ভারতকে দেখেছিলেন এই কাঁচের মধ্য দিয়েই, দেশ বাঁচাতে পারেনি গান্ধীর চশমাটুকুও!

Gandhi Spectacles: ৫ মার্চ, ২০০৯ সালের দুপুরবেলা নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে নিলামে বিক্রি হয়ে যায় মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত চশমাখানি। ক্রেতা এক ভারতীয় এবং তাঁর নামটি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য-  বিজয় মাল্য।

রোগে ভুগে নয়, আততায়ীর গুলিতে ইষ্টনাম উচ্চারণ করতে করতে তিনি ইহজীবন শেষ করতে চান। সাক্ষী থাকবেন তাঁর চিরঅনুগত মৃদুলা বেন গান্ধী তথা মনু। মহাত্মার এই অভিপ্রায় মনুর ডায়েরিতে লেখা আছে। ঘটনাচক্রে হলও তাই। ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮, দিল্লির বিড়লা ভবনে ভগবদ্‌গীতা পাঠ শুনে দিন শুরু করেন গান্ধী। তারপর অশক্ত শরীরে কিছুক্ষণ কিছু লেখালিখি করেন। স্নান শেষে তাঁর ওজন নেওয়া হয়। দেখা গেল, ওজন ৪৯.৭ কেজি। বয়স তখন ৭৮। সেদিন বিকেলে দু’জন দেখা করতে এলে মনুবেনকে মহাত্মা বলেন, “ওদের বলে দাও যে, যদি আমি বেঁচে থাকি, তা হলে আজ সন্ধের প্রার্থনাসভার পরে ওদের সঙ্গে দেখা হবে।” 

গান্ধী যেন কালঘড়ির ডাক শুনে ফেলেছেন। বুঝতে পারছেন মৃত্যু আসন্ন। শুধু প্রহর গুনছেন।  অবশেষে মৃত্যু এলো। প্রার্থনাসভায় ভিড় ঠেলে খাকি পোশাক পরা একজন যুবক এগিয়ে আসেন গান্ধীর দিকে।  সকলে হতচকিত হয়ে যায় চারবার গুলির আওয়াজে। দেখা যায় বুলেট সরাসরি বুকে বিঁধেছে, গান্ধী লুটিয়ে পড়েছেন মাটিতে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ভারতভূমি। গান্ধীর মুখনিসৃত শেষ বাক্য ছিল, হে রাম!

বলা বাহুল্য, গান্ধীর ধারণায় যিনি রাম তিনি আজকের ভারতে বহুচর্চিত রাম নন। বরং গান্ধীর রাম একটি ব্যাপক অভিঘাতপূর্ণ শব্দ। তিনি নিজেই বলেছেন, "আমার রাম বা আমরা যে রামের ভজনা করি, তিনি দশরথপুত্র অযোধ্যার রাজা ঐতিহাসিক রাম নন। আমাদের রাম সনাতন, অদ্বিতীয়। এই রাম সকলের।"

আরও পড়ুন- তাঁকে ছাড়া অচল ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, দেশ ভুলেছে মহাদেব দেশাইকে

গান্ধী নিজেকে 'সনাতন হিন্দু' বলে দাবি করতেন কিন্তু সহনশীলতা ছিল তাঁর মর্মের অলংকার। গান্ধী বলতেন, হিন্দুত্বের সঙ্গে মুসলমানি, খ্রিস্টানির কোনও বিরোধই নেই। গান্ধীকল্পিত রামরাজ্য আসলে এক প্রকৃত সুশাসনের প্রতিশ্রুতি যেখানে নাগরিকদের কোনও ফার্স্ট এবং সেকেন্ড ক্লাস নেই। গান্ধী বিশ্বাসও করতেন, প্রতিটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বাঁচতে হবে একে অন্যের থেকে শিখে, একে অন্যের সঙ্গে সহাবস্থান করে। অন্যদিকে, একদা গান্ধীভক্ত নাথুরাম মনে করেছিলেন, গান্ধীর আদর্শগত স্থিতিস্থাপকতা, সহনশীলতা আসলে সনাতন হিন্দুধর্মের ক্ষতি করছে। নাথুরাম তো গান্ধীকে হত্যা করলেন কিন্তু গান্ধী কি আদৌ মারা গেলেন বা, ফিকে হলেন? 

