রাতারাতি ভিটেমাটি ছাড়া হবেন ৫০ হাজার নাগরিক! কেন বাছাই করা এলাকাতেই বুলডোজার?

Haldwani Eviction: দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী থেকে মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনী, সর্বত্রই ইদানীং উচ্ছেদ অভিযান চালাতে অতিসক্রিয়তা চোখে পড়ছে।

‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, যার আছে ভূরি ভূরি

রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’

মাথার উপর এক টুকরো ছাদ দাঁড় করাতেই বয়ে যায় জীবন। পূর্বপুরুষে রেখে গেলেও, সেই ছাদ ধরে রাখতে চলে যায় উপার্জনের সবটুকু। কিন্তু সেই ছাদের নিচে সুখনিদ্রার অবকাশটুকুই বা কয় জন পান! দেবভূমির ৫০ হাজার মানুষ কনকনে ঠান্ডায় একসঙ্গে গৃহহীন হতে বসলে, এই প্রশ্ন উঠে আসাই স্বাভাবিক। একই ভাবে মানুষের দ্বারা নির্বাচিত, মানুষের অধিকার রক্ষায় নিযুক্ত সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। রাতারাতি লোটা-কম্বল নিয়ে হাজার হাজার মানুষকে পথে বসানোর এই পরিকল্পনার দায় কোনও ভাবেই অস্বীকার করতে পারে না সরকার। অস্বীকার করতে পারে না এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক স্বার্থকেও।

১৪০ কোটির দেশে ভিটেমাটি নিয়ে এমন টানাটানি স্বাধীনতার ৭৫ বছরে কার্যত চোখে পড়েনি, যেখানে একসঙ্গে এত সংখ্যক মানুষকে উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাও আবার দুর্গতদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই। কোনও রকম বিকল্প ব্যবস্থা না করেই, হাজার হাজার মানুষকে এক সপ্তাহের মধ্যে ভিটেমাটি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং তাকে রুখতে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। হাইকোর্টকে বোঝাতে হয়েছে যে, এই উচ্ছেদ নেহাত আইনি বিষয় নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজ্যের হাইকোর্টকে মানবিকতার সহজাত সহজপাঠ বোঝাতে হচ্ছে, এই দৃশ্যও বিরল।

চারধাম যাত্রায় ফি বছর ভিড় জমে যে উত্তরাখণ্ডে, সেখানকার হলদওয়ানিতেই ৫০ হাজার মানুষের ভবিষ্যৎ এখন বিশ বাঁও জলে। কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করা ভিটেমাটি ছেড়ে তাঁদের বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। কর প্রদানকারী নাগরিক থেকে রাতারাতি জবরদখলকারীর তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছে তাঁদের গায়ে। মানবিক বোধ থেকে সুপ্রিম কোর্ট সেই নির্দেশ আপাতত স্থগিত রাখলেও, একমাস পর আদৌ ভিটেমাটি থাকবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গিয়েছে দুর্গতদের মধ্যে।

আরও পড়ুন- আয়ু কমছে তিলোত্তমার, উন্নয়নের তোড়ে কলকাতারও অবস্থা জোশীমঠের মতোই!

হলদওয়ানি রেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠা বসতিকে ঘিরেই টানাপোড়েন। উত্তর-পূর্ব রেলওয়ের অধীনে পড়ে হলদওয়ানি স্টেশন। তার সংলগ্ন গফুরবস্তি এলাকায় জবরদখল করে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ। ওই এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বাস, বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৪৫০০। যার মধ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের আধিক্য রয়েছে। রেলের জায়গা জবরদখল করে ওই জায়গায় বসতি গড়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ।

২০১৩ সালে প্রথম বার গফুরবস্তি এলাকা থেকে জবরদখলকারীদের তুলতে হবে বলে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন রবিশঙ্কর জোশী নামের এক ব্যক্তি। তাঁর অভিযোগ ছিল, গউলা নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালি তোলা হচ্ছে। তাতে নদীর উপর থাকা সেতুর বিপদ বাড়ছে। অবৈধ ভবে বালি তোলার কাজে ওই এলাকার বাসিন্দারাই যুক্ত বলে অভিযোগ করেন রবিশঙ্কর। তাই সেখান থেকে তাঁদের উচ্ছেদের দাবি জানান। ২০১৬ সালে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট জনস্বার্থ মামলাকারীর উদ্বেগের কারণকে যুক্তিসঙ্গত বলে জানায়। ১০ সপ্তাহের মধ্যে জবরদখলকারীদের এলাকা থেকে হটানোর নির্দেশ দেয়।

