গোল না ঠেকানোর শাস্তি! ৪৩ বছরের সাজা ভুগেছিলেন বিশ্বকাপের গোলকিপার
Brazil Football World Cup 1950: সব মিলিয়ে ওবদুলিয়ো যা পেয়েছিল, তা দিয়ে সে ১৯৩১ মডেলের একটা ফোর্ড গাড়ি কেনে। ওটা অবিশ্যি এক হপ্তার মধ্যেই চুরি হয়ে যায়।
নিরাময়ের স্পর্শ
এঁরিকে পিশঁ-রিভিয়া সারাজীবন ধরে বিষণ্ণতার রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করে গেছেন। হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন হতাশার গভীরে তলিয়ে যাওয়া মানুষের দিকে, যাতে নৈঃশব্দের খাঁচার লৌহকপাট চুরমার করে দেওয়া যায়। নিজের সাধনায় তিনি ফুটবলেই ওইসব মানুষের প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পেয়েছিলেন। গত শতাব্দীর চারের দশকে পিশঁ-রিভিয়া মনোরোগীদের জন্য নির্মিত হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে একটা ফুটবল টিম তৈরি করেন। আরহেন্তিনীয় সৈকতে তাঁর সেই দলের তথাকথিত পাগলরা হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। ফুটবল ছিল তাদের নিরাময়ের সেরা রাস্তা।
ওই ফুটবল দলের কোচ এবং সর্বোচ্চ গোলদাতা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পিশঁ-রিভিয়া বলতেন, "দলকে কীভাবে সাজাব, মাঠে নেমে কোন কৌশলে খেলা তৈরি হবে, সেটা ভাবাই সারাদিনে আমার বড় কাজ"।
পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে আজ আমরা, শহুরে মানুষরা, কমবেশি সবাই পাগল। আমার তো মনে হয় পাগলাগারদে জায়গা হবে না বলেই আমরা বাইরে-বাইরে বেড়াই। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার কর্কশ অত্যাচারে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে, রক্তাক্ত হিংসার নকশায় পড়ে গিয়ে, কখনও নিজের মুদ্রাদোষে একা হতে হতে আমরা আজকাল খুবই ঘেঁষাঘেঁষি করে বাঁচি, তবু আমাদের মধ্যে লক্ষ যোজন ফাঁক। আর তা হবে নাই বা কেন, আমাদের আড্ডার ঠেকগুলো যে ক্রমশ কমে আসছে! বুঝতেই তো পারেন নিছক আড্ডা মারার সময়ই বা এখন ক'জনের আছে।
ফুটবলেও আজকাল আর পাঁচটা জিনিসের মতোই উৎপাদকের চেয়ে উপভোক্তার সংখ্যা বহুগুণ। খোলা জায়গা যতটুকু যা ছিল সবই অ্যাশফল্টে মুড়ে ফেলা হয়েছে, লোকে খেলবে কোথায়! আর কাজের যা চাপ বেড়েছে সে তো কহতব্য নয়। আমাদের অবসর কোথায়? মোদ্দা কথাটা হলো, বেশিরভাগ মানুষই আজকাল আর খেলে না, টেলিভিশনে দেখে কিংবা গ্যালারিতে গিয়ে বসে। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখলে মাঠ থেকে দূরত্ব বাড়ে বই কমে না। যেকোনও কার্নিভালের মতোই ফুটবলও ক্রমশ জনগণের দেখার জিনিস হয়ে উঠছে। অন্য উৎসবগুলো থেকে ফুটবলের কিন্তু একটা পার্থক্য আছে। সাধারণ উৎসবগুলোয় সবাই রাস্তায় ধেইধেই করে নাচে। কিন্তু ফুটবলের গুণমুগ্ধ কিছু মানুষ চিরকালই থাকবে যারা বলে পা ছুঁইয়ে প্রভূত আনন্দ পায়। আমি