এভাবেও প্রতিবাদ সম্ভব! ম্যাচে হেরেও ইরানকে যেভাবে জিতিয়ে দিল নিস্তব্ধ জাতীয় সংগীত
Iran Football World Cup 2022: জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় ইরানের ফুটবলাররা পুরোপুরি চুপ। আর সেই সঙ্গেই স্টেডিয়ামে হাজির অনেক সমর্থকও জাতীয় সংগীতের সময় পালন করলেন গভীর নীরবতা
আরব বিশ্বের দুই দেশ, কাতার এবং ইরান। একদিকে কাতারের উপদ্বীপ সেজে উঠেছে লক্ষ লক্ষ আলোর রোশনাইয়ে। কাতারের সমস্ত অন্ধকারের গল্পকে সুচারুভাবে ধামাচাপা দিয়ে টাকার জোরে সেখানে শুরু হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম খেলার আসর, ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ। আর পারস্য উপসাগরের অন্য প্রান্তে রয়েছে আরও একটি দেশ, ইরান। সে দেশ কার্যত অগ্নিগর্ভ, শহর থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র বিক্ষোভ, কুর্দিশ নারী মাশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে ফুঁসছে গোটা ইরান। সরকারের দমন-পীড়ন নীতিও জনরোষ আটকাতে ব্যর্থ। আর সেই রেশ এবার এসে পড়ল ফুটবলেও।
দোহার বিখ্যাত খালিফা আন্তর্জাতিক ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড এবং ইরান। ক্রমতালিকায় এই মুহূর্তে এশিয়ার বিচারে সবচেয়ে উপরে রয়েছে ইরান। দলে কোচ হিসেবে যুক্ত হয়েছেন এককালে ম্যানচেস্টারে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সহকারী হিসেবে কাজ করা পর্তুগিজ কার্লোজ কুইরোস। দলে আছেন পর্তুগাল এবং জার্মানির ঘরোয়া লিগে খেলা বেশ কয়েকজন নামী ফুটবলার। কিন্তু, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয় থাকলে অধরাই। ৬-২ ব্যবধানে পরাজিত হয়ে মাঠ ছাড়তে হলো ইরানকে। কিন্তু, গোল ব্যবধানের নিরিখে পরাজিত হলেও, জিতল ইরান। জিতলেন ইরানের নারীরা, জিতলেন সেই মাশা আমিনি।
এমনিতেই ইরানের ফুটবল দলকে একটু অন্য চোখেই দেখা হয় গোটা ইরানে। সেখানে ইরানের ধর্মগুরুদের কোনও কথা খাটে না। ইরানের জাতীয় দল প্রতিনিধিত্ব করে ইরানের মানুষদের। তাই এবারের বিশ্বকাপে যে মাশা আমিনি প্রসঙ্গ উঠবে, সেটা হলফ করেই বলেছিলেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। হলও ঠিক তাই, বিতর্কের বিশ্বকাপে আরও একটি বিতর্ক যোগ করলেন ইরানের খেলোয়াড়রা, ঠিক যেরকম করেছিলেন গত সেপ্টেম্বর মাসে সেনেগালের বিরুদ্ধে ম্যাচে। বিক্ষোভকারী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ফুটবল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জাতীয় সংগীতে গলা মেলালেন না ইরানের ফুটবলাররা। ম্যাচের আগেই ইরানের অধিনায়ক আলি রেজা জাহানবকশ জানিয়েছিলেন, জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে কিনা সেটা দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা। জানা গিয়েছে, ইরানের বেশিরভাগ ফুটবলারই জাতীয় সংগীত না গাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে, জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় ইরানের ফুটবলাররা পুরোপুরি চুপ। আর সেই সঙ্গেই স্টেডিয়ামে হাজির অনেক সমর্থকও জাতীয় সংগীতের সময় পালন করলেন গভীর নীরবতা।
আরও পড়ুন- সম্প্রচারে তুমুল বেনিয়ম! ফুটবল বিশ্বকাপের শুরুতেই কেন আশাহত ভারতীয় দর্শকরা
মাছ দু’য়েক আগে হিজাব বিতর্ক নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা ইরান। মাশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই ফুঁসছিল ইরান। প্রতিদিন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে গোটা দেশে। কিছুদিন আগে ইরানের খ্যাতনামা শেফ মেহেরশাদ শাহিদিকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে রেভুলিউশনারি গার্ড ফোর্সের বিরুদ্ধে। জানা যায়, মহিলাদের সমর্থনে হিজাব বিরোধী আন্দোলনে নেমেছিলেন শাহিদি। আর তখনই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে হেফাজতে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। শাহিদির শেষকৃত্যের সময় প্রতিবাদের ময়দানে নেমেছিলেন হাজার হাজার মানুষ।
তাঁর মৃত্যু নিয়ে পুলিশ এবং প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলেছেন অনেকেই। পেশায় চিকিৎসক নিনা আনসারি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছিলেন, “মেহেরশাদ শাহিদি বুট রেস্তোরাঁর একজন প্রতিভাশালী শেফ ছিলেন। ইরান সরকার ওঁকে ভয়ংকরভাবে খুন করেছে। পরের দিন ওর ২০ বছরের জন্মদিন ছিল। আমরা এই ঘটনাটা কখনো ভুলব না। আমরা ইরান সরকারকে ক্ষমা করব না।” এই ঘটনার দিন কয়েক পরে হিজাব ছাড়া ছবি দিয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন ইরানের প্রথম সারির অভিনেত্রী তারান্নেহ আলিদুস্তি। সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানাতেই এই পদক্ষেপ করেছিলেন তিনি। নিজের ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন তিনি এবং তাঁর হাতে ছিল একটি পোস্টার যাতে নীল কালি দিয়ে কুর্দি ভাষায় লেখা, “নারী, জীবন, স্বাধীনতা!”
