মিষ্টি বিনে প্রাণ মজে না? রোগ বালাই এড়াতে চিনির বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এই দ্রব্যগুলি
Sugar Control Tips: মিষ্টির স্বাদ আস্বাদনের জন্য বিভিন্ন ফল খেতে পারেন আবার মিষ্টি খাওয়ার নিতান্তই যদি খুব ইচ্ছা হয় তাহালে খাবার শেষ পাতে রাখতে পারেন একটুকরো ডার্ক চকলেট।
ডায়াবেটিস এবং ওবেসিটি– এই দু’টি রোগ যেন প্রায় প্রতি ঘরেই নিজেদের থাবা বসিয়েছে। অনেকে আবার বলতে পারেন, ওবেসিটি আবার রোগ হল কবে থেকে? ঠিকই, ওবেসিটি নিজে পুরোপুরি রোগ হয়তো নয় কিন্তু অতিরিক্ত ওজন যে একসঙ্গে কতগুলো রোগের জন্ম দিতে পারে তা হয়তো আমরা আক্রান্ত হওয়ার আগে কল্পনাও করতে পারি না। স্বভাবে এবং ধর্মে একে অপরের থেকে আলাদা হলেও, এই দু’টি রোগ থেকে মুক্তি লাভের প্রথম শর্ত হল নিজের প্রাত্যহিক জীবন থেকে চিনি নামক উপাদানটিকে একেবারে বাতিল করে দেওয়া। তবে বাঙালির আবার শেষ পাতে মিষ্টি না হলে চলে না। অনেকে তাই মজা করে বলেন, বাড়িতে মিষ্টি না থাকলে বাঙালিরা নাকি শেষ পাতে একটু চিনি খেয়ে নেন। তা এইরকম যাদের অবস্থা, তাদের জীবন থেকে মিষ্টি একেবারে বাদ দিতে গেলে যে রীতিমতো নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হবে তা বোধহয় বলার অবকাশ রাখে না। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর তালিকায় ঠিক কী কী রয়েছে একবার দেখে নেওয়া যাক।
১। ম্যাপেল সিরাপ
- গুণাগুণ – ম্যাপেল সিরাপে রয়েছে ভরপুর মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এছাড়াও রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক এবং আয়রনের মতো প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি। উপকারি উপাদান দেখে কিন্তু তা আবার মাত্রারিক্ত গ্রহণ করতে যাবেন না, পরিমিত মাত্রায় এই সিরাপ গ্রহণ করলে তবেই মিলবে পুষ্টিগুলি।
- ব্যবহার – সচরাচর ব্রেকফাস্টের বিভিন্ন রেসিপিতে ম্যাপেল সিরাপ অধিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। চিয়া পুডিং, ওটমিল, স্মুদি, ফ্রুট কাস্টার্ড অথবা টক দইতে ম্যাপেল সিরাপের জুড়ি মেলা ভার। তেমনই আবার প্যান কেক এবং ওয়েফেলসেও রমরমিয়ে চলছে ম্যাপেল সিরাপের ব্যবহার। আর আপনি যদি স্বাস্থ্য বিষয়ে ভীষণই সচেতন হন, তবে চা বা কফিতেও এই সিরাপের ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া হট চকলেট প্রস্তুতিতেও ম্যাপেল সিরাপ হয়ে উঠতে পারে একটি আদর্শ উপকরণ।
২। খেজুরের পেস্ট
- গুণাগুণ – বহুকাল থেকেই আমাদের মনে খেজুর সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, তা হল – খেজুর খেলেই আমাদের ওজন নাকি হু হু করে বেড়ে যাবে। বর্তমান বিজ্ঞান কিন্তু আর এমনটা বলছে না। চিনির বিকল্প হিসাবে এখন অনেক ডায়েটিশিয়ানরাই খাবারে খেজুর ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূরীকরণে সকালবেলা দুধে ভেজানো খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডাক্তাররা। তাই বোঝাই যায়, খেজুরে ফাইবারের পরিমাণ রয়েছে অনেক বেশি, তেমনই বেশি, খনিজ এবং ভিটামিনের পরিমাণও। তাই এক চামচ চিনির পরিবর্তে দু’টো খেজুর আপনার শরীরের জন্য অনেক বেশি উপকারী।
- ব্যবহার– খেজুরের পেস্ট আপনি বাজার থেকেও কিনে আনতে পারেন আবার চাইলে বাড়িতেও বানিয়ে নিতে পারেন অতি সহজেই। মিক্সিতে পরিমাণ মতো আগে থেকে ভিজিয়ে রাখা খেজুর এবং জল দিয়ে একবার ব্লেন্ড করলেই তৈরি হয়ে যাবে খেজুরের পেস্ট, অতিরিক্ত স্বাদের জন্য একটু ভ্যানিলা এসেন্স যোগ করা যেতে পারে। খেজুরের পেস্ট স্মুদি কিম্বা ফ্রুট কাস্টার্ডে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন-নিম্নচাপে ভাসবে শহর, এমন বৃষ্টি কি চলবে পুজো অবধি?
