কাশ্মীর থেকে মণিপুর, ক্ষমতার হাতিয়ার যখন 'ধর্ষণ'
Manipur Violence: কাশ্মীর থেকে দিল্লি, মণিপুর থেকে উত্তরপ্রদেশে, ছবিটা কিন্তু একই। প্রতিটা দাঙ্গা, প্রতিটা সাম্প্রদায়িক অশান্তি শেষে তাই এমন ধর্ষিত, ক্ষতবিক্ষত দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে রাস্তাঘাটময়।
'মানুষ বড় সস্তা কেটে ছড়িয়ে দিলে পারতো।'- আর সে যদি মেয়েমানুষ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তার উপর যদি সে 'নীচু জাত' হয়ে থাকে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সেই শরীর, সেই মেয়েমানুষের শরীরকে যেমন খুশি ছিঁড়েকুটে ভোগ করে ফেলে দেওয়া যায় আস্তাকুঁড়ে। আরও একটু দয়া হলে বেঁধে ফেলা যায় প্লাস্টিকের ব্যাগে। আর এই গল্পে আরও মশলা যোগ হতে পারে, তাতে যদি একটা সাম্প্রদায়িক হানাহানির কোণ গুঁজে দেওয়া যায়, কিংবা ঢুকিয়ে দেওয়া যায় প্রতিহিংসার অঙ্ক। তখন অপরাধের হিসেব-নিকেশ পাল্টে যায়। সংবিধানের সমস্ত আইনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়। যেখানেই সাম্প্রদায়িক হিংসা, যেখানেই বদলার অঙ্ক, সেখানে এমন দু-একটা লাশ পড়ে। বড় বড় দেশে এমন অজস্র ছোট ছোট ঘটনা ঘটে হোরাশিও।
আরও পড়ুন: নির্বিচারে খুন-ধর্ষণ, বন্ধ্যা করে দেওয়া! চিনে কতটা অত্যাচারের মুখে উইঘুর মুসলিমরা
আসলে ধর্ষণ মানে শুধুই বিকৃতকাম কিংবা শারীরিক লালসা বা কামনা চরিতার্থ করা নয়। ধর্ষণের মধ্যে সার্বিক ভাবেই লুকিয়ে থাকে আসলে ক্ষমতাবানের শক্তিপ্রদর্শন। ধর্ষণ আসলে দুর্বলকে সীমানা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, প্রতিহিংসার আগুনে সেঁকে নেওয়া ক্ষমতাবানের পুরুষত্বকে। কাশ্মীর থেকে দিল্লি, মণিপুর থেকে উত্তরপ্রদেশে, ছবিটা কিন্তু একই। প্রতিটা দাঙ্গা, প্রতিটা সাম্প্রদায়িক অশান্তি শেষে তাই এমন ধর্ষিত, ক্ষতবিক্ষত দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে রাস্তাঘাটময়।
ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রতিটি বড় যুদ্ধ, লড়াই সংগ্রামের অতীতের সঙ্গে মিশে রয়েছে নারীদের অত্যাচারের গল্প। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খান-সেনাদের ব্যাপক অত্যাচার হোক বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় মহিলাদের উপর চূড়ান্ত নিপীড়ন, দেশ-কাল-ধর্ম ভেদে নারীদের উপর অত্যাচার আসলে ক্ষমতার আস্ফালন দেখানোর এক অস্ত্র। সীতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া বা ভরাসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ দিয়ে যে নারীনির্যাতনের ইতিহাস তৈরি হয়েছিল, সেই পরম্পরা সমান তালে বজায় রয়েছে আজও। তবে সেই সব কিছুর নেপথ্যে যত না কাম বা লালসা ছিল, তার চেয়েও ছিল প্রতিহিংসা। আজও ভারতের অলিগলি শহরতলি থেকে নারী নির্যাতনের খবর কানে আসে মুহুর্মুহু। কখনও সম্মান রক্ষার নামে পরিবারের হাতে খুন তো কখনও শরীরটাকে কেটে কুচি কুচি করে ফেলেছে দীর্ঘসময়ের প্রেমিক। কখনও বা বছর দশেকের শিশুকন্যার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একদল রাক্ষস, এ সব কোনও নতুন ঘটনা নয়। কখনও সম্মান, কখনও লালসা তো কখনও প্রতিহিংসা। তবে এবার মণিপুর দেখল এক নয়া সমরকৌশল।
আজ থেকে নয়। বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই অশান্তিতে জেরবার মণিপুর। জাতি হিংসায় কার্যত জ্বলছে উত্তরপূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যটি। গত দু-মাসে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৪২ জনের। হাজার খানেক এফআইআর, আরও কয়েক হাজার পুলিশি আটক, তার পরেও শান্তি ফেরেনি। বরং প্রতিদিন উত্তরোত্তর বাড়ছে অশান্তি। আর সেই হিংসাকে আরও কয়েক গুণ বাড়াতে এবার দেখা গেল এক অভিনব অস্ত্রের ব্যবহার।