শুধু ছেলেছোকরার কথা বলছি না। ভালোর জন্যই হোক বা উচ্ছন্নে যাবার রাস্তা সাফ করতেই হোক, আজকালকার খেলার মাঠগুলো বহু দূরে হলেও পাড়া-প্রতিবেশী, কারখানার সহকর্মী, দপ্তরের লোকেরা কিংবা ইস্কুল-কলেজের মাস্টার সবাই একজায়গায় জুটে গিয়ে প্রাণের আনন্দে ফুটবল পেটায়, যতক্ষণ না ক্লান্তিতে জিভ বেরিয়ে আসে। শেষে হারা-জেতা দু'দলের খেলোয়াড়রা একসঙ্গে হয়তো একটু মদ খায় কিংবা সিগারেটের কাউন্টার ফোঁকে, হয়তো কোনও দোকানে ঢুকে পেটভরে খায়। প্রাণের আরামের এই খেলা পেশাদার ফুটবলকে চোখ বুঁজে দশ গোল দেবে।
কখনও আবার মহিলারাও মাঠে নেমে পড়ে নিজেদের মুক্তি উদযাপন করে। যদিও ফুটবলের মাচো ঐতিহ্যের কারণে তারা চিরকালই বন্ধুত্বের এই পরব থেকে নির্বাসিত হয়ে আছে।
আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি
মার্তিনোর গোল
সেটা ১৯৪৬ সালের কথা, আরহেন্তিনার সান লোরেনসো একটা ম্যাচে উরুগুয়ের নাসিওনাল ক্লাবের কাছে হারছিল। সান লোরেনসোর রেনে পোনতোনি আর রিনালদো মার্তিনোর ভয়ে নিজেদের রক্ষণ শক্তিশালী করতে নাসিওনালের সবাই তখন নীচে নেমে এসেছে। পোনতোনি আর মার্তিনো বলকে কথা বলাতে পারত, আর গোল করার ক্ষমতাও ছিল জবরদস্ত।
মার্তিনো নাসিওনালের পেনাল্টি বক্সের সামান্য বাইরে বল পেল। সে এমনভাবে বল আঁকড়ে রইল, বলকে এত সোহাগ করতে লাগল, মনে হচ্ছিল ওর হাতে বুঝি অনন্ত সময়। হঠাৎ পোনতোনি বিদ্যুৎচমকের মতো ছুটে গেল ডানদিকের কর্নার লক্ষ্য করে। মার্তিনো একটু থেমে মাথা তুলে দোস্তকে ভালো করে দেখল। অবস্থার গতিকে নাসিওনালের খেলোয়াড়রা পোনতোনির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। যতক্ষণে গ্রেহাউন্ডগুলো খরগোশটাকে তেড়ে গেল, ততক্ষণে মার্তিনো টিয়াপাখির মতো উড়ে বক্সে ঢুকল, অবশিষ্ট ফুলব্যাকদের বোকা বানাল এবং গোল করল।
মার্তিনো গোলটা করেছিল বটে, কিন্তু ওতে পোনতোনিরও অবদান অনেকটাই। প্রতিপক্ষকে এমন বোকা বানাতে আর কেই বা পারত।
এলেনোর গোল
এবার ১৯৪৭-এর কথা, হিউ দে জেনেইরোতে বোতাফোগোর সঙ্গে ফ্ল্যামেঙ্গোর খেলা। বোতাফোগোর স্টাইকার এলেনো দে ফ্রেইতাস বুক দিয়ে একটা গোল করল।
এলেনো জালের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় হাওয়ায় ভাসমান বলটা উপর থেকে নেমে আসে। বলটা বুকে রিসিভ করে মাটিতে পড়তে না দিয়ে সে প্রবল গতিতে ঘুরল। তার শরীর তখন বেঁকে গেছে, তবু বল এলোনোর বুকের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে যায়নি। সে নিজে মুহূর্তের মধ্যে গোটা পরিস্থিতিটা মেপে নিল। গোল আর তার মধ্যে তখন একগাদা বিপক্ষের খেলোয়াড়। গোটা ব্রাজ়িলের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি লোক তখন ফ্ল্যামেঙ্গোর রক্ষণভাগে। সে বুঝতে পারছিল বল মাটিতে পড়লেই ওরা হায়নার মতো ছিনিয়ে নেবে। সুতরাং এলেনো শরীরটাকে অর্ধবৃত্তের মতো বাঁকিয়ে বুকে বল নিয়েই প্রতিপক্ষের এলাকায় এগুতে লাগল। অবস্থা এমন যে কেউ তাকে লাথি মেরে ফেলে দিতেও পারছে না, কেননা তাহলে ফাউল নিশ্চিত। এদিকে গুটিগুটি সে গোলের সামনে হাজির হয়ে গেছে। গোলমুখে পৌঁছে এলেনো সোজা হয়ে দাঁড়তেই বলটা পিছলে তার পায়ে এসে হাজির হল এবং বলাইবাহুল্য সে গোল করল।
