বিচারের বাণী লেখে শাসকই! মনে পড়ে চুনী কোটালকে?

Chuni Kotal: চুনী কোটাল আগেই সম্প্রদায় নিয়ে খোঁটা দেওয়ার অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তদন্ত কমিটি গঠনও করেন।

বিচার বিভাগের দক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে লেখালিখি তো কম হয়নি, আন্দোলন-সংগ্রামও হয়েছে। তবু এখনও, আদালতকে এমন বহু বহু রায় দিতে দেখা গেছে, যাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আশঙ্কা হওয়া অমূলক না। অপরাধের তদন্ত করতে যে কমিটি গঠন করা হয়, সেটি এখনও চলে সরকারের নির্দেশে। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারই ঠিক করে হয় না। আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে বিচার ব্যবস্থার দিকে, পুলিশের দিকে আঙুল উঠছে। নতুন তো নয়। এমন উদাহরণ লাখো। এই আবহেই মনে পড়ে চুনী কোটালকে। বিদ্যাসাগর কলেজে ক্রমাগত জাতিবৈষম্যের চাপে ১৯৯২ সালে আত্মহত্যা করেন চুনী কোটাল। ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যরা প্রতিনিয়ত সম্প্রদায় নিয়ে খোঁটা দিত বলেই অভিযোগ ছিল তাঁর। সেই সময় চুনী কোটাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ প্রশাসন কাউকেই পাশে পাননি। তিনি অভিযোগ জানিয়েছিলেন, বিভাগীয় প্রধান, ছাত্র সংসদ সর্বত্রই। পাশে দাঁড়ায়নি কেউই। শেষে ১৯৯১-এর ১০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিঠি লেখেন তিনি। তদন্ত কমিটি গঠন হয় ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি। দিনের পর দিন চুনী কোটাল সুবিচারের অপেক্ষা করেছিলেন। শেষে ২৪ অগাস্ট প্রতিবেদন জমা হয় কিন্তু তার আগেই ১৬ অগাস্ট চুনী কোটাল মৃত্যুর পথ বেছে নেন। তিনি যে সময় এদেশে বিচার না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন, তার প্রায় ৩২ বছর পরও আরজি করে ঘটে যাওয়া অবর্ণনীয় হত্যা ও ধর্ষণের বিচারের জন্য আমাদের হাহাকার করতে হচ্ছে।

লোধা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম মহিলা স্নাতক হয়েছিলেন চুনী কোটাল। ১৯৮৫ সালে মেদিনীপুর কলেজ থেকে স্নাতক হন। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আদিবাসী উন্নয়ন দফতরে চাকরিও পান। চাকরি সূত্রে যেতে হয়েছিল ঝাড়গ্রামে। বিদ্যাসাগর কলেজে নৃতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার সুযোগও পান। তারপর মেদিনীপুর আদিবাসী মেয়েদের হোস্টেলে রানি শিরোমনি কেন্দ্রীয় ছাত্রী নিবাসে সুপারের চাকরি পান। পদোন্নতি তো হয়েছিলই, বেতনও বেড়েছিল। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াকালীনই ক্রমাগত জাতিবৈষম্যের শিকার হতে হয় চুনী কোটালকে। তাঁকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হতো, জাত তুলে আক্রমণ করা হতো। উপস্থিতি সত্ত্বেও তার হার কমিয়ে দেখানো হতো। একটা সময় এই আক্রমণ সহ্যের বাইরে চলে যায়। শেষে আত্মহত্যা করেন তিনি। এই ঘটনায় অভিযোগ উঠেছিল বিদ্যাসাগর কলেজের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক ফাল্গুনী চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে। দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ।

আরও পড়ুন- কেন কামদুনি রায় সমর্থন করি : সুমন চট্টোপাধ্যায়

চুনী কোটাল আগেই সম্প্রদায় নিয়ে খোঁটা দেওয়ার অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তদন্ত কমিটি গঠনও করেন। সেই তদন্ত কমিটি একটি রির্পোট পেশ করেছিল, কিন্তু রিপোর্টে কী ছিল সেই তথ্য বহুদিন জানাই যায়নি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য সেই প্রতিবেদন কখনও প্রকাশই করেননি।

