই।
প্রশ্ন: এই প্রসঙ্গেই তাহলে জানতে চাইব যে তরুণ যেসব পরিচালক নতুন নতুন ছবি তৈরি করছেন এবং যেটাকে বলা চলে এক ধরনের রাজনীতি সচেতন এবং রাজনীতি নির্ভর সিনেমা, এঁদের কেউ কেউ আবার কমিটেড সিনেমার কথাও বলে থাকেন, সে বিষয়ে আপনি কিভাবে ভাবছেন। আপনার কি কালচারাল কনফ্রনটেশনের ব্যাপার এটাও এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি করছে যেখানে মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিত শহুরে মধ্য এবং উচ্চবিত্ত দর্শকের মধ্যেই গোটা ব্যাপারটা ঘোরাফেরা করছে ?
সত্যজিৎ রায়: আমার তরুণ পরিচালকদের মধ্যে একজন এখানে উপস্থিত আছে কিন্তু (তার সামান্য আগে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এসেছেন এবং তাঁকে দেখিয়েই সত্যজিৎ বাবু কথাটা বলে একটু হাসলেন) কাজেই আমার পক্ষে বলা খুবই মুস্কিল এখন। তবে এটা অত্যন্ত আশাজনক এবং আমরা সকলেই এইসব প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে আমি ওই কথাটাই বারবার করে বলতে চাই যে তাদের ছবি যথেষ্ট ব্যাপকভাবে দেখানোর সুযোগটা যতদিন না হচ্ছে ততদিন এই ইমপ্যাক্ট বিচার করবার কোনও উপায় নেই। এই কাজটা করতেই হবে এবং সেটাও তারা করতে পারবে না, সেটা সরকারের তরফ থেকে করতে হবে নতুন সিনেমা হাউস করে বা ডিসট্রিবিউটরদের মধ্যে এমন কয়েকজনের প্রয়োজন আছে যাঁদের সাহস এবং উত্সাহ থাকবে এ ধরণের ছবি দেখাবার। তারপর ছবি চলবে কি চলবেনা সেটা তো ছবির ওপর নির্ভর করে, সেটা একমাত্র ছবির ওপরেই নির্ভর করে।
প্রশ্ন: মানে আপনি এখন মনে করছেন যে এটা এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি করছে?
সত্যজিৎ রায়: না, সেটা বিচার করবার এখনও সময় আসেনি।
প্রশ্ন: ‘সদ্গতি’ সম্পর্কে ভারত সরকারের এক মাননীয় মন্ত্রীর মন্তব্যে আপনি অত্যন্ত বিরক্তি এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এ নিয়ে নানা মহলে অনেক চর্চাও হয়ে গেছে। সম্ভবত উৎপলেন্দু বাবুকে আপনি এ বিষয়ে বলেছিলেন। তা এইসূত্রে কেউ কেউ বোধহয় মনে করছেন যে আপনার স্ট্যান্ডের হয়ত কিছুটা পরিবর্তনও হয়ে থাকবে। একটু খুলে বলবেন কি?
সত্যজিৎ রায়: স্ট্যান্ড মানে এটা আমার দিক থেকে খানিকটা রাগেরও কথা ছিল। একজন এরকমভাবে বার বার বলবে যে দারিদ্র্য সম্বন্ধে সদ্গতি ধরনের ছবি করা উচিত নয় যেখানে দারিদ্র্য হচ্ছে আমার দেশের সমাজ জীবনে সবচেয়ে বড় একটা ফ্যাক্ট। কাজেই আমার মনে হয়েছে যে সে সম্বন্ধে ছবি করা উচিত। যেহেতু মন্ত্রী বলেছেন যে করা উচিত নয় তাই সেটাকে কনফ্রন্ট করতে হলে কাজটা করে দেখতে হবে কদ্দুর কি যায়।
প্রশ্ন: হ্যাঁ, আপনি বোধহয় বলেছেন যে আপনার পজিশনে, আপনার পক্ষে...
সত্যজিৎ রায়: হয়ত আমার পক্ষে রাস্তাটা দেখানো সম্ভব। অন্যরা অনেকেই এখনও সে জায়গাটাতে আসেনি এবং আমি যদি করে দেখাই তাহলে তারা তখন সেইটে ফলো করতে পারবে। আমরা যারা বেশ কিছুকাল ধরে কাজ করছি এবং যাদের মোটামুটি একটা প্রতিষ্ঠা মতো হয়েছে তারা যদি জোরের সঙ্গে এ ধরণের জিনিসটা করে দেখায় তাহলে তরুণদের সুবিধা হতে পারে।
প্রশ্ন: এবং সামগ্রিকভাবে আপনি মনে করেন যে ধরনের কনফ্রনটেশনের সুযোগ যে একেবারেই নেই তা ঠিক নয়?
সত্যজিৎ রায়: হ্যাঁ, সুযোগ একেবারেই পাওয়া যাবে না কিংবা জোর করে করতেই দেওয়া হবে না এটা ঠিক নয়।