এলেনো দে ফ্রেইতাস পাক্কা জিপসি ছিল। ওর মুখখানা ছিল ইতালীয় অভিনেতা রুডলফ ভ্যালেন্টিনোর মতো কিন্তু মেজাজটা ছিল পাগলা কুত্তার মতো। মাঠে খেলেতে নামলে তার পা থেকে স্ফুলিঙ্গ ছিটকে ছিটকে বেরুত।
এক রাতে সে ক্যাসিনোয় গিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে বসে। আরেক রাতে, ভগবান জানে কোথায়, সে বাঁচার ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে বসে। সেই রাতে এক অনাথাশ্রমে তীব্র ডিলিরিয়ামের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন- মুরগির মাংস খেলেই ম্যাচে হার! ফুটবলের বিচিত্র কুসংস্কারের এই ইতিহাস অজানাই
১৯৫০-এর বিশ্বকাপ
তখন সবে রঙিন টেলিভিশন তৈরি হচ্ছে, কম্পিউটারে হাজারও গণনা সেকেন্ডের মধ্যে করা যাচ্ছে, মেরিলিন মনরো হলিউডে পা রাখছে। বুনুয়েল ‘লস অলভিদাদোস’ বানিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসব কাঁপাচ্ছেন। হুয়ান মানুয়েল ফাঙ্গিয়ো ফ্রান্সে গিয়ে কার-রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতছে। বার্ট্রান্ড রাসেল নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন। পাবলো নেরুদার ক্যান্তো হেনের্যাল ছাপা হচ্ছে। আবার ওনেতি আর ওক্তাভিও পাসের [পাজ়] যথাক্রমে সংক্ষিপ্ত জীবন এবং নিঃসঙ্গতার ভুলভুলাইয়ার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে।
পুয়ের্তো রিকোর স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রবল সংগ্রাম করে আসা আবিজ়ু কেম্পোসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭৯ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হল। এক খোচড় দক্ষিণ ইতালির কিংবদন্তি ডাকাত সালভাতোরে জুলিয়ানোকে ধরিয়ে দেওয়ার পর পুলিশ তাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল। চিনে মাওয়ের সরকার বহুগামিতা আর শিশুসন্তান বিক্রি নিষিদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে প্রথম সামাজিক পদক্ষেপ করল। জাতিসঙ্ঘের দোহাই দিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনী কোরীয় উপকূলে বন্দুক আর তলোয়ারের জোরে অনুপ্রবেশ করেছে। ওদিকে ফুটবলাররা বিশ্বযুদ্ধের কারণে অযাচিত দীর্ঘ বিরতির পর হিউ দে জেনেইরোতে নামতে শুরু করেছে চতুর্থ জুলে রিমে ট্রফি খেলতে।