প্রয়াত অধ্যাপক জগৎবন্ধু বিশ্বাস একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, তিনি ৯০-এর দশকে সেই রিপোর্ট পেলেও প্রকাশ করেননি। প্রকাশ করেছিলেন প্রায় তিন দশক পর। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অভিযুক্ত শিক্ষককে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। জগৎবন্ধু বিশ্বাস বলেছিলেন, "সিপিএম তখন মধ্য গগনে। কে কথা বলবে তার বিরুদ্ধে? তাই চুপ করে ছিলাম। প্রকাশ করলেই আমার জীবন সংশয় হতো।"

চুনী কোটাল বিচারের অপেক্ষা করতে করতে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন। অথচ মৃত্যুর পরও সেই বিচার হয়নি। ১৯৮৯-এর শিডিউল কাস্ট অ্যান্ড ট্রাইব অ্যাক্ট থাকা সত্ত্বেও চুনী কোটাল বিচার তো পেলেনই না, উল্টে ১৯৯৫ সালে রাজ্য সরকার নিযুক্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির তদন্ত কমিটি রায় দিয়েছিল, ফাল্গুনী চক্রবর্তীর ব্যবহার নাকি চুনী কোটালের মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়ার মতো 'প্রচারণামূলক' ছিল না।

সম্প্রতি আরজি কর কাণ্ডে উত্তাল হয়েছে দেশ। এই ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়ায় পক্ষপাত রয়েছে বলে বিক্ষোভকারী চিকিৎসকরাই দাবি করেছেন। তাঁদের এমন সন্দেহের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যেমন, মৃতা চিকিৎসকের বিভাগীয় প্রধান বলেছিলেন, তিনি মরদেহ দেখে শিউরে উঠেছিলেন। অর্থাৎ ওটা যে স্বাভাবিক ঘটনা নয় তা বোঝাই গিয়েছিল। তাহলে তারপরও আত্মহত্যার কথা চাউর করা হলো কেন? ১০ ফুট দূরত্বে নার্সিং স্টেশন, তবু কেউ কিছু শুনতে পেলেন না কেন? বাবা ও মা বলছেন, তাঁদের ৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় হাসপাতালে। কেন এই দেরি? জানা যাচ্ছে, বিভাগীয় প্রধান জানার আগেই ঘটনাস্থলে নাকি পুলিশ পৌঁছে গিয়েছিল। অন্যান্য ইউনিটের চিকিৎসকরাও পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, কারা ডাকলেন পুলিশকে? এই ঘটনাকে প্রথমে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা হলো কেন? এই মুহূর্তেই ঘটনাস্থল লাগোয়া ঘর সংস্কার করতে হচ্ছে কেন? টেন্ডার বা লিখিত নির্দেশ ছাড়া কীভাবে সংস্কারের কাজ শুরু হলো? আর এই নির্দেশই বা দিয়েছিল কে? বুধবার রাত ১২টায় যখন দেশজুড়ে মহিলাদের 'রাত দখল' কর্মসূচি হচ্ছে তখনই কেন হামলা হলো আরজি করে? তথ্য লোপাটেই কি মরিয়া হয়ে উঠেছে শাসকশিবির? প্রশ্ন উঠছে, ঠিক কতটা দুর্নীতি করে থাকলে, এইভাবে সাফাই অভিযানে নামতে হয়?

আরও পড়ুন- যৌনাঙ্গে রড, দেহ ৩৫ টুকরো! অপরাধীকে নৃশংসতা শেখায় আসলে কারা?

