দই-চন্দনের ফোঁটাই কেন দিতে হয় ভাইয়ের কপালে

Bhaifota 2022: একটি বিষয় রয়েছে যা বাদ দিলে বাঙালির ভাইফোঁটা উপভোগ করা সম্ভব নয়। তা হলো পেটপুজো।

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই পার্বণগুলির মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় পার্বণ বা উৎসব ভাইফোঁটা। কালীপুজোর পরপর পালিত হয় এই উৎসব। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে পালিত হয় বলে এই উৎসবের নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-ও। বাঙালির শারদ-উৎসবের মরশুমে মোটামুটি এটিই শেষ পর্ব। ফলত মন একটু ভারাক্রান্ত থাকা স্বাভাবিক। তবে সেই বিষণ্ণতাকে দূরে সরিয়ে প্রতি বছর এই উৎসবে মেতে ওঠেন বাংলা তথা ভারতের সমস্ত ভাই-বোন। বাংলায় ভাইফোঁটার সময় দিদিরা এবং বোনরা ভাইদের দই এবং চন্দনের ফোঁটা দেন। বছরে মূলত দু'টি উৎসবের জন্য ভাই-বোনরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। রাখিবন্ধন উৎসব ও ভাইফোঁটা। ভাই-বোনের পবিত্র সম্পর্কে স্নেহের প্রতীক এই ভাইফোঁটা। এই দিন কপালে ফোঁটা পরিয়ে ভাইয়ের দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য, সুখ এবং সমৃদ্ধির প্রার্থনা করেন বোনেরা। অনেকে ভাইফোঁটা দেন প্রতিপদে, অনেকে দ্বিতীয়ায়।

শাস্ত্র অনুসারে বহুদিন যমলোকে কাটানোর পর এদিন নিজের বোন যমুনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন যমরাজ। যমুনা যেমন যমের মঙ্গলার্থে কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন, অনুরূপভাবে বাংলার বোন এবং দিদিরা নিজেদের ভাইয়ের কপালেও ফোঁটা দেন। যমরাজ যেন তাদের ভাইয়ের প্রাণ হরণ না করে নিতে পারেন, তাই তাঁরা ‘যমের দুয়ারে কাঁটা’ দেন। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন চন্দন কিংবা দইয়ের ফোঁটা দেওয়ার চল রয়েছে বাঙালিদের মধ্যে। আবার দেশের অনেক জায়গায় ভাইদের কপালে চালের ফোঁটাও দেওয়া হয়। কাঁসা বা পিতলের থালায় ধান-দুর্বা, ঘরে আমপাতায় পারা কাজল, চন্দন সাজিয়ে রাখা হয় ভাইয়ের সামনে। সঙ্গে থাকে ঘিয়ের প্রদীপ ও শঙ্খ। আর মুখমিষ্টি করানোর জন্য থাকে ভাইয়ের পছন্দের সমস্ত মিষ্টিও। এরপর ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বোনেরা বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলে চাল, কাজল, চন্দন, ঘি প্রভৃতি একত্রিত করে নিম্নোক্ত মন্ত্রটি পড়তে পড়তে তিনবার ফোঁটা দেন।

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,

যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।

যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,

আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥

এরপর শঙ্খ বাজিয়ে পরস্পরকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। তারপর ভাইয়েরা দিদিদের প্রণাম করে কিংবা বোন থাকলে বোনেরা ভাইদের প্রণাম করে এবং আশীর্বাদ নেয়। এরপর ভাইরা বোন বা দিদিদের নিজেদের সাধ্যমতো উপহার দেন। আর এভাবেই বছরের বছর ভারতের প্রতিটা ঘরে ঘরে পালিত হচ্ছে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।

আরও পড়ুন: কে প্রথম প্রচলন করেন ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার? রইল ভাইফোঁটার অজানা কিছু তথ্য

তবে এটি আমাদের সংস্কৃতির অভিনবত্বই বলুন বা সৌন্দর্যই বলুন, এই ভাইফোঁটা ও রাখিবন্ধন উৎসব কিন্তু ভাই-বোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। আমাদের দিদা-ঠাকুমারাও ভাইফোঁটা দেন। এটিই আমাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে সুন্দর দিক, যেখানে ভালবাসা, মায়া, মমতা, স্নেহকে সম্পর্কের ওপরে রাখা হয়।