গান্ধী গবেষকদের একটা বড় অংশ মনে করেন, গোটা দেশে যখন অস্থিরতা, হিংসার বাতাবরণ, বিষের বাষ্প, তখন নিজের অস্তিত্বকে, আদর্শকে চিরপ্রতিষ্ঠা দিতে গান্ধীর নিজেরই এমন মৃত্যু কাঙ্খিত ছিল। জীবিত গান্ধীর চেয়ে মৃত গান্ধী অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে জাতিকে নতুন করে আষ্টেপৃষ্টে জুড়লেন। তাঁর  মৃত্যুতে ভাত চড়েনি কোনও ঘরে। জাতির চোখের জলেই পুনর্জন্ম হয়েছে গান্ধীর। চর্চা শুরু হয়েছে তার চিন্তন নিয়ে। সেই চর্চা আজ নতুন ডিসকোর্সের জন্ম দিয়েছে। 

প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে গান্ধী জন্মান। আমাদের বিবেকের মৃত্যুতে, সাম্প্রদায়িক হিংসার, ভ্রাতৃহত্যার রণাঙ্গনে, শঠতা আর আইপিএলের নিদ্রিত ভারতে গান্ধী রোজ জেগে থাকেন। আজ আর গান্ধী কোনও ব্যক্তি নন, তিনি এক বোধের নাম, যে বোধের সঙ্গে কারও চিন্তার ফারাক থাকতেই পারে কিন্তু গান্ধীকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। 

কিন্তু গান্ধীকে আমরা কতটা রাখতে পারলাম, সে প্রশ্নও আসে। ৫ মার্চ, ২০০৯ সালের দুপুরবেলা নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে নিলামে বিক্রি হয়ে যায় মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত চশমাখানি। ক্রেতা এক ভারতীয় এবং তাঁর নামটি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য-  বিজয় মাল্য। "মাল্য কিনে নিলেন গান্ধীর চশমা" এমন একটি শিরোনাম মিডিয়ার ব্যবসার জন্য আদর্শ হতে পারে হয়তো কিন্তু তা একটি অনিবার্য প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। একটু জটিল প্রশ্ন। গান্ধীর মতামতে যতটা গান্ধী রয়েছেন, গান্ধীর জীবনদর্শনে যতটা গান্ধী রয়েছেন, সেই একই পরিমাণ 'গান্ধী' কি তাঁর চশমাটির (যাকে, তাঁর জীবনদর্শনের একটি অন্যরকম 'প্রতীক' হিসেবেও ভাবা হয়ে থাকে) মধ্যেও রয়েছেন? যেহেতু, তা শেষমেশ একটি বস্তুই, তাই কোথাও গিয়ে পুঁজিবাদের কাছে মাথা নত করে ফেলাই কি তার ভবিতব্য?

আরও পড়ুন- আজীবন ঝর্না কলমের চরম বিরোধী মহাত্মা গান্ধী, যে কথা মনে রাখেনি কেউ

গান্ধী চশমাটি কিনেছিলেন বিলেতে আইন পড়ার সময়। কর্নেল এইচ এ শ্রী দিওয়ান নবাবকে এই চশমাটি গান্ধী দেন ১৯৩০ এর দশকে। তিনি নাকি বলেছিলেন, এই চশমা তাঁকে ভারতদর্শন বুঝতে শিখিয়েছে।

একথা ভাবতে তো খারাপ লাগে যে, গান্ধী যে চশমা দিয়ে ভারতকে দেখলেন, তার আত্মাকে দেখলেন, সেই চশমার মালিক হলেন  এমন ব্যক্তি, যিনি ঘটনাচক্রে দেশের অন্যতম বড় ঋণখেলাপি এবং পলাতক। উল্লেখ্য যে, ভারত সরকার এই নিলাম বন্ধের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও সেই চশমা নিলাম আটকাতে পারেনি। 

আজ ২ অক্টোবর ২০২২, যে রণরক্ত সফলতার দোলাচলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভারতরাষ্ট্র, তাতে বারবার মনে হয় আমাদের আসলে ফেরত চাই গান্ধীর চশমাখানি। ভারত ভুলপথে চলেছে তা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে পারে গান্ধীর চোখজোড়াই।

 

তথ্য সূত্র: লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ

More Articles