সেবার ব্রাজ়িলে বিশ্বকাপ খেলতে আমেরিকা মহাদেশ থেকে সাতটি আর ইওরোপ থেকে ছ'টি দেশ হাজির হয়। যুদ্ধের পর ইওরোপ তখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, ওই মহাদেশের খেলোয়াড়রা সেই ছাই মেখেই এসেছিল। ফিফা জার্মানিকে খেলতেই দেয়নি। ইংল্যান্ড এবারই প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে এল। ইংরেজরা এতদিন বিশ্বকাপের নামে এইসব দাঙ্গাবাজিতে যোগ দিয়ে নিজেদের মর্যাদা খোয়াতে চাইত না। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন সেবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশদের হারিয়ে দিয়েছিল। আর যে গোলে তারা ইংরেজদের মাথায় চেপে বসে সেটার জন্য জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটনকে লাগেনি। হাইতির এক কৃষ্ণাঙ্গ সেন্টার ফরোয়ার্ড ল্যারি গেটেন্স সাহেবদের কফিনে পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিল।
হোম টিম ব্রাজ়িলের ঝাঁ চকচকে নতুন মারাকানা স্টেডিয়ামে, যা আবার তখনকার দিনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল স্টেডিয়াম ছিল, ফাইনাল খেলতে নামল ব্রাজ়িল আর উরুগুয়ে। সেবার ব্রাজ়িল যে জিতবে এটা সবাই জানত, ফাইনালটা ছিল ব্রাজ়িলীয়দের কাছে উৎসবের দিন। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল সব দলকে গোলের মালা পরিয়ে ছেড়েছিল। ফাইনাল খেলতে নামার আগে তাদের দলের খেলোয়াড়দের একখানা করে সোনার হাতঘড়ি উপহার দেওয়া হয় যার ডায়ালের পিছন দিকে খোদাই করা ছিল, ‘বিশ্বজয়ীদের জন্য’। পরদিন সকালের খবরের কাগজের প্রথম পাতাগুলো আগে থেকেই ছেপে রাখা ছিল। চতুর্দিকে উল্লাস, বিজয়োৎসবের খুঁটিনাটি আয়োজনও সারা। বিশ্বজয়ের স্লোগান লেখা পাঁচ লাখ টি-শার্টও বিক্রি হয়ে গেছে।
ব্রাজ়িলের ফ্রিয়াকা যখন প্রথম গোলটা করল তখন দু'লাখ মানুষের গর্জন আর বিপুল বোম-পটকার আওয়াজে মারাকানার ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু তারপর স্কিয়াফিনো গোল শোধ করে ব্রাজ়িলের মাথায় হাতুড়ির এক বাড়ি মেরে উরুগুয়েকে খেলায় ফেরাল, শেষে উইং থেকে নেওয়া শটে গোল করে গিদজ়া উরুগুয়েকে ২-১ গোলে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দিল। গিদজ়া যখন শেষ গোলটা করে, তখন মারাকানার স্তব্ধতা যেকোনও মানুষকে বধির করে দিতে পারত, ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে কর্কশ নৈঃশব্দ্য। ‘ব্রাজ়িলের জলরং’ ‘আকোয়া রেলা দো ব্রাজ়িল’ গানের জনক বিখ্যাত সংগীতস্রষ্টা এরি বারোসো সেদিন রেডিওয় ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন, তিনি হঠাৎ করে একেবারেই কথা বলা বন্ধ করে দিলেন।