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা যাক, এই বছরের ভাইফোঁটার সময়সূচি সম্পর্কে। এ-বছর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ভাইফোঁটা পালন করা যাবে ২৬ এবং ২৭ অক্টোবর। পঞ্জিকা অনুসারে, ২৬ অক্টোবর (৮ কার্তিক) অপরাহ্ন ২টো ৪৩ মিনিট থেকে ২৭ অক্টোবর (৯ কার্তিক) অপরাহ্ন ২টো ৪ মিনিট পর্যন্ত দ্বিতীয়া থাকছে। সুতরাং, এই সময়ের মধ্যেই ভাইফোঁটা সম্পন্ন করতে হবে। তবে পুরোহিতদের মতে, যে তিথিতে দুপুরের সময়টা পাওয়া যায়, সেটিই ভাইফোঁটার শুভ সময়। ফলে ২৬ অক্টোবর যেহেতু ২টো ৪৩ মিনিটে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া শুরু হবে, তাই সেইদিন ফোঁটা দেওয়ার শুভ সময় ছিল। যাঁরা ২৭ অক্টোবর ফোঁটা দিচ্ছেন, তাঁরা বেলা ১১টা ৭ মিনিট থেকে ১২টা ৪৫ মিনিট সময়ের মধ্যে ফোঁটা দিতে পারেন। এই সময়টাই সবচেয়ে শুভ।

ভাইফোঁটার সময় কয়েকটি নিয়ম মাথায় রাখা আবশ্যিক।

এই উৎসবে দাদা বা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে তাদের দীর্ঘায়ু এবং মঙ্গল কামনা করেন বোন এবং দিদিরা। ফোঁটা দেওয়ার সময় মাথায় রাখবেন, দাদা বা ভাইয়ের মুখ যেন পূর্ব অথবা উত্তর-পূর্ব দিকে থাকে। তবে ঠাকুরঘরে বসালে যেদিকে সুবিধা, সেইমতো বসিয়ে ফোঁটা দিতে পারেন। তবে একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, মুখ যেন কোনওভাবেই দক্ষিণ দিকে না থাকে। তাহলে অমঙ্গল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ভাইফোঁটা দেওয়ার সময় যে পাত্র বা অন্য বাসন ব্যবহার করা হয়, সেগুলি ধাতুর হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কাঁসা বা পিতল থাকলে তা সবচেয়ে মঙ্গলজনক।

ভাইফোঁটা দেওয়ার সময় দিদি বা বোন এবং ভাই বা দাদা কেউই যেন মাটিতে না বসে, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। একটি সুতির আসনের ওপর বসলে সবচেয়ে ভালো।

ভাইফোঁটা দেওয়ার সময় দিদি বা বোন এবং ভাই বা দাদা উভয়েই স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে, ধৌত বস্ত্র পরে ফোঁটা দিলে এবং নিলে তা মঙ্গলজনক। ভাইদের কপালে চন্দন এবং দইয়ের ফোঁটা দেওয়া হয় কেন? আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে, চন্দন এবং দই আমাদের শরীর ঠান্ডা রাখে। চন্দন আমাদের মনকে একাগ্র করতে সাহায্য করে। উপরন্তু, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী যে-কোনও শুভ কাজে দইয়ের ব্যবহার করা উচিত। সেহেতু দই এবং চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার নিয়ম আছে ভাইদের।

Food of Bhaifota

ভাইফোঁটার মূল আকর্ষণ খাওয়াদাওয়া

একটি বিষয় রয়েছে যা বাদ দিলে বাঙালির ভাইফোঁটা উপভোগ করা সম্ভব নয়। তা হলো পেটপুজো। ভাইফোঁটার বিশেষ আকর্ষণ হলো খাওয়া-দাওয়া। তাই ভাইফোঁটায় দিদি এবং বোনরা সব সময় চেষ্টা করেন ভাইদের সবচেয়ে সেরা জিনিসটি পাতে তুলে দিতে। ফলত দাম যতই চড়া হোক, ভাইয়ের পাতে পছন্দের মাছ তুলে দিতে বাজারে ভিড়। মাছের বাজারে ভিড় চোখে পড়ার মতো। সব দিদিরাই চেষ্টা করছেন ভাইদের পাতে ইলিশ, চিংড়ি, পাবদা তুলে দিতে। এছাড়াও সকাল থেকেই খাসির মাংসের দোকানের বাইরে পড়ছে লম্বা লাইন। আনাজ-পাতির দামও ওপরের দিকেই। সব মিলিয়ে বাজার খানিকটা আগুন তো বটেই। তবে এই উৎসবও তো বছরে একবারই আসে।

আর বাঙালি কবজি ডুবিয়ে মুরগি-মটন কিংবা ইলিশ-চিংড়ি সাবাড় না করলে কোনও উৎসব আবার উৎসব নাকি! সুতরাং এই দ্রব্যমূল্য-বৃদ্ধির আগুনের ছ্যাঁকা খেতে খুব একটা গায়ে লাগছে না বাঙালির। এছাড়াও সব মিষ্টির দোকান থেকে সরবরাহ হচ্ছে রকমারি মিষ্টি। অনেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানাচ্ছেন ভাইফোঁটা-স্পেশাল মিষ্টি। এইভাবেই প্রতিবছর ভালবাসা, মিষ্টিমুখ এবং ভুরিভোজের মাধ্যমে পালিত হয় ভাই-বোনের আনন্দের উৎসব, ভাইফোঁটা।

More Articles