কিছুদিন আগেই ভাইরাল হয়ে যায় প্লাস্টিক পেঁচানো একটি মৃতদেহের ছবি। রটে যায়, মেইতেই সম্প্রদায়ের ওই মেয়েটিকে নৃশংস অত্যাচার করে খুন করা হয়েছে। অভিযোগের তির ওঠে কুকি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। খুব শিগগিরই মণিপুরের চুড়াচাঁদপুরে ভাইরাল হয়ে যায় ছবিটি। হিংসায় ঘি ঢালে ওই ঘটনা। ফের নতুন করে বেঁধে যায় অশান্তি। মে মাসের তিন তারিখ নাগাদ ফের উত্তাল হয়ে ওঠে মণিপুর।
সম্প্রতি জানা গিয়েছে, ওই ছবিটি আসলে ভুয়ো। না, মৃতদেহে মিথ্যা নেই। মিথ্যা রয়েছে পরিচয়ে। প্লাস্টিকবন্দি ওই দেহটি আদতে আয়ুশী চৌধুরী নামে এক দিল্লির মেয়ের। অত্যাচার তাঁর উপরেও হয়েছে। সম্মান রক্ষার নামে তাঁকে খুনের অভিযোগ স্বয়ং তাঁর বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে। সেটা ২০২২ সালের নভেম্বরের ঘটনা। সেই দেহের ছবিটিই চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল মণিপুরের এক নার্সিং পড়ুয়ার বলে। পরে সামনে আসে আসল ঘটনা। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ছড়িয়ে গিয়েছে প্রতিহিংসার আগুন। মেইতেই সম্প্রাদায়ের লোকেরা চড়াও হয় কুকি-মেয়েদের উপরে। কারণ 'খুনের বদলা যে খুন, লাশের বদলা লাশ' এ কথা তো ততদিনে জানাই। তাই মেইতেই মেয়ের সম্মানহানির বদলা হিসেবে টান মারো অন্য মেয়ের শাড়ির আঁচল ধরে। জনসমক্ষে বিবস্ত্র করো, লুটে নাও ইজ্জত, নৃশংস ভাবে ধর্ষণের পর ধানক্ষেতে ফেলে রাখো ক্ষতবিক্ষত শরীর। কারণ ভিতরে জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন, শরীরে খেলছে জাতি হিংসার বীজ। তাই মানুষে মানুষে হানাহানি লাগিয়ে দাও। পরখ করে নাও, কে বেশি শক্তিবান। কারণ ডারউইন বলে গিয়েছেন, যোগ্যতমরাই বেঁচে যান, বেঁচে থাকেন, শাসন করেন। এ দুনিয়া আসলে ক্ষমতাবানের। ইতিহাস থেকে রাজনীতি, বারবার তা প্রমাণ করেছে।
সেদিন কুকি-ঘরে ঢুকে এসেছিল একদল মেইতেই, কেউ পনেরো তো কেউ পঞ্চাশ। নেশার ঘোরে টলতে টলতে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে গিয়েছিল বাড়ির মেয়েদের। চল্লিশ বছর থেকে তেরো, বাদ যাননি কেউই। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিষ্ণুপুর জেলার তৌবুল গ্রামের একটি ধানক্ষেতে। খেলা চলেছিল বদলার। চিৎকার করে আস্ফালন করেছিল তাঁরা, "আমরাও তোমাদের সঙ্গে তাই করব, যা তোমাদের লোকেরা আমাদের মেয়ের সঙ্গে করেছে।"
আরও পড়ুন: হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
অর্থাৎ ধর্ষণ তত বড় অন্যায় নয়, যতটা 'ওরা-আমরা'-র এই লড়াই। তাই একটি অন্যায়ের সুবিচার খুঁজতে সেরে ফেলা যায় একই রকম আরও একাধিক অন্যায়। আইন, আদালত প্রহসন হয়ে লুটিয়ে থাকে রাস্তায়। সেদিন যে চৃড়ান্ত প্রতিহিংসার বর্বর ছবি মণিপুর দেখল, তা বোধহয় ভাবনার বাইরে। তবে সত্যিই কি এই ছবি নতুন? কাশ্মীরের সেই বাখরওয়াল সম্প্রদায়ের বছর আটেকের ছোট্ট মেয়েটিকে মনে আছে? যাকে গ্রামের মন্দিরে গণধর্ষণ করে উপড়ে নেওয়া হয়েছিল চোখ। সেই ঘটনাতেও কিন্তু কাম নয়, কাজ করেছিল উচ্চবর্ণে প্রতিহিংসা, ক্ষমতার আস্ফালনই। নিম্নবর্গ, তথাকথিত 'ইতর' শ্রেণিকে নিজেদের জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, উন্নাও থেকে হাথরাস- প্রায় সমস্ত ধর্ষণের ঘটনাতেই কোনও না কোনও ভাবে দুর্বলকে 'সবক' শেখানোর এক অন্ধ ইচ্ছা লুকিয়ে থেকেছে আজীবন। যেমনটা হয়েছিল মহাভারতে। যেমন করে পঞ্চপাণ্ডবের সামনে দ্রৌপদীর বস্ত্র খুলে নিয়ে তাঁদের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কৌরব। যেমন করে সীতাকে অপহরণ করে রামকে তাঁর জায়গা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রবল পরাক্রমী রাবণ, সেই পরম্পরা থেকে টলেনি আজকের ভারতবর্ষও।