'অটল মুখোশ মাত্র!' এক চিঠিতেই বিজেপির 'কম্পিউটার ম্যানে'র জীবন শেষ করেছিলেন বাজপেয়ী
Atal Bihai and K. N. Govindacharya: দরজায় টোকা না মেরেই সটান দরজা খুলে ঢুকে পড়েন এক ব্যক্তি। দাঁতে দাঁত চেপে আডবাণীকে জিজ্ঞেস করলেন, "কেন করলেন আপনি এরকম?"
১৯৯৫ সাল। প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের উপর একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ এসে পড়ছে। হর্ষদ মেহতা স্ক্যাম, রাম মন্দির আন্দোলন, বাবরি মসজিদ-সহ যাবতীয় ঘটনা কংগ্রেসের বিদায় বেলার সংকেত দিচ্ছে। দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে উঠে আসছে বিজেপি। এই আবহে ১১ থেকে ১৩ নভেম্বর মুম্বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে বিজেপি। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১২ তারিখ মুম্বইয়ের দাদরের শিবাজি পার্কে সুবৃহৎ একটি জনসভা হয় বিজেপির। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলি মনোহর জোশী, প্রমোদ মহাজন-সহ প্রথম সারির নেতারা। সবার বক্তব্য শেষে, ভাষণ দিতে উঠলেন বিজেপির তৎকালীন সভাপতি লালকৃষ্ণ আডবাণী। নিজের ভাষণে প্রথমে পার্টির যাবতীয় উপলব্ধি নিয়ে কথা বলে শেষে করলেন এক ঘোষণা। ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “সময় এসে গিয়েছে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করার। আমি আপনাদের অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।” গোটা মঞ্চে সবাই অবাক! আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তরফ থেকে আডবাণীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার নির্দেশ ছিল। মঞ্চে এবং জনসভায় উপস্থিত সবাই তাই-ই জানতেন। আডবাণীর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা শিবাজি পার্ক। কিছু মুহূর্তের নিস্তব্ধতা এবং তারপর পার্ক জুড়ে কান ফাটানো চিৎকার- “অব কি বারি, অটল বিহারী!”।
আডবাণী নাম ঘোষণা করে এসে বসার পর অটল বিহারী বাজপেয়ী জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেন এরকম করলেন? আমার নাম ঘোষণা করার আগে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন।” আডবাণী হেসে জবাব দিয়েছিলেন, “জিজ্ঞেস করলে আপনি থোড়াই রাজি হতেন।” আসলে নিজের নাম পিছিয়ে নিয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নাম এগিয়ে দেওয়ার পিছনে একটি সুচতুর রাজনৈতিক চাল ছিল আডবাণীর। রাম মন্দির আন্দোলনের ফলে দেশজুড়ে তাঁর ছবি হয়ে গিয়েছিল এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতার। দেশের ক্ষমতায় বসতে হলে প্রয়োজন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সর্বজনপ্রিয় এক নেতার। আডবাণীর সমকক্ষ এমন একজনই নেতা ছিলেন বিজেপিতে, তিনি অটল বিহারী বাজপেয়ী। যাইহোক, জনসভার পর মুম্বইয়ে নিজের হোটেলে ফিরে যান সকলে। রাতে হোটেলে নিজের ঘরে বসেছিলেন আডবাণী। দরজায় টোকা না মেরেই সটান দরজা খুলে ঢুকে পড়েন এক ব্যক্তি। তাঁর চোখে-মুখে ফেটে পড়ছে রাগ। দাঁতে দাঁত চেপে আডবাণীকে জিজ্ঞেস করলেন, "কেন করলেন আপনি এরকম?" জবাবে আডবাণী জানান, ভোটে জিততে হলে এটাই করা দরকার ছিল। এই ব্যক্তি ছিলেন সেই সময় বিজেপির সংগঠন মহাসচিব কে এন গোবিন্দাচার্য।
আরও পড়ুন- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?
