লোহার চেনে গঙ্গাকে বেঁধে ফেলেছিলেন, শূদ্র কন্যা রাসমণি উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম মুখ

হালিশহর গিয়েছেন কলকাতার নামকরা জমিদার প্রীতিরাম দাস এবং তাঁর নায়েব। জমিদারির প্রাচুর্য সত্ত্বেও তাঁর মনে বড় দুঃখ। ছেলে রাজচন্দ্রের  বিয়ে হয় না। এমন সময় এক ফুটফুটে কিশোরীকে দেখলেন তিনি। মেয়েটাকে বড়ই মনে ধরল তাঁর। আহ্লাদী গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমার নাম কী মা?'। মেয়ে তো অবাক। এমন শহুরে বাবু কোনোদিন দেখেনি সে। কী ঝলমলে পোশাক। লাজুক গলায় সে বলল, 'রাসমণি'। রাসপূর্ণিমার দিন তুলসী মঞ্চের পাশে বসে রামায়ণ পাঠ করে, পাড়ার লোকেদের হরির লুট দিয়ে তার বাবা মা এই নাম রেখেছেন। কালে কালে ইনিই বাবু রাজচন্দ্র দাসের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী হয়ে কলকাতা আসবেন। 'নববঙ্গের নবযুগের চালক' হয়ে স্থাপন করবেন দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির। সে মন্দিরের পুরোহিত হবেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। আপামর বাঙালি যাঁকে চেনে শ্রীরামকৃষ্ণ নামে। টিভি সিরিয়ালের দৌলতে এসব গল্প আজ হয়ত অনেকেই জানেন। কিন্তু রাসমণির কিসসা কাহিনি শুধু দক্ষিণেশ্বর স্থাপনেই থেমে ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় তাঁর ছিল প্রবল প্রতাপ। সে প্রতাপের ফলে স্বয়ং ইংরেজরাও তাঁর সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। একবিংশ শতাব্দীর বাঙালির স্মৃতিতে সেসব গল্প ফিকে হয়ে এসেছে। 

সময়টা ছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। রানী রাসমণির জানবাজারের বাড়ির বাইরে একদিন হঠাৎ হাহাকার রব উঠল। প্রচুর মানুষ যেন নানান দাবি নিয়ে আর্তনাদ করে চলেছেন, অথচ তাঁদের যৌথ কোলাহলে কোনও কথাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। রাসমণির জামাই মথুরামোহন বেরিয়ে এলেন। কী ব্যাপার? জমায়েত যাঁরা করেছিলেন তাঁদের সর্দার এগিয়ে এলেন। কান্নাভেজা গলায় তিনি বললেন, 'জামাইকত্তা, আমরা যাতে নদীতে মাছ না ধরতে পারি সেই ব্যবস্থা করেছে ইংরেজ সরকার। রাণীমা যদি আমাদের একটা বিহিত না করেন তাহলে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা না খেতে পেয়ে মারা পড়ব।'  আসলে, ১৮৪০ সাল থেকে ইংরেজ সরকারের চোখ গিয়েছিল বাংলার জলপথের দিকে। জেলেদের ডিঙি নৌকার উৎপাতে জলের উপর দিয়ে বড় ফেরি বা জাহাজের যাতায়াত করতে অসুবিধা হয়। কী করা যায়? দাও ট্যাক্স বসিয়ে, তাতে কিছু উপরি রোজগারও হবে। সরকার থেকে ঘোষণা করা হল, এবার থেকে গঙ্গায় মাছ ধরতে গেলে দিতে হবে কর, এর অন্যথায় শাস্তি। ফলে গরিব জেলে পরিবারগুলির জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। আর কোনও উপায়ান্তর না দেখে তাঁরা রাসমণির বাড়িতে এসে আর্জি জানালেন। 

আরও পড়ুন-রেলের ঘোষক থেকে বলিউডের ভয়েস আর্টিস্ট! অপমানের যোগ্য জবাব দিয়ে সাফল্যের শিখরে এক ‘মহিলাকণ্ঠী’

