কাঁচা খাবার রান্না করা শুরু হয়েছিল ঠিক কবে থেকে? যে রহস্য লুকিয়ে ভারতের রান্নার ইতিহাসে
Ancient India's food culture : সবজি, মশলা অথবা রান্নার আধার সব কিছুই নির্ভর করে কোনও রান্নার স্বাদের নেপথ্যে, জানেন ভারতে আজ যে রান্নার চল রয়েছে তার আসল ইতিহাস?
“আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না।
ইস্তাম্বুল গিয়ে জাপান কাবুল গিয়ে
শিখেছি সহজ এই রান্না..”, মান্না দে’র কণ্ঠে এই গান আজও কানে বাজে। সেই সুর, সেই ছন্দ যেন রান্নার গুরুত্ব নিমেষে বাড়িয়ে তোলে। রান্নাও হল এক ধরনের শিল্প, নাচ, গান, কবিতা, আঁকার মতোই এতেও যত্নের প্রয়োজন, প্রয়োজন জানা বেশ কিছু পদ্ধতির, তবেই স্বদযশে বশ মানানো সম্ভব। কিন্তু ভজহরি মান্না যেমন এদেশ বিদেশ ঘুরে ঘুরে রান্না শিখেছেন, তেমন রান্নার কথা নয়, এই প্রতিবেদনে বলা হবে ভারতীয় রন্ধন শৈলীর কথা।
রান্নার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও অনেক অনুষঙ্গ। সবজি, মশলা অথবা রান্নার আধার সব কিছুই নির্ভর করে কোনও রান্নার স্বাদের নেপথ্যে। বিবিধের মাঝে যে মহা মিলনের কথা বারবার বলা হয় ভারতের প্রসঙ্গে তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এ দেশের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ঐতিহ্য এবং শিল্পশৈলীর যোগাযোগ। ভারতীয় রান্নার স্বাদ বলতে মূলত কয়েকটি আলাদা আলাদা ধরনের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা - মিষ্টি, নোনতা, টক, ঝাল, তিক্ত বা তেঁতো। প্রতিটি স্বাদের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে কোনও না কোনও খাবারের বিশেষত্ব। যেমন ধরা যাক, প্রথম পাতে তেঁতো এবং শেষ পাতে মিষ্টি এটাই মেনে ছোলা হয়। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের খাবারের মধ্যে রয়েছে কোনও না কোনও স্বাদের বিশেষত্ব।
আরও পড়ুন - মজেছিলেন আকবর থেকে রানি ভিক্টোরিয়া! খিচুড়ির অবাক করা ইতিহাস আজও অজানাই
প্রাচীন ভারত থেকে রান্না নিয়ে একটা সাধারণ রূপরেখা আঁকা রয়েছে। ভারতের উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ এবং পশ্চিমী রান্না, এই চারটি প্রধান আঞ্চলিক শৈলী লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর ভারত মানেই সেখানে মোঘল আধিপত্য ছিল প্রাচীন কালে, ফলে রান্নাতেও সেই ঐতিহ্য বহাল থেকেছে। তারই রান্নায় প্রথম জাফরানের ব্যবহার করেন। ঝোল জাতীয় রান্নাকে আরও থকথকে করতে খাঁটি ক্রিম, বাদাম, চারমগজ অথবা পোস্ট জাতীয় জিনিসের যে ব্যয়ভার আজকাল রান্নায় হামেশাই দেখা যায় তার শুরুটাও ইয় উত্তর ভারতের রান্নার হাত ধরেই। ঠিক যেমন নান বা রুটি জাতীয় খাবার এসেছে আফগান সংলগ্ন এলাকা থেকে। যদিও আজকাল ভারতের খাবারের তালিকা দেখলে বোঝা যায় না আলাদা করে, সর্বত্রই মিলেমিশে গিয়েছে বিভিন্ন খাবার।
দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের মধ্যে মূলত চাল এবং নারকেল থাকে। দক্ষিণ ভারতে যারা থাকেন তারা চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি খাবার খেতে বেশি পছন্দ করেন। এখানে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে চাল থেকে প্রস্তুত বিভিন্ন কিছু। এখানে নিরামিষ এবং আমিষ দুই ধরনের খাবারের প্রচলনই লক্ষ্য করা যায়। অপরদিকে পশ্চিম ভারতের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক খাবারের একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলের খাবারের তালিকায় সামুদ্রিক খাবার গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তার কারণ অবশ্য সমুদ্রের অবস্থান। এখনকার আদিবাসীদের কাছে সহজলভ্য ছিল সমুদ্রের মাছ এবং বন থেকে আহরণ করা ফুল ফল মধু মূল ইত্যাদি ফলে তাদের খাবারের মধ্যে যে এগুলির প্রাধান্য বেশি লক্ষ্য করা যাবে সেটাই স্বাভাবিক।
