জয় করে তবু ভয়! বিজেপির ঘোড়া কেনাবেচার কাছে ফের হারবে হিমাচলের কংগ্রেস?
Himachal Pradesh Election Congress: ইতিমধ্যেই নবনির্বাচিত কংগ্রেসের একাধিক ভাবি বিধায়ক এবং ৩ নির্দল বিধায়ককে নিজেদের দিকে নেওয়ার পথে এগিয়েছে বিজেপি।
গুজরাতে বিপুল সংখ্যক আসন নিয়ে ফের ক্ষমতায় বসতে চলেছে বিজেপি। অমিত শাহের স্পর্শে আবার 'ব্র্যান্ড মোদি' রক্ষা হয়েছে গেরুয়া-গড়ে। এ রাজ্যেও উচ্ছ্বাসে মেতেছেন বিজেপি কর্মীরা। গেরুয়া-আবিরে ভরেছে আহমেদাবাদ থেকে শুরু করে সুরাত, গান্ধীনগরের আকাশ। 'ফাইনাল' লোকসভা নির্বাচনের আগে 'সেমিফাইনাল' জিতে সম্মান রক্ষা হয়েছে মোদির। তবে 'সেমিফাইনাল' কি আসলে জিততে পেরেছে মোদি-শাহর দল! জিতেছে, কিন্তু সমস্ত জয়ের মাঝেও কাঁটা জিইয়ে রেখেছে হিমাচলপ্রদেশ। এখনও পর্যন্ত এই রাজ্যে ভোটগণনার যা গতিবিধি তাতে ৬৮ আসনের বিধানসভায় প্রায় ৩৯ আসনে এগিয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। ২৬ আসনে এগিয়ে বিজেপি। নির্দল প্রার্থীরা এগিয়ে ৩ আসনে। নির্বাচনের ফলাফলের (Himachal Pradesh Election Result) যা ট্রেন্ড তাতে একপ্রকার জিতেই গিয়েছে কংগ্রেস। এগিয়ে থাকার নিরিখে ৩৫ আসনের ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে গিয়েছে রাহুল গান্ধী-সোনিয়া গান্ধীর দল। খানিকটা সম্মান বেঁচেছে মল্লিকার্জুন খাড়গেদের।
কিন্তু এই জয়েও এখন থেকেই আশঙ্কা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। কংগ্রেসের অন্দরে ভয় ধরাচ্ছে পুরনো স্মৃতি! অনেকেই বলছেন, "জিতলে আবার হয় নাকি! আটকে রাখাই আসল চ্যালেঞ্জ!" অর্থাৎ টিকিট দিল কংগ্রেস, জনতার ভোটে নির্বাচিত হলেন কংগ্রেসের পক্ষেই কিন্তু জিতেই পগার পার! টাকা আর পদের লোভে দলবদলের ভূরি ভূরি উদাহরণ এবং রাজনৈতিক ঘোড়া কেনাবেচার আবহ নাকি এখন থেকেই টের পাচ্ছে হিমাচলপ্রদেশ। আনাগোনা বেড়েছে দিল্লির নেতাদের। 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ রাহুল গান্ধীর চিন্তা বেড়েছে হিমাচল জুড়তে!