প্রথম থেকেই আঙুল উঠছে, সদ্য প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের দিকে। তাহলে এতদিন কেন তদন্তের আওতায় আনা হয়নি তাঁকে?শাসকসিবির এখন একটা কথা বলেই বারবার বুক বাজাচ্ছে যে, পুলিশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই একজনকে গ্রেফতার করেছিল। পুলিশ জানিয়েছিল, জেরায় নাকি ধৃত সঞ্জয় রায় খুনের কথা স্বীকারও করে নিয়েছে। কিন্তু ধৃত ব্যক্তিকে নিয়ে কোনও স্পষ্ট কথা বলেননি কমিশনার। উল্টে সাংবাদিকরা ধৃত ব্যক্তির পেশা জানতে চাইলে খানিক বিরক্তই হয়েছেন। তিনি বারবার বলে গিয়েছেন, ধৃত ব্যক্তি দোষী, তার পেশা এখন বলা যাবে না। অন্যদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনও ভিডিও বার্তাও প্রকাশ করা হয়নি। এতে অস্বচ্ছতা তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে আবার তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এনকাউন্টারের কথা বলে ফেলেছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, দোষীর আবার কীসের পেশা! ক্রিমিনাল তো ক্রিমিনালই! সেদিন তৃণমূল নেতার কথার সঙ্গে অনেকেই কমিশনারের কথার মিল পেয়েছিলেন। হতেই পারে ধৃত ব্যক্তি দোষী কিন্তু সেই প্রমাণ সামনে আনা জরুরি। ধনঞ্জয়ের ক্ষেত্রে যেভাবে একের পর এক গল্প সাজিয়ে তাঁকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়েছিল, তার আরও একবার পুনরাবৃত্তি চায় না দেশ। তাই উপযুক্ত নথির ভিত্তিতেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে যাচ্ছে মানুষ।

কিছুদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এই ঘটনায় আরও অনেকে জড়িত। কিন্তু এখনও কোনও তথ্য সামনে আসেনি। মনে রাখতে হবে, চুনী কোটালের রিপোর্ট পেয়ে গেলেও তা প্রকাশ করা হয়নি। দোষীদের দিনের পর দিন আগলে রেখেছিল শাসকগোষ্ঠী। এমন আশঙ্কা থাকছেই আরজি করের মহিলা চিকিৎসকের ঘটনা নিয়েও। উল্লেখ্য, কলকাতার হাইকোর্টের নির্দেশে আরজি কর কাণ্ডে তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে সিবিআইকে। বলে রাখা ভালো, এ রাজ্যের ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর সিবিআইয়ের দায়িত্বে প্রায় ৩০টি গুরুতর অভিযোগের তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। ছোট-বড় মিলে প্রায় ৩০০টি অভিযোগের তদন্তভার। সিবিআই সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশনকে জানিয়েছিল, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁদের ১,৩৭৪টি পদ শূন্য ছিল। এক্সিকিউটিভ পদমর্যাদার অফিসার এবং ল অফিসার পদেই প্রায় ১০০০টি শূন্যপদের কথা উল্লেখ ছিল। তদন্ত ও মামলার অগ্রগতিতে এই পদগুলির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। তখনই সিবিআই জানিয়েছিল, তাদের ১,১১৭টি অপরাধের তদন্ত বাকি আছে। এতদিনে তা নিশ্চয়ই দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। পরের বছর এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা জানায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের দায়িত্বে ৯,৭৫৭টি মামলা ছিল। এই মামলাগুলোর মধ্যে ৩,২৪৯টি মামলা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তাধীন। পাঁচ বছরে ৫০০ মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি। সে সময় বকেয়া মামালাগুলিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। সংখ্যা ছিল ৯০৫টি। বিপুল মামলার তদন্ত করার মতো লোকবল যে এই কেন্দ্রীয় সংস্থার নেই তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তো থাকছেই। এই ব্যাপারে রাজ্য এবং কেন্দ্রের তদন্তের কোনও ফারাক নেই। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, শীর্ষ আদালতের কি অনেক আগেই রাজ্য এবং কেন্দ্রের তদন্তের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা কর্তব্য ছিল না? এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসেছে, আরজি কর কাণ্ডের বিচার পেতে কাউকেই আর ভরসা করা যাচ্ছে না। দোষী প্রমাণের দায় তাহলে কার?

More Articles