১৯৪৩ সালের ২ মে হিমাচল প্রদেশে জন্ম হয় কোড়িপাক্কম নীলমেঘাচার্য গোবিন্দাচার্যের। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। নিজের স্নাতকোত্তর করেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রকৃত অর্থে ছিলেন পণ্ডিত, কম্পিউটারের মতো প্রখর মস্তিষ্ক তাঁর। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে প্রথমে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে জুড়ে যান এবং তারপর ১৯৮৮ সালে বিজেপিতে যোগ দেন। তাঁর মস্তিষ্ক কতটা প্রখর ছিল, তা জানা যায় একটি ঘটনা থেকে। ১৯৮৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে জনতা দলের সঙ্গে সরাসরি জোট না বাঁধলেও, এক প্রকার 'ট্যাক্টিকাল অ্যালায়েন্স' করেছিল বিজেপি। উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের ভোট সবচেয়ে কম যতটা কাটা যায়। এই নিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বৈঠক করতে যান বিজেপির নেতাদের সঙ্গে দিল্লির অশোক রোডের অফিসে। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন গোবিন্দাচার্য। মিটিং শেষে বেরিয়ে ভিপি সিং সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, “কম্পিউটার মশাই, কম্পিউটার! কোন লোকসভা নির্বাচনে কোন জায়গা থেকে কয়টি আসন এসেছিল, কোন আসনে কী ধরনের জাতি সমীকরণ, কোন বিধানসভা এলাকায় কোন পার্টির দৌরাত্ম্য, সব কণ্ঠস্থ মানুষটার।” এই ‘মানুষটা’ আসলে ছিলেন গোবিন্দাচার্য। সেবার গোবিন্দাচার্যের স্ট্র্যাটেজি মেনেই আসন ভাগাভাগি করেছিল বিজেপি এবং জনতা দল। তাঁর দুর্দান্ত কৌশলের কারণেই হিন্দির হার্টল্যান্ডে দাঁত ফোটাতে পারেনি কংগ্রেস। এই ঘটনার পরেই তাঁকে বিজেপির সংগঠন মহাসচিব ঘোষণা করা হয়।
বিজেপিতে যোগ দেওয়ার প্রথম থেকেই অটল বিহারী বাজপেয়ীর বিরোধী ছিলেন গোবিন্দাচার্য। তিনি আসলে ছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণীর ঘনিষ্ঠ। বাজপেয়ী এবং গোবিন্দাচার্যের বিরোধ সকলের সামনে চলে আসে ১৯৯৩ সালে। রাম জন্মভূমি আন্দোলন এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থান- সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলিকে বরখাস্ত করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সেই সময় লোকসভায় বিরোধী দলনেতা ছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, তিনিও সেই পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। এরপর লোকসভার বিরোধী দলনেতা হন অটল বিহারী বাজপেয়ী। এই ঘটনার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন গোবিন্দাচার্য। শান্ত, সৌম্য স্বভাবের বাজপেয়ী, গোবিন্দাচার্যের প্রতি এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমে নাম করেই বলে দেন, “গোবিন্দাচার্যের থেকে জানতে চাই, কোনও নেতার প্রশংসা করার জন্য অন্য কোনও নেতাকে অপমান করা কি খুবই জরুরি?” কিন্তু সেই সময় দু'পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করিয়ে দেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। ১৯৯৫ সালের নভেম্বরের ওই ঘটনা কানে যায় অটল বিহারী বাজপেয়ীর। কিন্তু বাজপেয়ী তখন চুপ করে যান। দিল্লিতে সেই সময় ক্ষমতার হস্তান্তর হচ্ছিল, অন্তর্বিরোধ হলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা মুশকিল হবে! এরপরে কী হয়েছিল তা সকলেরই জানা।
আরও পড়ুন- বান্ধবীর মেয়েকে দত্তক! বাজপেয়ী আর ‘মিসেস কৌলে’র বন্ধুত্বের যে রসায়ন রইল অজানাই
১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে চলে আসা যাক ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দিল্লিতে ইন্দ্র কুমার গুজরালের সরকার নিজের শেষ সময় গুনছে। দেশে নতুন নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যখন তখন লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাবে। হলোও তাই। সেই সময় সারা দেশে বিভিন্ন সমীক্ষা স্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছিল, দেশে আবার কমল ফুটতে চলেছে। সারা দেশবাসীর পাশাপাশি বিদেশেরও রাজনায়কদের নজর অটল বিহারী বাজপেয়ীর উপর। সেই সময় বিদেশি রাজনায়করা প্রায়শই বিজেপির নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। সেই সময় গোবিন্দাচার্যরও বিজেপিতে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান ছিল। আরএসএস এবং সংগঠন দুইয়েরই চোখের মণি ছিলেন তিনি। মণ্ডলের পাল্টা কমণ্ডলকে খাড়া করতে তিনি দেশজুড়ে বিভিন্ন অনগ্রসর জাতির হিন্দু নেতাদের তুলে আনেন। কল্যাণ সিং, উমা ভারতীর মতো নেতাদের উত্থান তাঁর কারণেই। সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর তাঁর ছিল দারুণ দখল ছিল। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, এমনই কয়েকজন ব্রিটিশ কূটনীতিক সাক্ষাৎ করতে আসেন গোবিন্দচার্যের সঙ্গে। ৬ অক্টোবর সারা দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে একটি চাঞ্চল্যকর খবর সামনে আসে। সকলেই দাবি করেন, ওই কূটনীতিকদের সামনে গোবিন্দাচার্য নাকি বলেছেন, “আডবাণীর উপর ফোকাস করুন। অটল মুখ নয়, মুখোশ মাত্র।” সংঘের অত্যন্ত কাছের ছিলেন গোবিন্দাচার্য। তাঁর এহেন বক্তব্য সামনে আসতেই তোলপাড় হয়ে যায় গোটা দেশ।
অটল বিহারী বাজপেয়ী সেই সময় ছিলেন বুলগেরিয়া সফরে। তাঁর কানেও পৌঁছয় খবরটি। ভারতে ফিরে তিনি লালকৃষ্ণ আডবাণীকে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠিতে তিনটি মাত্র লাইন লেখা ছিল- “শ্রীগোবিন্দাচার্যের সাক্ষাৎকারটি পড়লাম। আশা করি আপনিও পড়েছেন। বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা দেবেন।” চিঠিটি ফাঁসও হয়ে যায় সংবাদমাধ্যমে। এই চিঠির মাধ্যমেই গোবিন্দাচার্যের রাজনৈতিক বধের পটভূমি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আডবাণীকে চিঠি লেখার পরেই গোবিন্দাচার্যকে একটি শো-কজ লেটার পাঠান বাজপেয়ী। এখানেই তিনি থামেননি। কয়েকদিন পর একটি পুস্তক উন্মোচনে গিয়ে হাসতে হাসতে বলেই দেন, “আজকাল খুব অস্বস্তি হয় যখন কেউ ভাষণ দিতে ডাকে। একটা মুখোশ আর কত কথাই বা বলতে পারে।” দু’দিন পর ভারতীয় যুব মোর্চার একটি অনুষ্ঠানেও তাঁকে বলতে শোনা যায়, “কাউকে প্রধানমন্ত্রী কোনও দল বানায় না, জনতা বানায়।” বিজেপি এবং আরএসএসকে সাফ সংকেত দিয়ে দেন বাজপেয়ী, গোবিন্দাচার্যের প্রস্থান হতেই হবে। গোবিন্দাচার্য যদিও নিজের সাফাইতে জানান (এবং আজও দাবি করেন) যে তিনি মুখ এবং মুখোশ নিয়ে ওই মন্তব্যটি করেননি। অটল এবং আডবাণী তাঁর কাছে রাম-লক্ষণের সমান। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও আর শেষরক্ষা হয়নি। ধীরে ধীরে তিনি পার্টিতে দুর্বল হতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজের সংগঠন মহাসচিব পদটিও খোয়ান। ইতিমধ্যেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হন অটল বিহারী বাজপেয়ী। ২০০০ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং বিজেপিকে চিঠি লিখে দু'বছরের অধ্যয়ন অবকাশে চলে যান গোবিন্দাচার্য। সেই থেকে আজ পর্যন্তও তাঁর আর ফেরা হয়নি বিজেপিতে। তাঁর একটি মন্তব্য এবং এর প্রেক্ষিতে বাজপেয়ীর একটি চিঠি, এতেই চিরতরে ‘শাট-ডাউন’ হয়ে যান বিজেপির ‘কম্পিউটার’ গোবিন্দাচার্য।