৩। মধু
- গুণাগুণ - সেই প্রাচীনকাল থেকে ভারতে মধুর ব্যবহার চলে আসছে। শীতকালে ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রেহাই পেতে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই মধু ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মধুতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিভিন্ন উপকারী খনিজ দ্রব্য এবং ভিটামিন। তবে মনে রাখতে হবে, চিনির থেকে কিন্তু মধুর ক্যালোরি মাত্রা বেশি। তবে মধু হজম করা চিনির থেকে অনেক বেশি সহজ। তাই আপনি যদি চিনির বিকল্প হিসাবে মধুকে বেছে নেন তবে তা সীমিত মাত্রায় ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
- ব্যবহার – মধু মূলত বিভিন্ন স্মুদি, ওটমিল, চিয়া পুডিং, স্যালাডের ড্রেসিং হিসাবে বা বিভিন্ন বেকড পণ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যদিকে সকালবেলা উষ্ণ গরম জলে লেবু-মধু আপনার শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে বিশেষভাবে সক্ষম। মধু যেহেতু স্বাদে চিনির থেকে অনেক বেশি মিষ্টি তাই প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মধু কিন্তু চিনির চাইতে কম পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
৪। মঙ্ক ফ্রুট সুইটনার
- গুণাগুণ– যারা ক্যালোরি এবং ওজন কমাতে চান বা যারা মধুমেহ রোগের শিকার তাদের জন্য মঙ্ক ফ্রুট একটি আদর্শ বিকল্প হতে পারে। চিনির থেকে প্রায় ২০০-৩০০গুণ অধিক মিষ্টি হওয়ার কারণে পরিমাণেও কম ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এফডিএ এর তথ্যানুসারে, মঙ্ক ফ্রুট হল একটি জিরো-ক্যালোরি এবং জিরো-সুগারের উপাদান। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসেসড মঙ্ক ফ্রুটে শর্করা এবং অন্যান্য সুইটনার মিশ্রিত থাকতে পারে তাই কেনার সময় খানিক দেখেশুনে কিনতে হবে।
- ব্যবহার– মঙ্ক ফ্রুট সুইটনার অত্যন্ত মিষ্টি হওয়ার কারণে খাবার পরেও অনেকসময় এর স্বাদ থেকে যায়, এমনটা হলে সরাসরি কোনও খাবারে ব্যবহার করার পরিবর্তে বেকিংয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও সরাসরি ব্যবহার করতে চাইলে অতিরিক্ত সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।
৫। স্টিভিয়া
- গুণাগুণ– স্টিভিয়া হল একটি উদ্ভিদের নির্যাস। একদিকে স্টিভিয়া যেমন স্বাদে চিনির থেকে অনেকটাই মিষ্টি, তেমনই এর ক্যালোরি মাত্রাও অনেক কম। তাই ডায়বেটিস আক্রান্ত মানুষদের জন্য স্টিভিয়া একটি উন্নতমানের বিকল্প হতে পারে। আবার অন্যদিকে, যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করেছেন তারা এর ব্যবহার করতে পারেন।
- ব্যবহার– স্টিভিয়ার কোনও সাইড এফেক্ট না থাকলেও, আফটার-টেস্ট রয়েছে। তাই সরাসরি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মিষ্টতা এড়াতে আপনাকে সচেতন মাত্রায় তা ব্যবহার করতে হবে। স্টিভিয়া পাউডার এবং সিরাপ দুভাবেই পাওয়া যায়, কোনটি ব্যবহার করতে আপনার বেশি সুবিধা হবে, তা বিবেচনা করে বেছে নিতে পারেন, আবার চাইলে দু’টোই ব্যবহার করতে পারেন। স্বাস্থ্য প্রেমীরা কিন্তু এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই স্টিভিয়ার ব্যবহার করে থাকেন।
৬। Acesulfame Potassium
- গুণাগুণ- Acesulfame Potassium হল একটি কৃত্রিম সুইটনার। দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে অথবা রক্তে শর্করার মাত্রা সীমিত রাখার উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও এটি জিরো ক্যালোরি বিশিষ্ট হওয়ার কারণে যারা ওজন কমাতে ইচ্ছুক তারাও ব্যবহার করতে পারেন।
- ব্যবহার- Acesulfame Potassium সরাসরি খাবারে যোগ করার পাশাপাশি বেকিংয়ের কাজে অথবা রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও ক্যান্ডি বা ফ্রোজেন ডেসার্টে অথবা বিভিন্ন পানীয়তে এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চিনির থেকে প্রায় ২০০ গুণ বেশি মিষ্টি হওয়ায়, আর্থিক সাশ্রয়ের ক্ষেত্রেও আপনার সহায়তা করবে এই Acesulfame Potassium।
আরও পড়ুন-Karim’s vs Kareem’s: এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়! পুজোয় কোথায় কোন বিরিয়ানি সেরা?