কী চলছে সেখানে? হিমাচলপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিভা সিং। তিনিই ওই রাজ্যের কংগ্রেস সভাপতি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংয়ের স্ত্রীর কাঁধেই গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করেছিল কংগ্রেস। কাজেও দিয়েছে সেই সিদ্ধান্ত। মোদি ঝড়ের আবহেও হিমাচলের পরম্পরা বজায় রেখে খানিকটা রুখে দেওয়া গিয়েছে বিজেপিকে। আর এখানেই উঠেছে প্রশ্ন। সেমিফাইনালে ১-১ ফল নাকি ঘোড়া কেনাবেচার সূত্রেই ফল ঘুরবে ২-০ এর দিকে! অর্থাৎ হিমাচলও কি দখল করবে বিজেপি।
আরও পড়ুন- গুজরাত ভোটে তিনিই ‘চাণক্য’, অমিত শাহর ছোট্ট চালে যে ভাবে কিস্তিমাত ‘ব্র্যান্ড মোদি’-র
সেই প্রশ্নেই আশঙ্কা বেড়েছে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে। শোনা যাচ্ছে, ইতিমধ্যেই নবনির্বাচিত কংগ্রেসের একাধিক ভাবি বিধায়ক এবং ৩ নির্দল বিধায়ককে নিজেদের দিকে নেওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। সূত্রের খবর, ৩৫ আসনের 'ম্যাজিক ফিগার' থেকে ১০-১১ আসন দূরে থাকতে পারে অমিত শাহের দল। ছোট রাজ্য হিমাচলপ্রদেশে সেই সংখ্যা জোগাড় করা খুব একটা কঠিন কাজ নয় বিজেপির পক্ষে। দাবি, সেই সংখ্যার মধ্যে এখনই প্রায় ৬ জন বিধায়ক জোগাড় করে ফেলেছে বিজেপি। ৩ নির্দল-সহ এই সংখ্যা ১১-১২ হতেও খুব দেরি হবে না বলে দাবি বিজেপি নেতাদের। আর সেই লক্ষ্য পূরণ হলেই হিমাচলপ্রদেশের রঙও বদলে যাবে মুহূর্তেই।
এখানেই আশঙ্কার মেঘ জমছে কংগ্রেস-অন্দরে। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও জয়ী বিধায়কদের আস্থা ভোট, শপথ অনুষ্ঠানের আগে হিমাচল ছাড়া করতে চাইছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। রাজস্থান অথবা ছত্তিশগড়; কংগ্রেস শাসিত এই দুই রাজ্যের কোনও এক জায়গায় বাসে করে বিধায়কদের নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানুষের রায়ে জিতেও টাকার কাছে জনপ্রতিনিধিদের মত বদলের আশঙ্কায় এই পদক্ষেপ নিতে চলেছে কংগ্রেস। যাতে কোনওভাবেই ফের জয়ের আশা পূর্ণ না হয় বিজেপির, তা নিশ্চিত করতে চাইছেন গান্ধীরা। কিন্তু পারবেন কি? এই প্রশ্নেই দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক মহলের একাংশ। কেন?
'ঘোড়া কেনাবেচা'র ইতিহাস
২০১৪ সাল। মোদি ঝড়ে কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ভেঙে যাওযার পর থেকেই একাধিকবার রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে দেশের একাধিক রাজ্যে। বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন নজির স্থাপন করেছেন অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদিরা।
২০১৬- উত্তরাখণ্ড
হরিশ রাওয়াত-নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ২০১৬-এর উত্তরাখণ্ড নির্বাচনে জয় পায় ৩৬ আসনে। ৭০ আসন এবং ১টি মনোনীত আসন মিলিয়ে মোট ৭১ আসনের বিধানসভায় বিজেপি পায় ২৮ আসন। কিন্তু এরপরেও শুরু হয় ডামাডোল। বিধায়ক অর্থাৎ ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগ ওঠে অমিত শাহের দলের বিরুদ্ধে। ওই রাজ্যে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন হরিশ রাওয়াত। বিধায়ক কেনাবেচার যুদ্ধে হারে বিজেপি! কিন্তু বেশিদিন যায়নি, মাত্র ১ বছরের মধ্যেই ফের তৈরি হয় অস্থিরতা। ক্ষমতায় এসে হাজির হয় বিজেপি।
অরুণাচলপ্রদেশে অস্থিরতা
জুলাই ২০১৬। রাজনৈতিক অশান্তি শুরু হয় উত্তর পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশে। বিধানসভা নির্বাচনে স্থানীয় পিপিএ দল ৩০ এবং বিজেপি পায় ১১ আসন। নির্দলীয় প্রার্থীদের দখলে যায় ২ আসন। কিন্তু এখানেও ওঠে প্রশ্ন। একদা কংগ্রেসের জোটসঙ্গী, মিলিজুলি সরকার ক্ষমতায় আসার পথে বাধা হয় বিজেপি। ফের ওঠে ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগ। পিপিএ কে নিজের দিকে টেনে অরুণাচল প্রদেশের সরকারে বসে বিজেপি।মুখ্যমন্ত্রী করা হয় নাবাম টুকিকে। এখানেও অভিযোগ ওঠে ঘোড়া কেনাবেচার।
২০১৭- গোয়া
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচনের পরেও ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগ শোরগোল ফেলে গোয়ায়। ৪০ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেস পায় ১৭ আসন। বিজেপি ১৩ এবং অন্যান্যরা ১০টি আসনে জেতে। কিন্তু এই ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় ছড়ি ঘোরাতে শুরু করে বিজেপি। কংগ্রেস বিধায়কদের সরিয়েও লাভ হয়নি তেমন একটা। গোয়া ফরওয়ার্ড দল, মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক দলের বিধায়কদের নিজের দিকে টেনে সরকার গড়েন মনোহর পরিকররা।
আরও পড়ুন- বারবার বিজেপির হাতছাড়া রাজধানী! কোন চালে কিস্তিমাত আপ-এর?
