স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের
Chhabi Biswas: ইন্দ্রপুরীর বন্ধ গেটের সামনে একট চেয়ার নিয়ে বসে আছেন ছবি বিশ্বাস। তাঁর দু’পাশে মাটিতে রাজ্যের টেকনিশিয়ান। রাস্তা দিয়ে বাস যাচ্ছে, ধুলো উড়ছে, লোকে বলাবলি করছে, “আরে ছবি বিশ্বাস রে। ছবি বিশ্বাস।”
বিকাশ রায়ের ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ছবির শ্যুটিং চলছে। আর খানিক বাদেই লাঞ্চের ছুটি। এমন সময় ঝড় ধেয়ে এল। মূর্তিমান ঝড়। জ্ঞানেশ মুখুজ্যের বয়ানে, ছ’ ফুট চার লম্বা, মর্তমান কলার মতো গায়ের রঙ। পরিচালক বিকাশ রায়কে একেবারে অগ্রাহ্য করে সোজা পাহাড়ী সান্যালের দিকে। গম্ভীর গলায়, “পাহাড়ীবাবু, ‘সাজঘর’-এ আমার পার্ট আপনাকে দিয়েছিলাম, এখন আপনি সেই পাট আমাকে ফেরত দিন।” পাহাড়ী সান্যালের মুখচোখ দেখে বোঝা গেল এ ঝড়ের ঝাপটে তিনি বেশ অভ্যস্ত। তেরিয়া হয়ে জবাব দিলেন, “এ ছবি ‘সাজঘর’ নয়, এর নাম ‘অর্ধাঙ্গিনী’। এ ছবিতে আমার পার্ট আমি আপনাকে দেব না মশাই। আর সেটে আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না, ডিরেক্টরকে বলুন।” ডিরেক্টর আঁচ করছিলেন গতিক সুবিধের না। কাজেই ঝড়ের হাওয়া তাঁর দিকে ঘুরতে না ঘুরতেই বলে উঠলেন, “লাঞ্চ ব্রেকের আগে আমাকে দু’টো শট নিতেই হবে। জ্বালাতন করবেন না, চুপ করে বসুন।” কোনও কথা না বলে শিশুর মতো একটি চেয়ার টেনে নিয়ে ক্যামেরার সামনেই বসে পড়লেন ভদ্রলোক। “আমার পার্ট দে।”
—পার্ট নেই।
—ঠিক আছে…তুই অন্তত আমাকে একটা এক্সট্রার পার্ট দে।
—মানে?
চমকে উঠলেন বিকাশ রায়। মাথাটা গেল নাকি!
উত্তর এল, “মানে ছবি বিশ্বাসকে এক্সট্রা সাজাবি, একটা ক্লোজ আপ দিবি তো। ওই এক শটেই তোদের সব্বাইকে মেরে দেব।” এই সম্মুখ সমরে আমন্ত্রণের ব্যাপারটাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বিকাশ রায় বললেন, “ছবিদা প্লিজ সরে বসুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
—আমি সত্যাগ্রহ করছি। হয় পার্ট দে, না হয় আমার মাথা সুদ্ধু ছবি তোল।
কী বিপদ। কিছুতেই তাঁকে ভোলানো যায় না। শেষে অনেক বলে টলে, “ফ্রি লাঞ্চ খেতে দেব”—ইত্যাদির লোভ দেখিয়ে তবে ভদ্রলোককে নড়ানো গেল।
আরেকদিন ফ্লোরে শ্যুটিং চলছে। তরুণ মজুমদারের ছবি। প্রচণ্ড গরমে সবাই কাহিল। সারাদিন ধরে ছবি বিশ্বাস কাজ করেছেন, একটা কথাও বলেননি। বিকেলের দিকে থাকতে না পেরে তরুণকে বললেন, “আর থাকা যাচ্ছে না বুঝলি। মিনিট দশেকের জন্যে ছাড়বি? বাইরে গিয়ে একটু ছায়ায় বসি। কে যেন এসে বলল যে বাইরে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে।” প্রথা ভেঙে মিনিট পনেরোর একটা ব্রেক দিলেন পরিচালক। বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় কয়েকটি চেয়ার পাতা। ছবি বিশ্বাস তার একটায় গিয়ে বসলেন। আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক সবে দিয়েছেন কী দেননি, এমন সময় কোন ফ্লোর থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে পাহাড়ী সান্যালের