আনন্দের তিন 'মন্ত্র', ভারত কি পারবে কিস্তিমাত করতে?
Viswanathan Anand Chess Tips: ২০০০ সালের ২৪ ডিসেম্বর শিরভকে হারিয়ে ১৫ তম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন আনন্দ।
তাস-দাবা-পাশা, তিন সর্বনাশা!
আমাদের ছোটবেলায় বয়স্করা প্রায়ই এ কথা বলতেন। কিন্তু মন্দিরের চাতালে কিংবা পোড়ো বাড়ির বারান্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই বয়স্কদেরই দাবা খেলতে দেখে এক অভূতপূর্ব নিষিদ্ধ তাড়নায় মন আনচান করত। স্পর্শ করতে ইচ্ছে হতো ৬৪ সাদা কালোর নানান কৌশলকে। এই দোলাচলের মধ্যে থাকতে থাকতে কখন যে আমরা, দাবা খেলায় উৎসুক মুখেরা সেই নিষিদ্ধ বেড়া টপকে বড়দের আসরে পৌঁছে গিয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই।
দাবা নিয়ে নানা ঘটনাই মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। কিন্তু এখন আর দাবাকে সর্বনেশে খেলা কেউ বলতে পারবেন না। প্রথিতযশা প্রায় সব স্কুলেই 'ইসিএ' হিসেবে দাবাকে বেছে নিচ্ছেন অভিভাবকরা। দাবা খেলে কে কত বড় দাবাড়ু হবেন তার থেকেও বড় বিষয় দাবা খেলার মাধ্যমে শিশুর সামগ্রিক বিকাশ, বিশেষ করে তার মস্তিষ্কের উন্নতি যে অতি ত্বরান্বিত হয় এ আজ সর্বজনবিদিত।
১৮৫১ সালে লন্ডনের সিম্পসন ডিভান হোটেলের বিশাল হল ঘরে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতার যে আসর বসেছিল এবং এবছর কাজাকস্তানের আস্তানায় যে আসর বসল- মাঝখানের ১৭২বছরের ইতিহাস নানা আঁকাবাঁকা পথে এগিয়েছে। যুদ্ধ শুধুমাত্র দাবার বোর্ডে হয়নি। সে যুদ্ধ দাবার বোর্ড অতিক্রম করে নানা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৯৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব দাবা সংস্থা ফিডে ভেঙে তৈরি হয়েছিল পিসিএ। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ১০৮ তলায় আয়োজিত হয়েছিল ফিডের পাল্টা পিসিএ বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ। তৎকালীন সময়ে পুরস্কার মূল্য ছিল ১৭ লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯ কোটি টাকা! দাবার মতো খেলায় যা ছিল অকল্পনীয়। ভারতবাসী হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য ফিডে এবং পিসিএ দুই টুর্নামেন্টেই খেলেছিলেন আমাদের গর্ব বিশ্বনাথন আনন্দ। ফিডের টুর্নামেন্টে অল্পের জন্য হাতছাড়া হয় ফাইনাল খেলা। কিন্তু পিসিএ টুর্নামেন্টে সর্বকালের অন্যতম সেরা কাসপারভের বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন আনন্দ। নবম গেমে সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে অসাধারণ দক্ষতায় তিনি কাসপারভকে হারিয়েছিলেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় সেবারের মতো।
আরও পড়ুন- নেশার খেলা থেকে স্নায়ুর যুদ্ধ, জীবনকে মাপছে দাবা
অবশেষে সেই স্বপ্নের দিন এল, আনন্দ হারালেন আরেক রাশিয়ান অ্যালেস্কেই শিরভকে। ইরানের তেহেরানে ২০ থেকে ২৭ ডিসেম্বরে, ফাইনাল শেষ হওয়ার ৩ দিন আগেই কাঙ্খিত জয় পেলেন। ২০০০ সালের ২৪ ডিসেম্বর শিরভকে হারিয়ে ১৫ তম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন আনন্দ। ছ'টা গেমের মধ্যে চারটির বেশি আর খেলতেই হয়নি। ৪টি খেলাতেই ফলাফল আনন্দের পক্ষে চলে গেল। ভারতবর্ষে এক অসাধারণ মুহূর্তের জন্ম দিয়েছিলেন বিশ্বনাথন আনন্দ।