আদালতের এই নির্দেশের পরও যদিও উচ্ছেদের নির্দেশ পাননি এলাকার বাসিন্দারা। বরং ২০১৭ সালে হাইকোর্টের নির্দেশের পাল্টা তৎকালীন উত্তরাখণ্ড সরকার জানায়, যে জায়গাকে ঘিরে বিতর্ক, সেটি মোটেই রেলের জায়গা নয়। বরং তা রাজ্য সরকারের সম্পত্তি। রায় পর্যালোচনা করে দেখতে পাল্টা পিটিশন দায়ের করে তারা। তার পরও টানাপোড়েন থামেনি। সম্প্রতি, ২০২২ সালে ফের নতুন করে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয় হাইকোর্টে। রেলের জায়গা থেকে জবরদখলকারীদের সরাতে অবিলম্বে নির্দেশ দেওয়া হোক বলে জানানো হয় তাতে। রেলের আধিকারিক এবং নৈনিতাল প্রশাসনের সঙ্গে মিলে এক সপ্তাহের মধ্যে সেই কাজ সারতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া যাবতীয় আবেদন খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট।

এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে, এই মর্মে নোটিশ পেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে স্থানীয়দের। এর পর মামলা পৌঁছয় সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে হাইকোর্টের তরফে দেওয়া উচ্ছেদের নির্দেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিচারপতিরা। বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কৌশল জানান, হলদওয়ানি নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন তিনি। এর সঙ্গে দৃষ্টিকোণ বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। উচ্ছেদ করলেই হয় না, দিতে হয় পুনর্বাসনও। ৫০ হাজার মানুষকে রাতারাতি এভাবে উচ্ছেদ করা যায় না। অধিকাংশ মানুষের ওই জমির উপর অধিকার রয়েছে। রেল এবং দুর্গত, উভয় পক্ষের স্বার্থকে মাায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে জানায় শীর্ষ আদালত। তবে তত দিন পর্যন্ত ওই জমিতে কোনও নয়া নির্মাণ বা উন্নয়ন করা যাবে না বলেও নির্দেশ দেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্ট আপাতত হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। তবে গফুরবস্তি এলাকার বাসিন্দদের ভিটের মালিকানা থাকবে কিনা, তা অনিশ্চিতই। সেই আবহেই গোটা আইনি প্রক্রিয়া নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। কারণ যে এলাকায় উচ্ছেদ চালানোর নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট, সেটি বনভুলপোরার অন্তর্গত পাঁচটি ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ছে। ২০১৭ সালে উত্তরাখণ্ডের তৎকালীন সরকার ৭৮ একরের ওই এলাকাকে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করেছিল। সেখানে ছয়টি সরকারি স্কুল, কলেজ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, আট থেকে ১০টি মসজিদ, দুটি মন্দির, একটি সরস্বতী শিশু মন্দির, ব্যাঙ্ক রয়েছে। বাড়িও হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের আবাস যোজনা প্রকল্পের আওতায়। সেখানকার বাসিন্দারা নিয়মিত সম্পত্তি, বিদ্যুৎ এবং জলের কর দিয়ে আসছেন। বাড়ি, জমি রেজিস্ট্রির কাগজও রয়েছে তাঁদের কাছে। জমি রেলের হলে সেখানে সরকারি স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্যাঙ্কই বা কী করে গড়ে উঠল, প্রশ্ন উঠছে।

তাছাড়া রেল বা রাজ্য সরকারের তরফে গফুরবস্তি এলাকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদের দাবি জানায়নি, শুধুমাত্র এক ব্যক্তির দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে কীভাবে ৫০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিল হাইকোর্ট, প্রশ্ন তুলছে বিশেষজ্ঞ মহল। স্থানীয়দের দাবি, এ নিয়ে সরকারি নথিও সামনে এনেছেন, যেখানে গফুরবস্তি এলাকাটিকে ‘নজুল ল্যান্ড’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘নজুল ল্যান্ড’ হলো সেই জমি, যা কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে নির্মাণ, রাস্তা, বাজার, খেলার মাঠ, এবং জন সাধারণের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর অনুমতি রয়েছে। স্থানীয় সংখ্যালঘুদের দাবি, দেশভাগের সময় বহু মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। সেই সময় পরিত্যক্ত বাড়িগুলি নিলামে তোলে তৎকালীন সরকার। পাকিস্তান থেকে চলে আসা ছিন্নমূল মানুষজন সেগুলি টাকা দিয়ে কেনেন।

