ঔরঙ্গজেবের বদলে তিনিই হতেন মুঘল সম্রাট, আজও দগদগে ইতিহাসের সেই ক্ষত
Dara Shikoh: দারাশুকোর চিন্তাভাবনা, ব্যক্তিত্ব ঔরঙ্গজেবের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সামরিক শক্তির মাথা হিসেবে ঔরঙ্গজেব ছিলেন চমৎকার, কিন্তু সলতনত পরিচালনার ক্ষেত্রে খুব আদর্শ তাঁকে বলা চলে না।
ইতিহাস বলছে, শাহজাদা দারাশুকোকে সরিয়ে ঔরঙ্গজেবের দিল্লির মসনদে বসা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই ইতিহাসবিদরা দারাশুকো সিংহাসনে বসলে ভারতের চিত্রটা কেমন হতে পারত, এই নিয়ে মাথা কম ঘামাননি। সেক্ষেত্রে আমরা হয়তো এমন এক ভারতকে পেতাম, যার সম্পর্কে এই সময় দাঁড়িয়ে বিন্দুমাত্র কল্পনাও সম্ভব নয়। দারাশুকোর চিন্তাভাবনা, ব্যক্তিত্ব ঔরঙ্গজেবের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সামরিক শক্তির মাথা হিসেবে ঔরঙ্গজেব ছিলেন চমৎকার, কিন্তু সলতনত পরিচালনার ক্ষেত্রে খুব আদর্শ তাঁকে বলা চলে না। বরং শুকোর সমস্ত ধর্মের প্রতি সমান আগ্রহ, শ্রদ্ধা, সমস্ত পথ যাচাই করার মানসিকতা, দর্শন, শিল্প এবং স্থাপত্যে আগ্রহ– এসবই ছিল মসনদে বসার যোগ্য।
ইতিহাস বদলের ক্ষমতা তাঁর ছিল
খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির কাছে এক পুত্রসন্তান চেয়েছিলেন শাজাহান। খাজার পবিত্র ভূমি আজমীরেই জন্ম হল শাজাহানের প্রথম পুত্র দারার। আব্বার চোখের মণি দারা চিরকাল রাজধানীতেই ছিলেন, আব্বার পাশে পাশে। অন্যান্য পুত্রদের বিভিন্ন প্রদেশের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শাজাহান। রাজধানীর আয়েশে নিজের মেধায় শান দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন দারা। খুব অল্প বয়স থেকেই সুফি অধ্যাত্মবাদ আর কোরান নিয়ে দারার প্রচুর কৌতূহল। ধীরে ধীরে নানা বিষয়ে পড়াশোনা বাড়তে লাগল তাঁর। পঁচিশ বছর বয়সে লিখলেন প্রথম বই, সাফিনাত-উল-আউলিয়া। মুল্লা শাহ পির ছিলেন দারার গুরু। এই মুল্লা শাহই দারাকে সুফিদের কাদিরি গোষ্ঠীতে সামিল করেন। মুল্লা শাহ দারাকে এতটাই ভালবাসতেন, তাঁর গজলেও দারার উল্লেখ পাওয়া যায়। নানা ধরনের লেখাপত্র পড়তে পড়তে দারার ধারণা হয়েছিল, সমস্ত ধর্মই নিজের নিজের মতো করে 'সত্যি'র ব্যাখ্যা করে। ফলে সম্মান যদি দিতে হয়, সব ধর্মকেই দেব। ফলে আকবরের মতোই সম্প্রীতির নজির দেখা যায় তাঁর নানা সিদ্ধান্তে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সে লিখছেন, ‘মজমা-আল-বাহারিন’, যার বাংলা দাঁড়ায় দুই সাগরের সঙ্গমে। সাতান্ন পাতার এই কেতাবে হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের নানা মিল নিয়ে আলোচনা করেছিলেন দারা। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ভগবৎগীতারও অনুবাদ করেছিলেন দারা।
জাহাঙ্গিরের হাতে বন্দি হয়েছিলেন দারা
মুঘল শাসনে সম্প্রীতির সাধক হিসেবে আকবরের পরেই আসে দারার নাম। আসাটাই স্বাভাবিক। তবে আকবর লেখাপড়া জানতেন না। আর দারা ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। দারার বয়স যখন সাত বছর, তখন তাঁর আব্বা শাহজাদা খুররম হঠাৎ দারার ঠাকুরদাকে আক্রমণ করে বসেন। খুররমের উচ্চাশা ছিল, সেই উচ্চাশার পথে কাঁটার মতো দুই বড় ভাইও ছিল। কিন্তু জাহাঙ্গির কড়া হাতে ছেলেকে শায়েস্তা করেন। বছর চারেকের মাথায় খুররমকে মাফ করা হয়। ফের পরিবারে জায়গা পান তিনি। কিন্তু ছেলের উচ্চাশায় লাগাম দিতে শাজাহানের ছেলেমেয়েদের জাহাঙ্গির রাখেন নুরজাহানের কাছে। ছোট্ট দারা যখন তেরো বছরের কিশোর, তখন ফের আব্বার সঙ্গে তার দেখা হয়, তখন খুররম শাহজাদা থেকে বাদশাহ খুররম হয়েছেন। পরে অবশ্য ‘শাজাহান’ বলেই তাঁকে মনে রাখবে ভারত।
আরও পড়ুন: পালকি চেপে যুদ্ধ- ময়দানে যেতেন মুঘল রমণীরাও, হারিয়ে যাওয়া সেই যানের গল্প…
বার্নিয়েরের বর্ণনায় দারা