শেষ বাঁশি বাজার পর ব্রাজ়িলের সব ধারাভাষ্যকারই এই পরাজয়কে ‘ব্রাজ়িলের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর ট্র্যাজেডি’ বলে বর্ণনা করে। ফিফা সভাপতি জুলে রিমে উদাস মুখে নিজের নাম খোদাই করা কাপটাকে জড়িয়ে ধরে মাঠের মধ্যে এদিকে-ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছিল, "আমি হাতে করে কাপটা ধরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত উরুগুয়ের অধিনায়ক ওবদুলিয়ো ভারেলাকে দেখতে পেয়ে এমনভাবে তার হাতে বিশ্বকাপ সঁপে দিলুম যা বিশেষ কেউ দেখতেও পেল না। হাত বাড়িয়ে কাপটা দিলাম, কিন্তু ওকে অভিনন্দনটুকুও জানাতে পারিনি"।
আসলে জুলে রিমে পকেটে করে বিশ্বজয়ী ব্রাজ়িলকে অভিনন্দন জানিয়ে একখানা দেড়গজি বক্তৃতা লিখে এনেছিল। উরুগুয়ে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলেছিল। ব্রাজ়িলের একুশটা ফাউলের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা মাত্রই এগারোটা ফাউল করে। সুইডেন তৃতীয় স্থান পায়। হিস্পানিরা চতুর্থ। ব্রাজ়িলের আদেমির ন'টা গোল করে তালিকার শীর্ষে ছিল। তারপরেই ছিল উরুগুয়ের স্কিয়াফিনোর ছয় গোল এবং হিস্পানি জ়ারার পাঁচ গোল।
আরও পড়ুন- উড়ন্ত গোল করতে করতেই মারাত্মক সংঘর্ষ, বাইসাইকেল কিক কেড়েছিল ফুটবলারের প্রাণ
ওবদুলিয়ো
১৯৫০-এর বিশ্বকাপের সময় আমি নেহাতই নাদান বালক আর পাগলের মতো ফুটবল ভক্ত। উরুগুয়েতে আর সবার মতো আমিও বিশ্বকাপের সময় রেডিওর সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকতাম। কার্লোস সোলের বিষণ্ণ গলায় ব্রাজ়িলের প্রথম গোলের দুঃসংবাদ যখন বেতার তরঙ্গে ভেসে এল, আমি তখন যন্ত্রণায় মাটিতে মিশে গিয়েছিলাম। খানিক পরে মন শক্ত করে আমার সর্বশক্তিমান বন্ধুটির শরণাপন্ন হলাম। তাঁর কাছে পর্বতপ্রমাণ আত্মত্যাগের শপথ করলাম, যাতে তিনি মারাকানায় অবতীর্ণ হন এবং খেলার গতি উলটো দিকে ঘুরিয়ে দেন।
আমি আবার কোনওকালেই শপথ-টপথের কথা বেশিক্ষণ মনে রাখতে পারি না, ফলে সেগুলো পালন করাও হয় না। তাছাড়া ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দর্শকধন্য সেই ফাইনাল ম্যাচে উরুগুয়ের জয় ছিল সম্পূর্ণ অলৌকিক ঘটনা, কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল ওবদুলিয়ো ভারেলার অস্থি-মজ্জার বাস্তবে। ওবদুলিয়ো একাই ব্রাজ়িলের স্টিমরোলারকে ঠান্ডা করে দিয়েছিল। গোটা দলটাকে নিজের কাঁধে টেনেছিল। প্রবল সাহসে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
দিনের শেষে সাংবাদিকেরা নায়ককে ঘিরে ধরে। ওবদুলিয়ো খুব একটা বুকচিতিয়ে ঘোরার মতো লোক ছিল না, অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না যাদের তাদের মতোও নয়। সে সাংবাদিকদের সামনে মাথা নাড়তে-নাড়তে বিড়বিড় করে শুধু বলেছিল, "ওই হয়ে গেল আর কী!" চিত্রসাংবাদিকরা যখন ছবি তুলবে বলে ক্যামেরা তাক করল তখন সে ওখান থেকে পিঠটান দিল।