৭। তাল পাটালি
- গুণাগুণ– চিনির একটি আদর্শ বিকল্প হতে উঠতে পারে আমাদের তাল পাটালি। শীতের সময় বেশি পরিমাণে কিনে রেখে, সারাবছর খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারা যায় পাটালি গুড়কে। আমরা অনেকেই হয়তো মনে করি গুড় যেহেতু স্বাদে মিষ্টি তাই হয়তো এর ক্যালোরি বা গুণাগুণ হবে চিনির মতোই। কিন্তু না, ছোট্ট একটুকরো পাটালি গুড়ের গুণাগুণের সামনে চিনির কার্যকারিতা কিছুই নয়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর তাল পাটালি যেমন হজম করা অনেক সহজ তেমনই সমৃদ্ধ উপকারী বিভিন্ন খনিজে। খেজুরের গুড় সমৃদ্ধ আয়রনে এবং ম্যাগনেসিয়ামে। একদিকে যেমন একটুকরো তাল পাটালি আপনার শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করবে তেমনই আবার এতে অবস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বাইরের ক্ষতিকর জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করে শরীরকে রাখবে সতেজ এবং রোগমুক্ত। এটি আবার ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং পটাসিয়ামেও সমানভাবে সমৃদ্ধ।
- ব্যবহার– গুড় প্রায় সবক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যেতে পারে। গুড় দিয়ে প্রস্তুত চা অথবা কফি তো আজকাল বেশ ট্রেন্ডিং। রান্নায় যাদের আবার অল্প চিনি না দিলে একেবারেই চলে না, তারাও চিনির পরিবর্তে গুড়ের ব্যবহার করতে পারেন। অন্যদিকে পায়েস বানানোর জন্য গুড়ের থেকে ভালো অপশন তো আর কিছু হতেই পারে না।
উপরের বিকল্পগুলি ছাড়াও অন্যভাবে আপনি চিনি থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন। মনে রাখবেন, যতই আমরা বিকল্পের কথা বলি না কেন, আসলে মধুমেহ রোগ বা ওজন কমানোর জন্য সবচেয়ে ভালো পথ হল যতটা সম্ভব মিষ্টি এড়িয়ে চলা। কিন্তু তাই বলে কি মিষ্টির স্বাদ কাকে বলে তা একেবারেই ভুলে যাবেন! তা নয়। মিষ্টির স্বাদ আস্বাদনের জন্য বিভিন্ন ফল খেতে পারেন আবার মিষ্টি খাওয়ার নিতান্তই যদি খুব ইচ্ছা হয় তাহালে খাবার শেষ পাতে রাখতে পারেন একটুকরো ডার্ক চকলেট। সাধারণ গরুর দুধের পরিবর্তে রাখতে পারেন বাদামের দুধ, তাতে খানিক হলেও আপনি মিষ্টির স্বাদ পাবেন। শুধু টক দই খেতে যদি একেবারেই না ভালো লাগে তবে তাতে অল্প একটু ফল কিম্বা শশা কুচি মিশিয়ে নিতে পারেন অথবা দই দিয়েই বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে ঘোল যা আপনার শরীরকেও ঠান্ডা রাখবে আবার পরিপাকেও সাহায্য করবে। নিজেকে ভালো রাখার উপায় প্রত্যেক মানুষকে নিজে থেকেই খুঁজতে হয়। সকলেরই তো জানা, “কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না।”