দাবা খেলে না এরকম দেশ হাতে গুণে কয়েকটি পাওয়া যায় মাত্র। সকলেই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন, ভারতবর্ষেই দাবা খেলার উৎপত্তি। সেই দাবাতে একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পেতে ভারতবর্ষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৪৯ বছর। অবশেষে ২০০০ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিশ্ব দাবার আঙিনায় ভারতের পতাকা পতপত করে ওড়ালেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় আনন্দ।
২০২৩-এর চ্যাম্পিয়নশিপ খুবই ঘটনাবহুল ছিল। দাবার ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ম্যাগনাস কার্লসেন নিজেকে সরিয়ে নিলেন চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে। জিততে জিততে কোথাও ক্লান্তি নাকি তাঁকে এতটাই পেয়ে বসেছিল যে, তাঁর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতেই অনীহা তৈরি হয়েছিল। আসলে দাবা এমন এক মননের খেলা যেখানে একশো ভাগ শারীরিক সক্ষমতা এবং দুশো ভাগ মানসিক সক্ষমতা না থাকলে চূড়ান্ত পর্যায়ের খেলায় সফল হওয়া যায় না। কিছুদিন ধরে কার্লসেনের মধ্যে এক মানসিক অস্থিরতাও কাজ করছিল। সে অস্থিরতার কারণ কয়েকজন ভারতীয়ও বটেন। প্রজ্ঞানন্দ, নিহাল গুকেশের কাছে হার কোথাও কার্লসেনের মধ্যে ভয়ের জন্ম দিয়ে থাকতে পারে। চ্যাম্পিয়ানরা কিন্তু এরকমই হন। খেতাব হারানোর ভয় যেমন তাড়িত করে, তেমনই কোথাও সব পেয়ে যাওয়ায় জেতার খিদেও হারিয়ে যায়। কালর্সেনের হঠাৎ নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ফলে অযাচিতভাবে সুযোগ পেয়ে যান চিনের ডিং লিরেন নেপোর চ্যালেঞ্জার হিসেবে। দু'জনের রেটিং প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় খেলা যে হাড্ডাহাড্ডি হবে, সকলেরই জানা ছিল।
১১ রাউন্ড পর্যন্ত নেপোই এগিয়েছিলেন। কিন্তু ১১ রাউন্ডের পর থেকে কোথাও যেন আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায় তাঁর মধ্যে। যে স্থিরতা আমরা প্রথমে দেখতে পাইনি লিরেনের মধ্যে, সেই আত্মবিশ্বাস ডিং ফিরে পান ১১তম গেমের পর থেকে। তখন যেন দুর্বল লাগছিল নেপোকেই। আসলে অনুশীলনের রণকৌশল লি-চেস্ প্লাটফর্মে প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় ডিং লিরেনের মধ্যে কোথাও একটা ভীতি তো ছিলই। সেটা কাটাতে অনেকগুলো গেম লেগেছে। তবে দাবা প্রেমিকদের কাছে এবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ তেমন উচ্চমানের হয়নি বলেই মনে হয়েছে। কোথাও যেন দাবা স্রেফ স্নায়ুর লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এই দুই দাবাড়ু যতটা শক্তিশালী বলে সকলেই জানেন, সেই শক্তি অনুযায়ী তাঁরা তাঁদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের খেলা তুলে ধরতে পারেননি। এবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আম জনতার মধ্যেও তেমন আলোড়ন ফেলতে পারেনি কার্লসেন না থাকার কারণে।
ভারতবর্ষ ইতিমধ্যে আনন্দের পর কয়েকজন অসাধারণ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়কে পেয়ে গেছে। এই তরুণ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের মধ্যে গুকেশ, অর্জুন, প্রজ্ঞা, নিহাল আগামীর সম্পদ। কিন্তু আনন্দের প্রায় সমসাময়িক যিনি বাংলা দাবাকে এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, সেই দিব্যেন্দু বড়ুয়ার পর সূর্য, সন্দীপন, তারপর দীপ্তায়ন, মিত্রাভ, কৌস্তভ বা সায়ন্তনরা কেন বারবার একটা জায়গায় আটকে যাচ্ছেন সে বিষয়ে উত্তরসূরিদের অনেক জিজ্ঞাসা থাকছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে এক সাধারণ বোর্ড এবং ঘুঁটি নিয়ে যে খেলা শুরু করা যায় সেই খেলায় এক নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে গেলে যে পরিমাণ খরচ এবং পরিকাঠামো দরকার বাংলার দাবাড়ুরা সেই পরিকাঠামো পাচ্ছেন না। তাই জুনিয়র, সাব জুনিয়র লেভেলে অসম্ভব ভালো ফল করেও একটা সময় তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন- খেলার সুযোগটুকুও জুটত না! যেভাবে দাবার ইতিহাসের বাঁক বদলালেন ডিং লিরেন…
