জ্বলেই রইল 'অমল আলো', যা আসলে নেভার নয়...

Cartoonist Amal Chakraborty: প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষকে নির্মল আনন্দ জুগিয়ে এসেছে যে তুলির আঁচর, শরতের এক অমল আলোকিত দিনে থামল তা চিরকালে।

সূক্ষ্ম কৌতূক, রসিকতার মেজাজ যেন ক্রমেই কমে আসছে পৃথিবী থেকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতিকে কৌতূকের মলাটে মুড়ে প্লেটে পরিবেশিত করতে ভুলে যাচ্ছে কি আজকের দুনিয়া? হয় সেই কৌতূক বা হাস্যরসের মধ্যিখানে এসে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখরাঙানি, নয়তো সূক্ষ্ম রসিকতা বোঝার মন হারাচ্ছে মানুষ। তাই কি হারাল অমল আলোও? প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষকে নির্মল আনন্দ জুগিয়ে এসেছে যে তুলির আঁচর, শরতের এক অমল আলোকিত দিনে থামল তা চিরকালে। ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন অমল আলোর সৃষ্টিকর্তা অমল চক্রবর্তী।

বুধবার সকাল দশটা নাগাদ কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে প্রয়াত হন শিল্পী। কাগজের পাতায় তাঁর সৃষ্টি 'অমল আলোয়' বছরের পর বছর ধরে মানুষকে মুগ্ধ করেছে। ভাবতে শিখিয়েছে অন্য় রকম ভাবে। এই যে কার্টুন বা ব্যাঙ্গচিত্রের রমরমা, সেই কার্টুনের এ দেশে হাতেখড়ি ব্রিটিশ আমল থেকে। আর বাংলা খবরের কাগজের পাকায় যে কার্টুন আঁকার যে রেওয়াজ, তা কিন্তু শুরু হয়েছিল এই মানুষটির হাত ধরেই । ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে 'বসন্তক'-এর মতো পত্রিকা দিয়ে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, সেই তুলি হেঁটেছে বহু পথ। দেখেছে নানা ঘটনা, ঘুরেছে সময়ের অলিগলি।

আরও পড়ুন: আমুলগার্লের হাত ধরেই অমরত্বের নৌকায় পা রাখলেন সিলভেস্টর ডাকুনহা

গত কয়েকদিন ধরেই শরীর ভালো ছিল না বর্ষীয়ান এই শিল্পীর। বয়সজনীত নানা অসুস্থতা নিয়ে তাঁকে ভর্তি করা হয় আরজিকর হাসপাতালে। অনেক দিন আগে থেকেই শরীর জবাব দিতে শুরু করেছে, চোখের দৃষ্টি হয়েছে ক্ষীণ। একটি চোখে তো প্রায় দেখতেই পারতেন না শেষের দিকে। তবু কার্টুন তাঁকে কখনও ছেড়ে যায়নি। চোখে চশমা এঁটেই চালিয়ে গিয়েছেন কাজ। 'সংবাদ প্রতিদিন'-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। কার্যত প্রতিদিনের পাতার মাধ্যমেই হাজার হাজার পাঠকের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল অমল চক্রবর্তীর 'অমল আলোয়'। তবে কর্মজীবনের শুরুতে তাঁর সঙ্গে জড়িয়েছে আরও বিখ্যাত সব সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকার নাম।

cartoonist amal chakraborty passes away

cartoonist amal chakraborty passes away

cartoonist amal chakraborty passes away

অমল চক্রবর্তীর কার্টুন, সন্দেশে প্রকাশিত।

কার্টুন কী? শুধুমাত্র মজা, নাকি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মজার মোড়কে ফুটিয়ে তোলাটাই কাজ ব্যাঙ্গচিত্রের। আসলে মানুষকে ভাবানোর কাজটাই তো করে এই ব্যাঙ্গচিত্র। ফলে ওই একটা তুলির আঁচড়ের মধ্যে যতটা শিল্পবোধ জড়িয়ে থাকে, ঠিক ততটাই জড়িয়ে থাকে তীব্র এক সমাজসচেতন মন। সেই কাজটাই প্রায় এক শতাব্দীর কাছাকাছি সময় ধরে যত্ন সহকারে করে গিয়েছেন এই মানুষটি। অমল চক্রবর্তী নামে দুনিয়া তাঁকে চিনলেও খাতায়-কলমে কিন্তু তিনি পরিতিত ছিলেন অমলেন্দু চক্রবর্তী নামে। একটা সময় আনন্দবাজার, যুগান্তর-সহ অসংখ্য পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা মিলত তাঁর অসংখ্য ব্যাঙ্গচিত্রের। ১৯৯২ সালে যোগ দেন 'সংবাদ প্রতিদিনে'। সেখানেই নিয়মিত ভাবে প্রকাশ পেত তাঁর আঁকা কার্টুন 'অমল আলোয়'। যা দুর্দান্ত ভাবে জনপ্রিয় হয়।

আরও পড়ুন: যুগের সমাপ্তি: প্রয়াত তরুণ মজুমদার, প্রচারবিমুখ পরিচালক ছিলেন বাংলা সিনেমার অভিভাবক

দেশের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট শঙ্কর পিল্লাইয়ের ছাত্র ছিলেন অমল চক্রবর্তী। তাঁর কাছেই ব্যাঙ্গচিত্রের শিক্ষা তাঁর। সেই গুরুর অনুপ্রেরণাতেই এই পকেট কার্টুনের শুরুয়াত হয় অমলবাবুর হাত ধরে। বিশেষত রাজনৈতিক ভাবনা, প্রতিদিন চোখের সামনে যা চলছে, তাকেই একটু অন্য ভাবে তুলে ধরেছেন। পকেট কার্টুনকে গ্রাম বাংলার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন এই মানুষটিই। প্রায়শই বলতে শোনা যেত তাঁকে, "এসেছি পৃথিবীতে, যদি মরতেই হয় কার্টুনিস্ট হয়েই মরব।" আর সেই কার্টুনিস্ট পরিচয় নিয়েই পৃথিবী ছাড়লেন তিনি। আর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য থেকে গেল তাঁর অজস্র কাজ, অজস্র ব্যাঙ্গচিত্র। নিজের সময় থেকেও এগিয়ে ভাবতে পেরেছে অমল চক্রবর্তীর যে সৃষ্টিরা, সেগুলোই থেকে গেল আগামীর জন্য তোলা। অমল আলো থেকে গেল এক অনির্বাপিত জ্যোতির মতো, যা আসলে কখনও নেভার নয়।

 

More Articles