২০১৯- কর্ণাটক
ক্ষমতায় কংগ্রেস। জনতা দল সমাজবাদী এবং কংগ্রেসের জোট নির্বাচনের পর শাসন করতে শুরু করে কর্ণাটক। কিন্তু তা বেশিদিন টিকতে দেয়নি বিজেপি। মাত্র ১৪ মাসের মাথায় পড়ল সরকার। এখানেও উঠল টাকার জোরে বিধায়ক কেনাবেচার অভিযোগ। দেখা গেল প্রায় ১৩ জন কংগ্রেস বিধায়ক এবং ৩ জন জেডি(এস) বিধায়ক পদত্যাগ করলেন। দুই নির্দল বিধায়ক হঠাৎ সমর্থন প্রত্যাহার করলেন জোট সরকার থেকে। মামলা গড়াল দেশের শীর্ষ আদালতে। কিন্তু ফের শেষ হাসি হাসলেন বিএস ইয়েদুরাপ্পারা।
২০২০- মধ্যপ্রদেশ
ফের সংকট। মধ্যপ্রদেশে বিপদে পড়ল কংগ্রেস। কমলনাথ সরকারকে বিপদে ফেলার অভিযোগ উঠল বিজেপির দিকে। ২২ কংগ্রেস বিধায়ক ইস্তফা দিয়ে সংখ্যালঘু করে দিলেন সরকারকে। ক্ষমতা বাঁচাতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল বিধায়কদের। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। একদা কংগ্রেসে কমলনাথ-বিরোধী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া দিলেন বিজেপিতে যোগ। পদত্যাগ করলেন কমলনাথ। ফের ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগে জর্জরিত হয়েও জিতল বিজেপি। ক্ষমতা দখল করলেন শিবরাজ চৌহানরা।
২০২০- রাজস্থান
২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগ উঠলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি। কিন্তু ২০২০ সালের রাজ্য সভার ৪ আসনের নির্বাচন ফের সমস্যা বাড়ায় রাজস্থানে। প্রায় ৮০ জন কংগ্রেস বিধায়ককে উদয়পুরের হোটেলে বন্দি করেন অশোক গেহলতরা।
২০২২ - মহারাষ্ট্র
জুনের ২১ থেকে ৩০। মাত্র ৯ দিনের ঘটনা পরম্পরা উত্তপ্ত করে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একদা বন্ধু, নিজের মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী একনাথ শিন্ডে অসমে পাড়ি দেন একাধিক বিধায়ক সঙ্গে নিয়ে। চাপে পড়েন উদ্ধব ঠাকরে। সরকারের লাগাম এক ধাক্কায় চলে যায় বিজেপির হাতে।
একবার নয়, একাধিকবার বিধায়ক কেনাবেচা, টাকার জোরে সরকার ভাঙার খেলায় মেতেছে বিজেপি- উঠেছে এই অভিযোগ। একাধিক রাজ্যে বিধায়ক ভাঙিয়ে গণতন্ত্রকে অপমান করেছেন অমিত শাহরা, এই দাবি উঠেছে গেরুয়া-বিরোধী শিবিরে। কিন্তু সবকিছু পেরিয়েও লক্ষ্যপূরণ করেছে বিজেপি। সংবিধানে কঠিন দলত্যাগী আইন না থাকা, দল বদলে সরকার ফেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে তেমন কোনও কঠিন বন্দোবস্ত না থাকার সুযোগে বারবার জনতার রায়ের বিপক্ষে ঘুরেছে রাজনৈতিক গতিপথ। পরিবর্তন হয়েছে ক্ষমতার আধার। এবার হিমাচল প্রদেশ। ফের কি এখানেও একই উদাহরণ সৃষ্টি করবে বিজেপি, নাকি কংগ্রেস রুখে দেবে সব উদ্যোগ? প্রশ্ন উঠছে, উত্তর দেবে সময়।