সেই রাতটা ওবদুলিয়ো পরাজিত দলের ভক্তদের গলা জড়িয়ে ধরে হিউ শহরের এক শুঁড়িখানা থেকে অন্য শুঁড়িখানায় বিয়ার খেয়েই কাটিয়ে দেয়। তখনও ব্রাজ়িলের মানুষ হাউহাউ করে কাঁদছে। ওবদুলিয়োকে কেউ চিনতে পারেনি। এমনকী পরের দিন মন্তেভেদিয়ো বিমানবন্দরে নেমে যখন দেখে আলো দিয়ে তার নাম লেখা হয়েছে, সে চুপচাপ লোকজনকে কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। বর্ষাতির কলারটা তুলে আর মাথার ফিদোরা টুপিটা নাক পর্যন্ত টেনে দিয়ে মার্কিন অভিনেতা হামফ্রে বোগার্টের মতো সেজে যাবতীয় উল্লাস থেকে হড়কে পালায়।
উরুগুয়ের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ভাগ্যবিধাতারা নিজেদের একটা করে সোনার মেডেল দিয়েছিল, আর ফুটবলারদের দিয়েছিল রুপোর মেডেল এবং সামান্য কিছু টাকা। সব মিলিয়ে ওবদুলিয়ো যা পেয়েছিল, তা দিয়ে সে ১৯৩১ মডেলের একটা ফোর্ড গাড়ি কেনে। ওটা অবিশ্যি এক হপ্তার মধ্যেই চুরি হয়ে যায়।
আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল
বারবোসা
’৫০-এর বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপার বাছতে সাংবাদিকদের কোনও অসুবিধেই হয়নি। সবাই এক বাক্যে ব্রাজ়িলের গোলকিপার মোয়েসির বারবোসার নাম করে। সেসময় ব্রাজ়িলের মাটিতে ওর চেয়ে ভালো গোলকিপার আর কেউ ছিল না। রবারের মতো নমনীয় দু'খানা পা নিয়ে বারবোসার শান্ত-প্রত্যয়ী ভঙ্গি গোটা দলকেই মনোবল জোগাত। চল্লিশ পার করেও বেশ ক'বছর খেলে সে যখন অবসর নেয়, তখনও তার সমতুল্য কোনও গোলকিপার গোটা ব্রাজ়িলে ছিল না।
কিন্তু কাপ ফাইনালের দিন উরুগুয়ের স্ট্রাইকার গিদজ়া ডান দিকের উইং থেকে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করে বারবোসাকে হতচকিত করে দেয়। বারবোসা গোল ছেড়ে একটু বেশিই এগিয়ে এসেছিল। সে পেছন দিকে ঝাঁপায় কিন্তু বলটা তার আঙুল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায় ও বোধহয় ভেবেছিল বলটা ঠিকভাবেই বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু মাটি থেকে উঠে পিছন ফিরে দেখে বল জালে জড়িয়ে গেছে। এই গোলের জন্যই মারাকানা স্টেডিয়ামকে বোবায় পেয়েছিল আর উরুগুয়ে পেয়ে গিয়েছিল বিশ্বকাপ।
তারপর এতগুলো বছর কেটে গেলেও বারবোসাকে ব্রাজ়িলের মানুষ ক্ষমা করেনি। ১৯৯৩-এ মার্কিন দেশে বিশ্বকাপের যোগ্যতানির্ণায়ক পর্বে বারবোসা চেয়েছিল ব্রাজ়িলের খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতে। সে একদিন গিয়েওছিল অনুশীলন শিবিরে, কিন্তু দলের হর্তা-কর্তারা তাকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। ততদিনে সে তার এক শ্যালিকার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, তার বাড়িতেই থাকে। কীই বা আর করবে, ভরসা তো ওই সামান্য টাকার পেনশন। বারবোসা সেসময় বলেছিল, "ব্রাজ়িলে কোনও অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে তিরিশ বছর। কিন্তু কোনও অপরাধ না-করেও আমি তেতাল্লিশ বছর ধরে সাজা ভোগ করছি"।