মথুরামোহন মন দিয়ে জেলেদের বক্তব্য শুনলেন। শেষে চিন্তিত মুখে বললেন, 'সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এত তো লোক ছিলেন। তোমাদের ওদিকে রাধকান্ত দেব আছেন, দ্বারকানাথ ঠাকুর আছেন, তাঁদের কাছে না গিয়ে তোমরা হঠাৎ আমাদের কাছে এলে কেন?' জেলেরা জানালেন , তাঁরা যে যাননি এমনটা নয়। সকলের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন তাঁরা। কিন্তু  কলকাতার উচ্চবর্ণীয় 'কুলশ্রেষ্ঠ'রা তাঁদের কথা কানেও তোলেননি। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা হত্যে দিয়েছেন এই 'শূদ্র' দেবীর কাছে। রাণীই তাঁদের শেষ আশা ভরসা। এমন সময় ভেতর মহল থেকে এক পরিচারিকা এসে মথুরামোহনকে কানে কানে কী যেন বলে গেলেন। মথুরাবাবু বললেন, 'ওহে, রাণিমা তোমাদের কথা ভেতরে বসে শুনেছেন। তোমরা এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। তিনি যত তাড়াতাড়ি পারেন কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন।' 

এরপর রাসমণির পালা। সদ্য বিবাহিতা হয়ে জানবাজারের বাড়িতে আসার পর নিজের শ্বশুরমশাইকে তিনি এক ইংরেজ সাহেবের কাছে অপমানিত হতে দেখেছিলেন। সেই থেকে ব্রিটিশ সরকারের উপর তাঁর রাগ। তৎক্ষণাৎ জামাইকে ডেকে তিনি বললেন, 'মথুর, ঘুসুড়ি থেকে মেটিয়াবুরুজের গঙ্গার অংশ কোম্পানি আমায় কত টাকায় লিজ দেবে একটু খোঁজ নিয়ে দেখো তো। সব ব্যবস্থা পাকা করে তারপর এসো কেমন?' রাণীর আদেশে মথুরাবাবু নগদ দশ হাজার টাকায় গঙ্গা লিজ নিয়ে শাশুড়ির হাতে তার কাগজপত্র তুলে দিলেন। ইংরেজ সরকার তখনও জানত না তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। 

নগদ টাকায় লিজ নেওয়ার ফলে ঘুসুড়ি থেকে মেটিয়াবুরুজের বিস্তৃত গঙ্গার উপর অধিকার তখন একমাত্র রাসমণির। জামাইকে তিনি আদেশ করলেন, 'ঘুসুড়ি আর মেটিয়াবুরুজের এপার থেকে ওপারের জল মোটা লোহার শিকল দিয়ে ঘিরে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। ওই অংশ এখন আমার। কোনও বড় জাহাজ বা ফেরf ওখান দিয়ে যেতে দেব না আমি। ওই জলে শুধু জেলেরা মাছ ধরবে।' তাঁর নির্দেশ মতো মোটা চেনের ব্যবস্থা হল। তারপর হাতির পায়ের মতো মোটা লোহার থামে সেই চেন বেঁধে রাতারাতি গঙ্গার জল আটকে দেওয়া হল। কোম্পানি তো পড়ল বেজায় প্যাঁচে। মালবাহী একটাও জাহাজ চেনের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে যেতে পারছে না। কী হবে এবার? রাসমণির সাফ জবাব। জলের ওই অংশ আপাতত আমার। ফলে সেখানে আমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। অবশেষে কোম্পানিকে মাথা নত করতে হল রাণীর সামনে। তাঁর থেকে নেওয়া দশ হাজার টাকা তাঁকে ফিরিতে দেওয়া হল। এমনকী, লিখিতভাবে তাঁরা এও জানাতে বাধ্য হলেন যে এবার থেকে মাছ ধরার জন্য জেলেদের জল ব্যবহার করতে কোনোরকম কর দিতে হবে না। রাণী রাসমণির নামে জয়জয়কার পড়ে গেল চতুর্দিকে। 

এভাবেই কেবলমাত্র বুদ্ধিমত্তার জোরে ইংরেজদের অনাচারের জবাব দিয়েছিলেন 'করুণাময়ী' রাসমণি। তাঁর পরিবারের কৃতকর্মের নানান নিদর্শন ছড়িয়ে আছে আজকের কলকাতাতেও। বেলেঘাটার যে সুদীর্ঘ খাল সোজা এসে মিলেছে চিংড়িহাটায়, তা আসলে বাবু রাজচন্দ্র দাসের মস্তিস্কপ্রসূত। রাজচন্দ্রকে এ কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন রাসমণি।  ইংরেজদের সঙ্গে একরকম লড়াই করেই তিনি তৈরি করিয়েছিলেন সেই খাল। আর আছে বাবুঘাট এবং আহিরীটোলা ঘাট। এ ছাড়াও দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তো আছেই। পুরুষশাসিত ব্রাহ্মণ্যসমাজে এক কৈবর্ত নারীর উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল এ মন্দির।  বড় চটজলদি তাঁর অধিকাংশ স্মৃতি ভুলে গিয়েছে কলকাতাবাসী।

More Articles