দিয়েছিলেন বিসমিল্লা খানকে টেক্কা, প্রথম মহিলা সানাইবাদক বাগেশ্বরী যেন সুরের সরস্বতী
Bageshwari Qamar: প্রথম মহিলা সানাইবাদক হিসেবে দুনিয়ার সামনে উঠে এলেন বাগেশ্বরী কামার।
বংশের পরম্পরা রক্ষার ভার যেমন ভাবে ছেলেদের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়, তেমন করে বর্তায় না সংসারের কন্যাসন্তানটির কাঁধে। কারণ, বেটিয়া যে পরায়া ধন, তা তো জানা কথাই। তাই এই খোপ থেকে ওই খোপ, ওই খোপ থেকে সেই খোপ ঘুরেই জীবন কেটে যায় মেয়েদের। বাপ-দাদাকে বংশপরম্পরায় যে কাজ করে আসতে দেখেছে মেয়ে, সেই কাজ করার সাধ তো হতে পারে তাঁরও। কিন্তু তখনই এসে পড়ে বাঁধার পাহাড়। তুমি মেয়ে, ক্রিকেট খেলবে কেন? গাড়ি চালাবে কেন? সানাই বাজাবে কেন? সংসারের যা কিছু কাজের গায়ে 'ছেলেদের' লেবেল সাঁটানো, তা অর্জন করতে কম লড়াই করতে হয়নি মেয়েদের।
বাপদাদাদের দেখে দেখে ছোট থেকে বড় হয়েছে মেয়েটি। অথচ পুরুষপ্রধান এই জগতে তার প্রবেশাধীকার স্বীকার করেননি খোদ বাবাই। পুরনো দিল্লির ইদগাহ রোডের বাড়িতে রোজ ভোর হত সানাইয়ের শব্দে। বাজাতেন বাবা জগদীশ প্রসাদ কামার। কয়েক প্রজন্ম ধরে ওই বাড়িতেই বাস কামার পরিবারের। শুধু বাবা নন। দাদু দীপ চাঁদ ছিলেন বিশ শতকের নামী সানাইবাদক। তবে সেসময় সানাইয়ের তেমন মানমর্যাদা ছিল না। বিয়ে-অনুষ্ঠানে নহবত বসা, যাত্রাপালায় বাজানো- ওই পর্যন্তই। কিন্তু ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারায় তেমন দর ছিল না এই বাদ্যযন্ত্রটির। তবে সেই সব সমীকরণ বদলে দিয়েছিলেন একটি মানুষ। তিনি পণ্ডিত বিসমিল্লাহ খান। তখনও ধর্মীয় মেরুকরণের বিষবাষ্প তেমন করে ছোঁয়নি এ দেশকে। তাই বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দিরের সানাইবাদকের দিকে আঙুল তোলার ধৃষ্টতা দেখাননি কেউ। বরং কীভাবে যেন সানাই আর তিনি যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন গোটা ভারতবর্ষের কাছে।
আরও পড়ুন: বাইজি গলি থেকে মুম্বই শাসন! ভারতের প্রথম দুই মহিলা সুরকারকে ভুলেছে সিনেমা
সেই বিসমিল্লা খানের ছাত্র ছিলেন জগদীশ প্রসাদ। সেই বাবার মেয়ে হয়ে সানাই থেকে দূরে থাকতে পারেননি বাগেশ্বরীও। বছর ছয়েকের মেয়ের থেকে উচ্চতায় বোধহয় বেশ খানিকটা বড়ই ছিল সানাইটা। তার উপর সানাই বাজানো মোটেই সহজ কাজ নয়। ফুঃ দিয়ে বাজানোর যন্ত্র বলে কথা, দমের দরকার হয় প্রচুর। একদিন বাবাকে গিয়ে বসে বসলেন নিজের ইচ্ছের কথা। শুনেই রে রে কর উঠলেন জগদীশ কুমার। সানাই বাজানো কি আবার মেয়েদের কাজ নাকি! মুখ ছোট করে ফিরল মেয়ে।
কিন্তু হাল ছাড়ল না। মায়ের প্রশ্রয়ে চলল তাঁর একা একা সানাই শেখার ক্লাস। রেওয়াজ থামাননি বাগেশ্বরী। বছর তিনেক পরে মেয়ের বাজনা কানে গেল বাবার। চমকে উঠলে জগদীশ কুমার। দাঁড়ালেন না এক মুহূর্তও। মেয়েকে নিয়ে চললেন ওস্তাদজির কাছে। একরত্তি মেয়ের অমন সানাইয়ের হাত দেখে তো অবাক স্বয়ং বিসমিল্লা খানও। এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলেন সানাইসম্রাট। পুরনো দিল্লির বাড়ি ছেড়ে গুরুজির কাছে নাড়া বাঁধলেন বাগেশ্বরী। বারাণসীকে বিসমিল্লা খানের বাড়িতে থেকেই শুরু হল প্রশিক্ষণ।