প্রবেশ। গরমে ছটফট করছেন। আর গজগজ করছেন। “উঃ! শান্তি নেই কোথাও!” আড়চোখে চেয়ে ছবি বিশ্বাস জবাব দিলেন, “এতক্ষণ ছিল, এখানেই। আর থাকবে না।” সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ছবি বিশ্বাসের জীবন বহু আলোচিত। তবু দু’ একখানি গল্প বলার লোভ সামলানো দায়। যাত্রিকের একটা ছবির শ্যুটিং চলছে। তা সে সময়কার এক ‘ওজনদার’ অভিনেতা ক্ষমতা ফলাতে খুব ভালোবাসতেন। অকারণে সেটের লোকের উপর চোটপাট চলত। বড়দের সামনে অবশ্য কিছু বলার সাহস ছিল না। কিন্তু অধঃস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতেন। সেদিন শ্যুটিং শুরু হওয়ার আগে সবাই মেকআপ নিচ্ছেন। ছবি বিশ্বাসের কাজ একটু দেরিতে, কাজেই তিনি তখনও আসেননি। এমন সময় তিন নম্বর মেকআপ রুম থেকে শোনা গেল সেই অভিনেতার গলা, “ইডিয়ট! ভেবেছ কী? অন্যের ব্যবহার করা জিনিস আমায় পরাবে? এত বড় স্পর্ধা তোমার?” ড্রেসার ছেলেটি তরুণ। ডাকনাম পচা। সে মিনমিন করে বলার চেষ্টা করল, “না অমুকদা, বিশ্বাস করুন—।" কিন্তু একবার হাতে পাওয়া গেছে। সে সুযোগ হারান কেন! কথার মাঝেই চেঁচিয়ে উঠলেন সেই অভিনেতা, “ড্যাম ইওর বিশ্বাস! বোকা নাকি আমি? বুঝতে পারি না, ছোটলোক, স্টুপিড—আবার মুখে মুখে তর্ক করছ!” বলেই মেকআপ রুম থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে জামাকাপড় ছুঁড়ে ফেললেন বারান্দা থেকে। সে সব বাগানের গন্ধরাজ গাছটার তলায় পড়ে রইল।
আরও পড়ুন- ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর দজ্জাল গিন্নির আড়ালে রয়ে গেলেন দুঃসাহসী মলিনা দেবী
পচার কিঞ্চিৎ পরিচয় প্রয়োজন। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। চেতলার দিকে থাকত। যেমন গুণী, তেমনি বিনীত আর কঠোর পরিশ্রমী। সবথেকে বড় ব্যাপার, সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর সমস্ত বিচিত্র পোশাক আশাকের ঝামেলা সে একাই সামলেছিল। ওরকম ব্যবহার পেয়ে শুকনো মুখে কোনও রকমে মেকআপ রুমের বাইরে বেরিয়ে এল পচা। এসেই করিডোরে মাথা ঠুকতে ঠুকতে ফোঁপাতে শুরু করল। ঠিক এই সময় ছবি বিশ্বাস সেটে ঢুকছেন। পূর্বাপর কিছুই জানেন না, পচাকে অমন করতে দেখে এগিয়ে গিয়ে নরম গলায় বললেন, “কী হয়েছে রে পচা? কী হয়েছে? বাড়ি থেকে কোনও খারাপ খবর?” সেই প্রশ্নের আন্তরিকায় পচা এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। “দেখুন না ছবিদা, আমি নিজের হাতে আপনার আর অমুকবাবুর নতুন ধুতি আর গেঞ্জি রং করে, শুকিয়ে আপনাদের যার যার ঘরে রেখে দিয়েছি, আর তিনি আমাকে ‘ইডিয়ট’, ‘ছোটলোক’, ‘স্টুপিড’ —কী না কী বললেন। আমি কাজ ছেড়ে চলে যাব।”
এক মুহূর্তে ছবি বিশ্বাসের গলার স্বর পাল্টে গেল। “দাঁড়া”! একটাই কথা। তারপরে এগিয়ে গেলেন তিন নম্বর মেকআপ রুমের দিকে। গম্ভীর গলায় নাম ধরে ডাক। সেই অভিনেতা তো গদগদ প্রায়, “ছবিদা, আপনি?” কঠিন চোয়াল থেকে বেরিয়ে এল ক’টি কথা, “হ্যাঁ আমি। তার আগে বলো, গরিব হলেই যে মানুষ মিথ্যেবাদী হবে, এ কথা শিখলে কোথায়?”