প্রাচীন পুঁথি ঘেঁটে ধারণা করা যায়, মূলত হরপ্পা যুগে ভারতীয় খাবারের ইতিহাস শুরু হয়েছিল। এর আগে রান্না করা খাবার খেত না আদিম গুহাবাসী মানুষ। এই সময়ে, প্রতিদিনের থালাগুলিতে প্রধান কিছু উপাদান রাখা হতো। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ছোলা, চাল, গম, মুসুর এবং বাজরার মতো কিছু শষ্য। এছাড়াও সেসময় খাবারের সঙ্গে ফলের রস এবং দারুচিনি ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমদিকে এই সব সবজি মূলত সিদ্ধ আকারে খাওয়া হতো। পরবর্তীতে অভীষ্ট আফগানি সংস্কৃতির আগমনে গম থেকে রুটি বা নান জাতীয় পদ তৈরির অরিচন শুরু হয় ভারতেও। ফলে ভারতে ব্যবহৃত এই খাবার, রান্নার পদ্ধতি এবং উপাদানগুলি ধারাবাহিক ভাবে একটা বিবর্তনকে চিত্রিত করে।
আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে ভারতীয় রান্নাঘরে মিশেছে বিভিন্ন দেশের প্রভাব। যখন যেসব দেশ থেকে এদেশের বিভিন্ন জায়গায় উপনিবেশ স্থাপন করেছেন অন্যান্য দেশের মানুষেরা তখন তাদের সঙ্গে করে এদেশে এসেছে সে দেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং খাদ্যাভ্যাসও। ফলে ভারতের রান্নাঘরে মিলেমিশে গিয়েছে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, পার্সিয়ান সহ আরও অনেক দেশের খাবারের স্বাদ।
আরও পড়ুন - খাঁ খাঁ করছে রেস্তোরাঁ, সন্ত্রাসবাদের আঁচ জাপানের জনপ্রিয় সুশি খাবার নিয়ে! কী আসল রহস্য?
এছাড়া ভারতকে বলা হয় মশলার সাম্রাজ্য। “মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বক্তৃতায় ভারতকে মশলার দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, স্বর্গ দ্বারা সুগন্ধি,” পণ্ডিত জেমস ম্যাকহাগ লিখেছেন স্যান্ডালউড এবং ক্যারিয়ন: ভারতীয় খাদ্য ও সংস্কৃতিতে গন্ধ (২০১২)।ফলে একদিকে ফল শাক-সবজির প্রাচুর্য অন্যদিকে মসলার প্রাচুর্য তার সঙ্গে রয়েছে সামুদ্রিক মাছ মাংস এবং দুগ্ধজাত পদার্থ ফলত ভারতবর্ষের রান্নার ধারায় প্রাচীনকাল থেকেই ছিল নিজস্ব ঐতিহ্য। যা সময়ের সঙ্গে আরও আরও আধুনিক হয়েছে। তার সঙ্গে মিশেছে নতুনত্ব। দুই আলাদা স্বাদের মিশ্রণে আজকাল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কুইজন।
তবে এই এতো আলোচনার শেষ পাতে একটু মিষ্টির কথা না বললে আদতে অসম্পূর্ণ থেকে ভারতীয় খাবারের ইতিহাস। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিষ্টির যোগ বেশি থাকলেও ভারতের ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছে মিষ্টি খাওয়ার প্রসঙ্গ। ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি মতিচূর লাড্ডু। বয়স প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি। আধুনিক সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স মাত্র দুই-আড়াই'শ বছর। এমনকী এই যে ছানার মিষ্টির চল এখন, সেটিও বাঙালিরা তৈরি করতে শিখেছে পর্তুগিজদের থেকে। তাদের কাছ থেকে বাঙালি ময়রারা ছানা ও পনির তৈরির কৌশল শেখে। ফলে তেঁতো থেকে শুরু করে মিষ্টি মুখ ভারতীয় খাবারের সব পদে রয়েছে একটা মিলনের প্রতিচ্ছবি। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলে যা মুখে মুখে ঘুরছে আজও।