১৬৫৮ নাগাদ ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলেন ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষ নিয়ে তাঁর আগ্রহও ছিল বেশ। কিন্তু এখানে পৌঁছে বুঝলেন, ভুল সময়ে এসে পড়েছেন। পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধের না। আজমীরের কছে ধুন্ধুমার যুদ্ধ। একদিকে শাজাহানের পক্ষ নিয়ে লড়ছেন দারাশুকো, অন্যদিকে ময়ূর সিংহাসনের দাবিতে ঔরঙ্গজেব। ভুল সময়ে এসে পড়ায় বার্নিয়েরের লাভ বই ক্ষতি হয়নি। চাক্ষু্ষ অমন একটা কাণ্ড দেখতে পেলেন। ক্রমে দারার সঙ্গে আলাপ হলো তাঁর। আশ্চর্য হলেন বার্নিয়ের। এক শাহজাদার এমন পাণ্ডিত্য? আর তাঁর রাজসভায় কে নেই! হিন্দু, খ্রিস্টান সবাইকেই সমাদর করেন দারা। তবে একটু নাক উঁচু। নিজের খেয়ালেই থাকেন, কাউকে খুব একটা তোয়াজ করেন না। যাকে ইচ্ছা গালমন্দ করেন, রাগ হলেই প্রচণ্ড চেঁচান। রাগের পারদ যেমন হঠাৎ করে চড়ে, আবার নেমেও যায়। সব মিলিয়ে দারাকে বেশ পছন্দই হয়েছিল বার্নিয়েরের।
ঔরঙ্গজেবের হাতে দারার মৃত্যু
সুজা, মুরাদ আর ঔরঙ্গজেব ছিলেন নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে নিজের মতো, দারা ছিলেন নিজের পড়াশোনা নিয়ে। এরই মধ্যে শাহজাহান দারাকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলে বাঁধল গোল। কেউই ব্যাপারটা ভালোভাবে নিলেন না। বিদ্রোহের বীজ পোঁতা হল। ১৬৫৭ সালে ৬ সেপ্টেম্বর সেই পথ আরও প্রশস্ত হল। শাজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মেয়ে জাহানারা তাঁকে নিজের সেবা যত্নে এনে রাখলেন শাহজানাবাদে। এই শাহজানাবাদই এখনকার পুরোনো দিল্লি। মুশকিল হলো, দারা কাউকেই এই সময় আব্বার সঙ্গে দেখা করতে দিতে চাইতেন না। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই গুজব রটতে লাগল বাদশাহ মারা গিয়েছেন, দারা নাকি ব্যাপারটা চেপে দিতে চাইছেন। তিন ছেলে তখনও বিদেশে। তাঁদের কানেও গুজব এসে পৌঁছতে সময় লাগল না। বেগতিক দেখে সুজা বাংলা থেকেই নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন, মুরাদ গুজরাত থেকে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন। এবং ঔরঙ্গজেব নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন দাক্ষিণাত্য থেকে।
আরও পড়ুন- কলকাতার বস্তিতে বাস মুঘল সম্রাটের নাত বউয়ের, রিকশা চালান টিপুর বংশধর!
কিন্তু শাজাহান তো মারা যাননি । তিনি মেয়ের সেবায় সুস্থ হয়ে ফের মসনদে ফিরলেন। দারা বিদ্রোহ দমনের জন্য তাঁকে উসকোতে শুরু করলেন। দারার ছেলে সুলেমান শুকোর নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী প্রথমেই এগোল বাংলার দিকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৬৫৮, বাহাদুরপুরের যুদ্ধে হেরে গেলেন সুজা। জিতে দারার আত্মবিশ্বাস বাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মুরাদের বিরুদ্ধে সেনা পাঠালেন। কিন্তু পর্যাপ্ত খবর না নিয়েই এই সৈন্যচালনার মাশুল গুনতে হল তাঁকে। মুরাদ এবং ঔরঙ্গজেব রাজধানীর বিরুদ্ধে একত্রে লড়ার চুক্তি করে নিয়েছেন ততক্ষণে। সুজার ওপর আক্রমণেই সজাগ হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। সমুগড়ের যুদ্ধে এবার দারার পরাজয়ের পালা। যুদ্ধে হেরে আফগানিস্তানে পালিয়ে গিয়ে দাদার অঞ্চলে গা ঢাকা দিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য এখানেও তাঁর সহায় হল না। তাঁর আশ্রয়দাতাই ঔরঙ্গজেবের কাছে খবরটা ফাঁস করে দিলেন।
হাতে দড়ি, পায়ে দড়ি বেঁধে দারাকে দিল্লি আনা হল। একটা মাদি হাতির পিঠে চাপিয়ে শিকলে বাঁধা দারাকে ঔরঙ্গজেব শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরালেন, মানুষকে দেখালেন পরাজিত নায়কের অবস্থা। সেই ভিড় থেকে হাহাকার উঠেছিল সেদিন, কপাল চাপড়েছিল বহু মানুষ। ধর্মচ্যুত হওয়ার অভিযোগ আনা হলো তাঁর বিরুদ্ধে। তারপর, ১৬৫৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হলো শাহজাদা দারাশুকোকে। সেই লাশ হাতির পিঠে চাপিয়ে ফের ঘোরানো হলো দিল্লির বাজারে বাজারে, গলিতে গলিতে। মানুষ দেখল, তাঁদের প্রিয় শাহজাদার প্রাণহীন দেহ। শেষ হল পাণ্ডিত্যের এক অধ্যায়। শুরু হল ঔরঙ্গজেবের শাসন।