মাস দু’য়েক আগে ১৩ সেপ্টেম্বর, ২২ বছরের এক কুর্দ-ইরানি তরুণী মাশা আমিনিকে আটক করে ইরানের কুখ্যাত নীতিপুলিশি বাহিনী। এই নীতিপুলিশি বাহিনী কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা কোন সংগঠন নয়, বরং বলতে গেলে ইরান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি সরকারি আইনরক্ষক বাহিনী, ফারসিতে যাদের নাম, ‘গস্ত-এ-এরশাদ’। এদের দায়িত্ব, ইরানে ইসলামি নিয়ম কানুন কঠোরভাবে মানা হচ্ছে কিনা তা সুনিশ্চিত করা। অভিযোগ উঠেছিল, মাশা আমিনি ঠিকভাবে হিজাব পরেননি এবং সেই অভিযোগে প্রথমে তাঁকে আটক করা হয়। পরে পুলিশি হেফাজতে তিনি মারা যান। ঠিক কী কারণে তাঁর মৃত্যু হয়, এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে পুলিশের দাবি, তিনি হৃদরোগে মারা গিয়েছিলেন।
কিন্তু হাসপাতালে শেষ মুহূর্তে তোলা মাশা আমিনির কিছু ছবি সামনে আসতেই পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে যায়। মারাত্মকভাবে আহত, কালশিটে পড়া, রক্তাক্ত আমিনির ছবি দেখে অনেকে আন্দাজ করেন, গ্রেফতারের পর তাঁর ওপর নির্মম অত্যাচার করা হয়, মাথায় আঘাত করা হয় এবং প্রবল মারধরের কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান। ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি জানিয়েছিলেন, তিনি বেদনাহত। কিন্তু, এতে চিঁড়ে ভেজেনি। বরং আমিনির মৃত্যুর খবর সামনে আসতেই গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল দেশ জুড়ে বিক্ষোভ। শুরুটা হয়েছিল মাশা আমিনির শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান থেকে আর সেখান থেকেই বিক্ষোভ সারা ইরানে ছড়িয়ে পড়ে। তেহেরানে কাজকর্ম এবং জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। কাতারে কাতারে মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামেন বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করতে। জীবন যাপনের স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি তুলে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে ইরানের রাজপথ। অবরোধ করা হয় রাস্তা এবং সরকারি ভবন। তবে সব থেকে কঠোর পদক্ষেপ করেছিলেন সাধারণ ইরানি মহিলারাই। খোলা রাস্তায় সবার সামনে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আন্দোলনের মাঝেই হিজাব খুলে তাতে অগ্নিসংযোগ করে প্রতিবাদ জানান ইরানের মহিলারা। প্রকাশ্যে নিজেদের চুল কেটে তীব্র ধিক্কার জানান। ইরানের ১০০ টি শহরে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদ। ইরানের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলনের রেশ।
তাই স্বাভাবিকভাবেই, “খেলা আর রাজনীতিকে গোলাবেন না” বলে একটা অবস্থান গ্রহণ করে ফিফা। কিন্তু ততদিনে সব কিছু গুলিয়ে গেছে। প্রবলভাবে প্রতিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে খেলাধুলো। ধারে ভারে এই মুহূর্তে মধ্য এশিয়ার সবথেকে বড় ফুটবল টিম রয়েছে ইরানের কাছেই। পাশাপাশি ইরানকে বলা যেতে পারে কবিতার দেশ। ইসলামি সভ্যতার অন্যতম ধারক এবং বাহক এই দেশটি বিশ্বের সাহিত্য সমৃদ্ধ ফারসি ভাষার এক অন্যতম পীঠস্থান। ওমর খৈয়াম থেকে শুরু করে নিজামি এবং ফিরদৌসির মতো প্রবাদপ্রতিমদের নাম জড়িয়ে রয়েছে ইরানের ইতিহাসের সঙ্গে। মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র ইরানের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি সারা বিশ্বে এতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আবুল ফজল জালিলি, জাফর পনাহি, আব্বাস কিয়ারোস্তিমি, পারভেজ কিমিয়াভির মতো তারকারা জড়িয়ে রয়েছেন ইরানের চলচ্চিত্রের সঙ্গে।
আরও পড়ুন- নিরামিষ বিশ্বকাপ! বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য কী কী চরম নিষিদ্ধ কাতারে?
কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ খোমেনির উত্থানের পর যেন ইরানের রাজনৈতিক তথা ধর্মীয় পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে যায়। ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা থেকে শুরু করে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা খর্ব করা- একের পর এক পদক্ষেপে ইরানের সাধারণ মানুষের অধিকার পৌঁছে যায় তলানিতে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ থেকে ইরান রূপান্তরিত হয় কঠোরভাবে ইসলামি গণতান্ত্রিক দেশে। সংশোধিত হয় সংবিধান, ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে আমেরিকার সঙ্গে সংঘাত হয়ে ওঠে তীব্র। কিন্তু, এই সরকারের বিরুদ্ধে বারবার রাস্তায় নেমেছে ইরানের সাধারণ মানুষ। তবে এবারের বিক্ষোভের মাত্রাটা যেন অন্যান্য বিক্ষোভের থেকে অনেক তীব্র।
তবে, সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যে ইরানের ফুটবল দলটিও অংশ নেবে, তা হয়তো অনেকে ভাবতে পারেননি। নজিরবিহীনভাবে ইরানের জনসাধারণের তরফে সরকারিভাবে ফিফার কাছে আবেদন করা হয়েছিল যাতে ইরানের ফুটবল দলকে বিশ্বকাপে খেলতে না দেওয়া হয়। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, একটি স্পেনীয় আইন সংস্থার সাহায্যে আইনি রীতিনীতি মেনে ফিফাকে ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জানিয়ে আবেদন করা হয়েছিল। ইরানের বেশ কিছু খেলার সঙ্গে জড়িত বর্তমান এবং প্রাক্তনীরা এই আবেদন জানিয়েছিলেন। অন্যান্য খেলা থেকেও ভেসে আসতে শুরু করেছিল প্রতিবাদ। আরব বিশ্বের অন্যতম সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার তরফে প্রকাশিত একটি ইনস্টাগ্রাম ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ওয়াটার পোলো ম্যাচের আগে ইরানের জাতীয় দল জাতীয় সংগীতে গলা মেলাচ্ছে না। বিচ-ফুটবলের একজন খেলোয়াড় সম্প্রতি গোল করে ম্যাচ জিতিয়ে সেলিব্রেট করেছেন হাতের ইশারায় মাথার চুল কাটার ভঙ্গিমা করে। দিন কয়েক আগে ইরানের সব থেকে পুরনো ফুটবল ক্লাব এস্তেকলাল এফসি দেশের সুপার কাপ জিতেও প্রতিবাদীদের সমর্থন জানিয়ে কোনও রূপ আনন্দ থেকে বিরত ছিলেন।
আর এই বিক্ষোভ এবার শামিল হলো ইরানের জাতীয় ফুটবল দল। তাও আাবার কোনও যে সে মঞ্চে নয়, বিশ্বকাপ ফুটবলের ময়দানে নিজেদের প্রথম ম্যাচে। জাতীয় সংগীতে গলা না মিলিয়ে তারা প্রতিবাদ করল ইরানের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। আয়াতুল্লাহ আলি খামিনির বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ তুলে ইরান ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা জানিয়ে দিলেন, ইরান দমবে না। দরকার হলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। শুধু দেশ নয়, খেলার ময়দানেও ছড়িয়ে পড়বে প্রতিবাদ। শতাধিক মানুষ প্রাণ হারালেও, বিপ্লবের এটা শেষ নয়।