—না মানে আমি…
—চো-প্
সেই আওয়াজে গোটা সেটের লোক চমকে উঠলেন। ছবি বিশ্বাসের এই চেহারা কেউ কোনওদিন দেখেননি। বাইরের গন্ধরাজ গাছটার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, “যাও। কুড়িয়ে নিয়ে এসো। নিজের হাতে কুড়োবে আর নিজের হাতে পরবে। মাই অর্ডার!” মাথা নিচু করে সেই অভিনেতা বাগানের দিকে পা বাড়িয়ে ছিলেন।
আরেকবার ‘স্মৃতিটুকু থাক’-এর শ্যুটিং চলছে। যে সময়ের কথা, তখন পাশের ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে বেতন এবং আরও কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছে মালিকপক্ষের সঙ্গে কর্মচারীদের। হঠাৎ সেই স্টুডিওর কয়েকটি ছেলে উপস্থিত ‘স্মৃতিটুকু থাক’-এর সেটে। ব্যাপার কী? জানা গেল আজ মালিকপক্ষ স্টুডিওর গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। সমস্ত কর্মীদের একসঙ্গে ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা। কর্মীরা গেটের সামনে ধর্নায় বসেছেন। তাই পুলিশের কাছে রিপোর্ট গেছে, কর্মীরা উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহার করছেন। যে কোনও মুহূর্তে পুলিশ এসে পড়বে। একে বেকার, তার উপরে পুলিশ তুলে নিয়ে গেলে মানুষগুলোর অবস্থা কী হবে? ক’টা টাকাই বা পান কলাকুশলীরা! গোলমালের আশঙ্কায় তাঁরা ছবি বিশ্বাসের কাছে ছুটে এসেছেন। তিনি যদি কোনও হিল্লে করতে পারেন। সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন ছবি বিশ্বাস। তারপর তরুণ মজুমদারকে ডেকে বললেন, “আজকের কাজটা আর আমাকে দিয়ে হবে না, বুঝলি?… তোরাও চলে আয়। ওদের পাশে দাঁড়ানো তো আমাদের কর্তব্য, না কি?” বাকিরা পায়ে হেঁটে, সেনাপতি নিজের রথে। পদাতিক বাহিনী পৌঁছে দেখল সে এক দৃশ্য বটে! ইন্দ্রপুরীর বন্ধ গেটের সামনে একট চেয়ার নিয়ে বসে আছেন ছবি বিশ্বাস। তাঁর দু’পাশে মাটিতে রাজ্যের টেকনিশিয়ান। রাস্তা দিয়ে বাস যাচ্ছে, ধুলো উড়ছে, লোকে বলাবলি করছে, “আরে ছবি বিশ্বাস রে। ছবি বিশ্বাস।” ছবি বিশ্বাসের ভ্রূক্ষেপ নেই। ইতিমধ্যেই পুলিশ এল। ওসি গাড়ি থেকে প্রবল প্রতাপ নিয়ে নামলেন বটে, কিন্তু তার পরেই চমকে উঠলেন। ওভাবে ছবি বিশ্বাসকে দেখেই কাঁচুমাচু। হাত কচলাতে কচলাতে অমায়িক হেসে, “স্যার! আপনি?”