তামিলনাড়ু, মুম্বই বা অন্যান্য রাজ্যে যেভাবে দাবাড়ুদের তৈরি করার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে বাংলার দাবাড়ুদের ক্ষেত্রে তা চোখে পড়ে না। তাই অসম্ভব সম্ভাবনাময় এবং স্বপ্ন-সওদাগর দাবড়ুরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। অভিভাবকরাও কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যাঁরা দাবার সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েছেন বা যাবেন ভাবছেন তাঁদের অভিভাবকদের যে কী পরিমাণ বিপদের মধ্যে পড়তে হচ্ছে আর্থিকভাবে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে একজন দাবাড়ুকে গড়ে তুলতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন পড়ে। শুধু প্রতিভা থাকলে হবে না দরকার পরিকাঠামো এবং আর্থিক নিশ্চয়তা। আর্থিক অনিশ্চয়তায় সম্ভাবনার অঙ্কুর অচিরেই বিনষ্ট হবে পশ্চিমবঙ্গে। যেভাবে স্কুলে, ক্লাবে এবং বিভিন্ন আকাডেমিতে দাবার উজান স্রোত বইছে, সেই স্রোতকে ধরে রাখার জন্য সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। দাবার জগতে আমরা যারা ছোটখাট দায়িত্বে বিভিন্ন জায়গাতে আছি, তাঁরা বুঝতে পারছি সম্ভাবনা কত দ্রুত মরে যাচ্ছে। সেই মরে যাওয়া সম্ভবনাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে হয় তাহলে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। নচেৎ বাংলা থেকে আগামী দিনে মধ্যমেধার দাবাড়ু হয়তো তৈরি হবেন কিন্তু সর্বভারতীয় পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ স্থান লাভ করতে গেলে তাঁদের ধারাবাহিক উন্নতমানের কোচিং পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
নিয়মিত বিদেশি ভালো দাবাড়ুদের সঙ্গে খেলাতে হবে। আর্থিক অনিশ্চয়তাতার মধ্যে থাকলে অভিভাবকদের দাবার প্রতি আকর্ষণ আগামীয়ে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে হোঁচট খাবে। পরবর্তী প্রজন্মের দাবাড়ু তৈরির ক্ষেত্রে তা বিরাট অশনিসংকেত। বাংলা থেকে যেটুকু সাফল্য আসছে সবই কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাফল্য, তাতে দাবা সংস্থার বা সরকারের তেমন ভূমিকা থাকছে না। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে উত্তরসূরি দাবাড়ুদের প্রতি আনন্দের পরামর্শ ছিল, "পরিশ্রম করো, দাবা উপভোগ করো এবং ভালোবাসো।" বিশ্বনাথনের এই অমোঘ উচ্চারণকে সামনে রেখেও বলা যায়, পরিশ্রম, উপভোগ এবং ভালোবাসার বাইরে পরিকাঠামো এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া উত্তরণের পথ সত্যিই কণ্টকাকীর্ণ। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ দেখে এবং বিশ্লেষণ করে ভুল ত্রুটি নিয়ে আমরা যতই আলোচনা করি না কেন বাংলার দাবাকে তার স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে গেলে সুনির্দিষ্ট ভাবনায় এগিয়ে যেতে হবে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, অভিভাবক এবং দাবা সংগঠনগুলোকে। বিরোধ নয়, সহমর্মিতার দৃষ্টিতে এবং খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়েই সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সকলের মিলিত প্রচেষ্টাই পারবে বাংলা দাবার হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে।