একটিমাত্র হাঁচির দৌলতে পাঁচশো টাকা পারিশ্রমিক কমে গিয়েছিল ছবি বিশ্বাসের
ছবি বললেন, "ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু আমার রেমুনারেশনটা জানা আছে তো? পার ডে ওয়ান থাউজ্যান্ড রুপিজ।" শুনে তো তরুণ মজুমদার এবং দিলীপ মুখার্জীর আক্কেল গুড়ুম। হাজার টাকা? বলে কী!
শীতের সন্ধে। দক্ষিণ কলকাতা তখনও খুব একটা জমাটি না। উদ্বাস্তু কলোনিও সেসময় আজকের মতো সাজানোগোছানো ছিল না। দেশভাগের দাগ অপেক্ষাকৃত কাঁচা। তারই মধ্যে টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে দু'-দুটো সাইকেল রিকশা এগিয়ে চলেছে নাকতলার দিকে। প্রথমটিতে দু'জন সওয়ারি, প্রথমজন রোগাপাতলা, এই শীতেও গায়ে ঘিয়ে রঙের পাতলা সিল্কের পাঞ্জাবি আর পাজামা। গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছেন। বোঝাই যাচ্ছে, বেশ মুডে আছেন ভদ্রলোক। পাশের জনের একেবারেই সাদামাটা, দোহারা চেহারা। আর পিছনের রিকশায় যে ভদ্রলোক চেপে আছেন, তাঁর চেহারা কিন্তু বেশ নায়কসুলভ। আর কয়েকদিন বাদেই তা হাতে-কলমে সত্য বলে প্রমাণিত হবে। কিন্তু আপাতত সেসময় আসেনি। রাস্তার দু'পাশে চাপ চাপ অন্ধকার শীতের পাতলা কুয়াশায় আরেকটু রহস্যময় হয়ে উঠেছে। এক-দুটো আলো জ্বলছে অতি কষ্টে যেন, টিমটিম করে এখানে-ওখানে। পুকুর, কলগাছের ঝাড়, মাঝে মধ্যে এক-দু'খানা পাকা বাড়ি। নাকতলায় এক প্রকাণ্ড বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল রিকশাদুটো। প্রকাণ্ড ফটক পেরিয়ে ডানদিকে একটা গোলাপবাগান। বাগান আর বাড়ির মাঝখানে নুড়িবিছোনো সরু একটা পথ। সেই পথ ধরে এগিয়ে গেল তিন মূর্তি। দরজাটা খোলা, ভেতর থেকে মৃদু আলো এসে পড়েছে। সিল্কের পাঞ্জাবি হাঁক পাড়লেন, "ছবি আছো নাকি? ও ছবি!"
ছবি অর্থে ছবি বিশ্বাস। বাংলা সিনেমার একছত্র সম্রাট। তবে এই কাহিনির সূত্রপাত ঠিক এখানে নয়। বরং আরও খানিকটা পিছিয়ে গেলে সে উৎসের সন্ধান পাওয়া যাবে। সময়টা পাঁচের দশকের শেষের দিক। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ। আর পাঁচটা দলের মতোই পায়ে পায়ে হাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছে 'যাত্রিক'। তখন দল বেঁধে নির্দেশনার বেশ চল ছিল। যাত্রিকের থ্রি মাস্কেটিয়ার্স তরুণ মজুমদার, দিলীপ মুখোপাধ্যায় আর শচীন মুখোপাধ্যায়— এর আগেই একসঙ্গে টুকটাক কাজ করেছেন নানা ছবিতে। সেই সূত্রে উত্তম এবং সুচিত্রার সঙ্গেও ততদিনে বেশ পরিচয় হয়ে গিয়েছে। দু'জনেই আশ্বাস দিয়েছেন, আপনারা যদি নিজেরা ছবি বানাতে চান, আমরা দেখব ব্যাপারটা। অপ্রত্যাশিত সাহায্য। সেসময় উত্তম-সুচিত্রা জুটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাঁদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি সোজা ব্যাপার না। তার ওপর তিনজনই আগে কখনও নির্দেশনা দেননি। উৎসাহ, ভয়, উদ্বেগ সব মিলেমিশে একাকার। বসুশ্রী, বিজলী, ইন্দিরা, ভারতী, পূর্ণ— তখন দর্শকে উপচে পড়ছে সারাক্ষণ। এইসব হলের আরেকটা পরিচয় ছিল। কোনও না কোনও হলে ম্যানেজারের অফিসে প্রায়দিনই ফিল্মজগতের রথী-মহারথীরা আড্ডা জমাতেন। পাহাড়ী সান্যাল, বিকাশ রায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এইরকমই এক আড্ডা থেকে তরুণকে আলাদা করে ডেকে আনলেন একদিন ভারতীর জেনারেল ম্যিনেজার রোহিণী বসু, "এই ছেলেটা! আজ এখানে গুলতানি করতে হবে না। কত্তারা ডেকেছেন তোকে। যা, একবার দেখা করে আয়। চা-টা সব পরে হবে।"
তরুণ মজুমদার অবাক। 'কত্তারা' অর্থে তিন প্রবীণ। রূপবাণী, ভারতী আর অরুণা সিনেমার মালিক। পাশাপাশি আরও হরেকরকমের ব্যবসা। ঈশ্বরের আশীর্বাদে টাকাপয়সার কমতি নেই। ভয়ে ভয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন তরুণ। যা শুনলেন, তাতে নিজের কানকে সহজে বিশ্বাস করা যায় না। তরুণ মজুমদাররা ছবি বানালে ওঁরা প্রযোজনা করতে রাজি। টাকাপয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না। এ তো হাতে চাঁদ পাওয়া! এমন একটা প্রস্তাবে খুশি না হয়ে উপায় আছে! এদিকে তারকাদ্বয়ও এমন একটা প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। ছবি তৈরির ইচ্ছেটা আরও পাকাপোক্তভাবে মাথায় বসল। 'যাত্রিক'-এর তিনজন গিয়ে ধরলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়কে। সেসময় নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ যে চিত্রনাট্য লিখছেন, তাই হিট হয়ে যাচ্ছে। কাজেই তিনজনে গিয়ে হত্যে দিলেন তাঁর বাড়িতে। হত্যেই বটে। দিন যায়, মাস যায়, সেই যে 'দেব' বলে খেলাতে শুরু করলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ, চিত্রনাট্য আর কিছুতেই দেন না। অগ্রিমের টাকায় মধুপুর-টধুপুর ঘুরে চলে এলেন। হা হতোস্মি! একবর্ণও লেখা হয়নি। এদিকে শিল্পীরা তাড়া দিচ্ছেন। তাঁদের ডেট চাই। আরও হাজার গণ্ডা ছবির কাজ পড়ে আছে। কিছুতেই কিছু হয় না। অবশেষে হাল যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছে যাত্রিক দল, তখন চিত্রনাট্য এল। এল মানে রাজকীয়ভাবেই এল। কী সেই সিনেমা? বলছি বলছি, সবুর।
আরও পড়ুন: বুকে ব্যথা নিয়েও শট দিয়েছিলেন, ফিরে দেখা মহানায়কের শেষ দিন
চিত্রনাট্য পড়ে সবাই খুব খুশি। উত্তম-সুচিত্রাও অত্যন্ত প্রশংসা করলেন। কিন্তু বহু চরিত্র স্ক্রিপ্টে। কাস্টিং ঠিকঠাক না হলে ছবি দাঁড়াবে না। বিশেষত নায়িকার বাবার চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাশভারী এক খবরের কাগজের মালিক। তাঁর দাপটে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। প্রচণ্ড সংযমী। আবার বাড়িতে তিনিই স্নেহময় পিতা। স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে অনেকদিন। একমাত্র কন্যাকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথাটি বিগড়েছেন। সেই মেয়ে নানা ঝামেলা পাকায়, বাবাকেই সামলাতে হয় সবটা। চরিত্রের এই বৈপরীত্য ফোটানো সহজ নয়। এক ছবি বিশ্বাস ছাড়া কাউকেই এই চরিত্রে ভাবা যায় না। কিন্তু ছবি বিশ্বাস তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। একে তিনজনেই নির্দেশনার লাইনে নতুন। ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে কারও পরিচিতি নেই, তার ওপর যেমন ব্যস্ত শিল্পী, তেমনই সম্মানদক্ষিণা। সব মিলিয়ে ভজঘট ব্যাপার। উত্তম-সুচিত্রার সাহায্যে লো বাজেটের একটা ছবি করছেন তাঁরা। সেখানে কত দূর সম্ভবপর ব্যাপারটা কে জানে! যাই হোক, কীভাবে ছবি বিশ্বাসের কাছে পৌঁছনো যায়, সেই খোঁজ শুরু হলো। শেষে অনিল চাটুজ্জের কাছে খবর পাওয়া গেল, কমেডিয়ান নৃপতি চট্টোপাধ্যায় নাকি ছবি বিশ্বাসের বুজুম ফ্রেন্ড। রোজ বিকেলে দু'জনে আড্ডা দেন। যদি কেউ ছবি বিশ্বাসের হদিশ দিতে পারে, তবে সে নৃপতিবাবুই। এরপরে কীভাবে নৃপতি চাটুজ্জের সঙ্গে দুই মূর্তি পৌঁছলেন ছবি বিশ্বাসের বাড়ি, সে-ঘটনা শুরুতেই রয়েছে লেখার।
দুরু দুরু বুকে দুই মূর্তি ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। খোলা দরজা দিয়ে যেন বাইরের অন্ধকার ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতরের। একটামাত্র ইলেকট্রিক বাল্বে আলোআঁধারি জমেছে বেশ। ঘরটাকে হলঘরই বলা চলে। একপাশে ভারী ভারী সোফাসেট, সেন্টার টেবিল, আরও নানা ধরনের ফার্নিচার। দু'-একটা আলমারি, একটা টুপি টাঙানোর র্যাক, এসবের উল্টোদিকে ঠিক বাল্বের তলায় একখান গদিপাতা চৌকি। সেই চৌকিতে আধশোয়া হয়ে পানের বাটা থেকে পান সাজছেন স্বয়ং ছবি বিশ্বাস।
নৃপতিবাবু দুই মূর্তিকে বসিয়ে তাঁদের অনেক গুণগান করলেন ছবি বিশ্বাসের কাছে। তারপর দোতলায় চলে গেলেন বৌদির সঙ্গে গল্প করতে। এদিকে দু'পক্ষই, কেউই কোনও কথা বলছেন না। গোলাপবাগানের ঝিঁঝিঁর ডাক দু'জনের কানে চাপ বেঁধে আসছে। নার্ভাস হয়ে পড়ছেন বারেবারে। ঘরের দেওয়ালঘড়িটা টিকটিক করে চলেছে ক্রমাগত। এমন সময় সেইসব নিস্তব্ধতার শব্দ ভেঙে গমগম করে উঠল ভারিক্কি গলার আওয়াজ—"ছবি বানানো হচ্ছে?" ভাববাচ্যের সামনে আরও কুঁকড়ে গেলেন দু'জন। গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোতে চায় না। অবশেষে অতি কষ্টে সম্মতি জানানো গেল। একে একে সব শুনলেন। কে কে আছে, কেমন চরিত্র। তারপর বললেন, "টোটাল ক'দিনের কাজ এই চরিত্রটার? মানে আমি যদি আদৌ রাজি হই করতে?"
তরুণরা জানালেন চোদ্দ-পনেরো দিনের মতো কাজ রয়েছে। শুনে বললেন, "ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু আমার রেমুনারেশনটা জানা আছে তো? পার ডে ওয়ান থাউজ্যান্ড রুপিজ।" শুনে তো তরুণ মজুমদার এবং দিলীপ মুখার্জীর আক্কেল গুড়ুম। হাজার টাকা? বলে কী! প্রতিদিন এতগুলো করে টাকা তাঁরা দেবেন কীভাবে! লো-বাজেটের ছবি তাঁদের। দু'জনেই মুখ নামিয়ে নীরবে বসে আছেন। ছবি বিশ্বাস নিজের মতো পান ছাঁচছেন। কিছুক্ষণ পরে, হঠাৎ, "হ্যাঁচ্ছো!" খুব জোরে একখান হাঁচি দিলেন বাংলা সিনেমার সম্রাট। তারপর কোনওদিকে না তাকিয়েই বললেন, "ঠিক আছে। ওই হাঁচির দৌলতে পাঁচশো টাকা কমে গেল।"
আনন্দে দুই মূর্তি তখন উজ্জ্বল। দৈনিক পাঁচশো টাকা টেনেটুনে দিতে পারবেন তাঁরা। আনন্দের আতিশয্যে মুখে কথা আসছে না। ইতিমধ্যে আবার সেই ভারিক্কি গলা শোনা গেল, "এবার কীসের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে? আরেকটা হাঁচির জন্য?"
হাসিমুখে তাঁকে প্রণাম করলেন দুই মূর্তি। এতক্ষণে ভাববাচ্য ছেড়ে মাটিতে নামলেন সম্রাট। "থাক থাক, ছবিটা মন দিয়ে করিস।" তৈরি হলো উত্তম-সুচিত্রা এবং ছবি বিশ্বাসের কাল্ট ছবি 'চাওয়া-পাওয়া'। যে ছবির চর্চা এখনও মুখে মুখে ফেরে বাঙালির। বাংলা সিনেমা পেল তার এক অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পরিচালক তরুণ মজুমদারকে। আর ছবি বিশ্বাস? তাঁর কথা বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর জীবনের এমন আরও নানা কড়ামিঠে গল্প নিয়ে আসর জমবে ফের কখনও।
তথ্য ঋণ:
সিনেমাপাড়া দিয়ে, তরুণ মজুমদার, দে'জ প্রকাশনী (দুই খণ্ড)