—হ্যাঁ। আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে। আমার এই ছেলেগুলোকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন তো? স্বাগতম। কিন্তু একটা কথা। এদের ছোঁয়ার আগে আমার হাতে হাতকড়া পরাতে হবে।
শান্তভাবে নিজের হাতদু’টি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ছবিযুগের স্রষ্টা। ওসি সাহেব সেদিন কাউকেই আর গাড়িতে তুলতে পারেননি। এমনকি দাবিদাওয়া সমস্ত মেনে নিয়ে ফের স্টুডিও খুলতে হয়েছিল ইন্দ্রপুরীর কর্তৃপক্ষকে।
সব মিলিয়ে ছবি বিশ্বাস এক বহুস্তরীয় চরিত্র। একরৈখিক পঠনে তাঁকে মাপা অসম্ভব। ১৯৫০ অবধি মঞ্চে অভিনয় করেছেন টানা। তারপর হাঁপের টানে আর পারতেন না। কাজেই মঞ্চের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। একদিন দেবনারায়ণ গুপ্ত দেখা করতে এলেন। মাছের আঁশ দিয়ে একটা মোটা কাপড়ের উপর ফুলের সাজি করছিলেন। দেবনারায়ণকে দেখেই হাতের কাজ ফেলে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। কুশল বিনিময় হল। দেবনারায়ণ বললেন, ছবিবাবুর স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতেই আসা। চা জলখাবার খেয়ে সেদিন চলে এলেন। দিন পনেরো পর ফের দেবনারায়ণের আবির্ভাব, কী, না “এই এদিকে একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল, ভাবলাম দেখা করে যাই।” কয়েকদিন পরে আবার হাজির, অন্য অজুহাতে। ব্যাপারটা ছবি বিশ্বাসের সুবিধের ঠেকল না। বললেন, “তোমার মতলবটা কী বলো তো? প্রায়ই আসছো আমার খবর নিতে?” তখন বোঝা গেল ছবিবাবু ঠিকই ধরেছেন। দেবনারায়ণের অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। তাঁর খুব ইচ্ছে স্টারে ছবি বিশ্বাস অভিনয় করুন। রঙ্গমঞ্চে আরেকবার ফিরুন। “লোকে বলে শারীরিক কারণে আপনি থিয়েটার করা ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু এ ক’দিন এসে আপনাকে দেখে, আপনার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে, আমার কিন্তু তা মনে হয় না।” দেবনারায়ণের মনে ঘোর সন্দেহ। এদিকে ছবি বিশ্বাস কিছুতেই মঞ্চে নামবেন না। বাধ্য হয়ে দেবনারায়ণ শেষ তাসটা খেললেন।
—আপনি কোন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন আছেন?
—ডাঃ এস কে গুপ্ত। হার্ট স্পেশালিস্ট। সতুদার (সতু সেন) আত্মীয়।
গুপ্ত সাহেব দেবনারায়ণের পরিচিত। বললেন, “তিনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আপনি করবেন তো থিয়েটার?” আর কী বলেন! অনিচ্ছায় রাজি হলেন। ডাক্তারের কাছে জানা গেল, ওঁর হাঁপ ব্রঙ্কাল নয়, কার্ডিয়াক। স্টার তখন এসি। এসিতে কাজ করতে কোনও অসুবিধাই হবে না। এ খবর ছবি বিশ্বাসকে জানাতে খেপে গিয়ে বলেছিলেন, “তুই একটা গো-সাপ। মেঘ না ডাকা পর্যন্ত ছাড়বি না।” যাই হোক, ১৯৫৯-তে মনোজ বসুর ‘বৃষ্টি! বৃষ্টি!’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘ডাকবাংলো’ নাটক হল। ছবি বিশ্বাস বিশ্বেশ্বর। আত্মভোলা অথচ সিরিয়াস চরিত্র। বললেন, “আমি যদি চরিত্রটাকে সিরিওকমিক করি, তোর আপত্তি আছে?” তাতে যখন দর্শক হাসবে দম নেওয়ার সুযোগ পাবেন। রাজি হন দেবনারায়ণ। তারপর ফের ইতিহাস। সেই যে রঙ্গমঞ্চে ফিরলেন, এমন নেশা হয়ে গিয়েছিল, যে নাটকের জন্য ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র চরিত্র করবেন না বলে দিয়েছিলেন সত্যজিৎকে। উইকেন্ডে কলকাতা না ফিরতে পারলে নাটক হবে না। এদিকে ছবির শ্যুটিংয়ের সময় দার্জিলিংয়েই থাকতে হবে। ছাড়বেন না সত্যজিৎ। কাজেই মুখের ওপর না করে দিয়ে চলে এলেন। সেও ‘শ্রেয়সী’ নাটকের জন্য। বছর দুই ধরে চলছিল নাটকটা। শেষে অনেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁকে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় ফেরানো গেল।