হাতে যেন চাঁদ পেলেন বাগেশ্বরী। এ যেন এক স্বপ্নপূরণ। বাপ-দাদা যে পেশায় ছিলেন, ছোটবেলা থেকে যে সানাইয়ের মর্মর স্বরে ঘুম ভেঙেছে বাগেশ্বরীর, সেই সানাই শেখার সুযোগ মিলল তাঁর। তা-ও আবার খোদ সানাইয়ের ঈশ্বরের কাছ থেকে। অল্পদিনের মধ্যেই ওস্তাদজির প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠলেন বাগেশ্বরী। যতদিন বিসমিল্লাহ খান বেঁচে ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন বাগেশ্বরী। তাঁর হাত দিয়েই মেয়েদের সামনে খুলে গেল এক অনালোকিত জগৎ। ১৯৮৩ সালে প্রথমবার বাগেশ্বরীকে মঞ্চে বাজানোর অনুমতি দিলেন ওস্তাদজি। সেই কনসার্টটি ছিল সমস্ত মহিলা বাদ্যকারদের নিয়ে। সেখানে প্রথম মহিলা সানাইবাদক হিসেবে দুনিয়ার সামনে উঠে এলেন বাগেশ্বরী কামার। বাগেশ্বরী শব্দের অর্থ দেবী সরস্বতী। সত্যিই দেবী বসবাস করতেন তাঁর বাদ্যে।
সানাই বাজাতে শ্বাসযন্ত্রের অনেক জোর লাগে। লাগে দম। এই কথাটাই ছোট থেকে শুনে এসেছেন বাগেশ্বরী। আর সে কারণেই সানাই বাজাতে নাকি সচরাচর এগিয়ে আসেন না মেয়েরা। আর সেই ট্যাবুটাই গোড়া থেকে ভাঙার চেষ্টা করেছেন বাগেশ্বরী। আর তাতে যে শুধু তিনি সফল হয়েছেন তা-ই নয়, রীতিমতো টক্কর দিয়েছেন খোদ সানাই সম্রাটকেও। একবার পণ্ডিতজি ঠিক করলেন, বাগেশ্বরীর সঙ্গে যুগলবন্দির আসর করবেন তিনি। লোকজন রে রে করে উঠল। মেয়ে হয়ে খোদ বিসমিল্লা খানের সঙ্গে সানাইয়ে টক্কর! তবে সে সব কথা কানে তুললেন না গুরুজি। যথাসম যথা সময়ে বসল যুগলবন্দির আসর। সেখানে বাগেশ্বরী যে শুধু দুর্দান্ত বাজালেন তাই নয়, রীতিমতো গুরুজিকে টক্করও দিলেন তিনি।
ক্রমশ ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঘরানায় উঠে আসছিল বাগেশ্বরীর নাম। নানা মহলে সমাদর পাচ্ছিলেন তিনি। যে বাবা একদিন মেয়েকে সানাইয়ের পাঠ দিতে অস্বীকার করেছিলেন, তিনি হয়ে উঠলেন বাগেশ্বরীর সব চেয়ে বড় ভক্ত। পাছে বিয়ের পর সংসারের চাপে মেয়ের সানাইয়ে বাধা পড়ে, ভয়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত পাঠাতে চাইলেন না জগদীশ কুমার। 'বেটিয়া পরায়া ধন', সমাজের তৈরি এই ধারণাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে জামাইকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। মেয়ের সানাইয়ের কেরিয়ারে ছেদ পড়ল না এতটুকু। বরং ভক্ত এবং পাশে থাকার মানুষদের তালিকায় জুড়ে গেল আরও একটা নাম। বাগেশ্বরীর সমস্ত সিদ্ধান্তে বরাবর পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী।
আরও পড়ুন: কনসার্ট থেকে বিয়েবাড়ি- নেই সেই আবাহন, হারিয়েই যাবে বিসমিল্লার ‘পাগলা’ সানাই?
কোনও প্রথমের পথই সহজ হয় না তেমন করে। সহজ ছিল না বাগেশ্বরীর জন্যেও। নারী-পুরুষ সমানের পাঠ বা অর্ধেক আকাশের ভাবনা তখন দূরের গ্রহ। এখনও কি আদতেই কিছু বদলেছে। তবে সেই সময় মেয়ে হয়ে প্রথা ভাঙার কাজটা বলাই বাহুল্য ছিল আরও কয়েক গুণ কঠিন। সেই পাহাড়টা ডিঙোলেন বাগেশ্বরী। তবু দুনিয়া তেমন করে চিনল না তাঁকে। রেকর্ড, ক্যাসেড, সিডি বা কনসার্টের আলো থেকে তিনি দূরে। কারণ নিজের শিল্পকে প্রমাণের দায় তাঁর নেই কারওর কাছে। বারবার জানিয়েছেন, তিনি এক এবং কেবলমাত্র নিজের শিল্পের কাছেই দায়বদ্ধ। নতুন জমানার সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে গেলে হয়তো অনেকক্ষেত্রেই সমঝোতা করতে হবে। সমঝোতা করতে হবে নিজের শিল্প এবং গুরুজির তালিমের সঙ্গেই। আর সেখানেই তাঁর আপত্তি। তাই বাকিজীবনটাও নিজস্ব সুরের জগতেই মেতে রইলেন বাগেশ্বরী।
বিয়ের নহবত উঠে গেছে আজ। কাজ চলে যায় রেকর্ডেই। সানাইশিল্পীদের প্রয়োজন তাই নেই বললেই চলে। অনেকেই রুজির টানে ছড়িয়ে গিয়েছেন নানা পেশায়। সানাই শিখতে চাওয়ার লোকও কম। আশ্চর্যের কথা, বাগেশ্বরীর পর ভারতীয় সানাইয়ের ইতিহাসে তেমন কোনও মেয়ের নাম পাওয়া যায়না। সমস্ত প্রথার বিপরীতে গিয়ে যে দরজাটা একদিন খুলে দিয়েছিলেন বাগেশ্বরী, সেখানে আর কোনও পায়ের ছাপ কেন পড়ল না, তা ভাবতে আজও অবাক লাগে।