যদিও স্থানীয়দের জনা দেওয়া সরকারি ওই নথিকে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট বৈধ মানতে নারাজ। বরং তাদের দাবি, সেটি শুধুমাত্র একটি চিরকূট। ফলে ওই জমির হস্তান্তর, বিক্রি, ইজারা, সবকিছুই বেআইনি। ওই জমিতে রেলের মালিকানার পক্ষেই সায় দেয় হাইকোর্ট। বলা হয়, "১৮৮৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেখানে রেললাইন পাতে। ১৯৪৩ সালে সেটি সরকারের হাতে ওঠে।’’ ৫০-৬০ বছর জায়গা দখল করে রাখলেই মালিকানা পাওয়া যায় না বলেও মন্তব্য করে হাইকোর্ট। এমনকী পৌরসভার রেকর্ডে জমি-বাড়ির মালিকানা নথিভুক্ত হয়ে থাকলেও, তা ধর্তব্যের মধ্যে আনতে চায়নি হাইকোর্ট। তার সপক্ষে রেলও জানায়, বেআইনি ভাবে ওই জায়গা দখল করে রাখা হয়েছে। যদিও রেলের তরফে মামলাটি করা হয়নি।

আরও পড়ুন- বিজেপি মানেই ‘অশিক্ষিত’? বাজপেয়ী থেকে যোগী, কার দৌড় কতটা

তাই এই উচ্ছেদের নেপথ্যে আসলে রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করছে অভিযোগ উঠছে। বলা হচ্ছে, ২০২২ সালে উত্তরাখণ্ড বিধানসভা নির্বাচনে হলদওয়ানিতে জয়ী হন কংগ্রেসের সুমিত হরিদয়েশ। বিজেপি প্রার্থীকে ৭ হাজার ৮১৪ ভোটে পরাজিত করেন তিনি। বনভুলপোরা বরাবর কংগ্রেসের গড় হিসেবেই পরিচিত। গফুরবস্তি এলাকাকে রাজ্য সরকারের সম্পত্তি বলে যখন হাইকোর্টে পাল্টা আবেদন জমা পড়ে, সেই সময় রাজ্যে কংগ্রেসের সরকার ছিল। বর্তমানে সেখানে বিজেপির সরকার রয়েছে। তাই ওই এলাকায় নিজেদের দখল কায়েম করতেই বিজেপির তরফে ইচ্ছাকৃত ভবে পরিস্থিতি জটিল করে তোলা হচ্ছে। যে কারণে হলদওয়ানিকে দিল্লির শাহিনবাগের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে, সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইকে ‘ভূমি জিহাদ’ বলে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে, আন্দোলনকারীদের ‘জিহাদি গ্যাং’ বলে কটাক্ষ করা হচ্ছে লাগাতার।

হাইকোর্টের দেওয়া উচ্ছেদ-নির্দেশের সমালোচনা করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী গৌতম ভাটিয়াও। ১৯৮৫ সালে ওলগা টেলিস বনাম বম্বে পৌরসভা মামলার উদাহরণ তুলে ধরে তিনি জানান, এ যাবৎ একাধিক রাজ্যের হাইকোর্ট-সহ সুপ্রিম কোর্ট একাধিক জবরদখল মামলায় মানবিক স্বার্থকেই ঊর্ধ্বে রেখে এসেছে। কোনও জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালানোর আগে সংবিধান মেনে সেখানকার মানুষের জীবন, জীবিকা এবং বাসস্থানের অধিকারকে সম্মান জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার। সংবিধান অনুযায়ী, যদি সমাজের কোনও অংশ প্রাথমিক আর্থ-সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, যার মধ্যে বাসস্থানের অধিকারও পড়ে, তা সরকারের ব্যর্থতারই অঙ্গ। তাই উচ্ছেদ অভিযানে মানুষ যদি গৃহহীন হয়ে পড়েন, তা সত্ত্বেও নাগরিক হিসেবে তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না কাউকে।

বলা বহুল্য, উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট মানবাধিকারের সহজপাঠের পাশাপাশি নাগরিকদের বাসস্থানের অধিকারকেও প্রাধান্য দেয়নি। সুপ্রিম কোর্ট মানবিক বোধকে গুরুত্ব দিলেও, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি। তাই গফুরবস্তির বাসিন্দারা খাদের কিনারাতেই দাঁড়িয়ে। তবে সঙ্কট শুধু এক জায়গায় নয়, দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী থেকে মধ্যপ্রদেশের উজ্জ্বয়িনী, সর্বত্রই ইদানীং উচ্ছেদ অভিযান চালাতে অতিসক্রিয়তা চোখে পড়ছে। ২০২৮-এর কুম্ভমেলার আগে উজ্জ্বয়িনীর গুলমোহর এবং গেয়ারসি কলোনির কয়েকশো বাসিন্দাকে উচ্ছেদের নোটিশ ধরিয়েছে মধ্যপ্রদেশ সরকার। ঘটনাচক্রে এই উচ্ছেদ অভিযানের বুলডোজার যে যে জায়গায় আছড়ে পড়ছে, তার অধিকাংশই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা। তাই নেপথ্যে থাকা রাজনৈতিক স্বার্থ ধরা দিচ্ছে প্রকট হয়ে।

More Articles