আরও পড়ুন- কাজ না পাওয়ার অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ‘পথের পাঁচালী’-র হরিহর কানু বন্দ্যোপাধ্যায়
এরপরেই সেই অভিশপ্ত দিন। ১৯৬২র ১১ জুন। সকালে ভানুর বাড়ি গেলেন। জাগুলিয়ার বাড়ি যাচ্ছেন সপরিবারে নিজের গাড়িতে। “যাবি সঙ্গে?’ ভানুর সেদিন রেডিওতে অনুষ্ঠান। যেতে পারলেন না। ভবানীপুরে অসিত সেনের সঙ্গে দেখা হল। তখনও স্টিয়ারিং ছবি বিশ্বাসের ড্রাইভারের হাতেই। শ্যামবাজারে এসে কী মনে হল, ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে নিজে স্টিয়ারিং ধরলেন। গাড়ি চালাতে অত্যন্ত দক্ষ। প্রচণ্ড মাতাল অবস্থাতেও ঠিক চালাতে পারতেন। আর সেদিন তো সম্পূর্ণ ফিটফাট। অথচ নিয়তি! তার পরিহাস কে এড়াতে পারে! মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগরে ওল্ড যশোর রোডের কাছে উলটোদিক থেকে একটা ভ্যান এসে মারল ধাক্কা। স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ। আশ্চর্যের বিষয় গাড়ির বাকি তিন আরোহীর গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগেনি। আরজিকরে আনা হল দেহ। হু হু করে খবর তখন ছড়িয়ে পড়ছে। ছবি বিশ্বাস, বাংলা সিনেমা জগতের অন্যতম অভিভাবক আর নেই। হাসপাতালের বাইরে ভিড়। লোকে লোকারণ্য। সেদিন অনেক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে পর্যন্ত বলতে শোনা গিয়েছিল, “আজ ছবি বিশ্বাস মারা গেছেন, আজ আর গাড়ি চালাব না, গ্যারেজে যাচ্ছি।”
শবদেহ নিয়ে মিছিল বেরোল। ঠিক হল, আগে স্টারে দেহ আনা হবে। দেবনারায়ণ গুপ্ত, সলিলকুমার মিত্র মালা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ছবির কাজ শেষ করে ফের স্টারে ফেরার কথা ছিল, মানুষটা আর ফিরল না, এল কেবল নিথর দেহখানি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ঢুকলেন মালা নিয়ে। দেবনারায়ণকে বললেন, “তোর এখানেই চলে এলাম, আমার নুটুবিহারীকে মালা পরাবো বলে।” ইতিমধ্যে উত্তমের ফোন, “দেবুদা, আমি উত্তম কথা বলছি। আপনাদের ওখানে যাচ্ছি। ছবিদাকে মালা দেব। আপনি দারোয়ানকে বলে দিন— স্টার লেনের দরজাটা যেন খুলে রাখে।” জনপ্রিয়তা, খ্যাতি এতখানি ভয়ঙ্কর, কখনও বা হিংস্র, যে মহানায়ককে স্টারে ঢুকতে হয় পিছনের দরজা ঠেলে। শ্বেতপদ্মের মালা নিয়ে এসেছিলেন উত্তম। তাঁর স্নেহের ‘ছবিদা’র নিথর দেহে শেষ সম্মানটুকু জ্ঞাপন। মিনিট খানেক। শোভাযাত্রার আভাস পাওয়া গেল। হঠাৎ তারাশঙ্কর উত্তমকে ডেকে বললেন— “তুমি মালা দিতে যেও না। তাহলে ছবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাঁরা এসেছে, তাঁদের চোখ তোমার দিকে চলে যাবে।” থমকে গেলেন মহানায়ক। এই কি তাঁর প্রাপ্য ছিল? ছবি বিশ্বাসের মরদেহও ছুঁতে পারবেন না? করুণ দৃষ্টিতে একবার তারাশঙ্কর, একবার দেবনারায়ণের দিকে তাকালেন উত্তম। “এ কী বিড়ম্বনা বলুন তো! কাছের মানুষকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না, প্রণামও করতে পারলাম না!” বলতে বলতে গলা ধরে এল, চোখে জল। হয়তো গ্ল্যামারের লক্ষণরেখার আঁচ সেদিনই পেয়েছিলেন বুকের আশপাশে। ছবি বিশ্বাসের দেহে ওই মালা শেষ অবধি দেবনারায়ণই দিয়েছিলেন। স্নেহের ‘বড়ো হনুমান’কে (উত্তম) যে দু’টি হাত ধাক্কাপাড় ধুতি ডিজাইন করে দিয়েছিল নিজের হাতে, যা পরে ‘উত্তমকুমার ধুতি’ বলে খ্যাত হয়, সেই প্রৌঢ় নিথর দু’টি হাত শেষবারের মতো স্পর্শ করতে পারলেন না, পারলেন না কেবল ‘মহানায়ক’ তকমার ভারে—এ অক্ষমতা কি আজীবন বেঁধেনি অরুণ চাটুজ্যেকে?