বিখ্যাত এই বাঙালির চিঠিতেই ভারতে এল রেল? যে তথ‍্য অনেকেরই অজানা

Indian Railways: ভাবতেও অবাক লাগতে পারে যে, খাস কলকাতার বুকে ট্রেন চলাচল করত।

১৯০৯ সাল, ১ জুলাই। জনৈক অখিলচন্দ্র সেন ট্রেনে চেপে তাঁর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। যাত্রার পূর্বে তিনি একটু বেশি কাঁঠাল খেয়ে ফেলেছিলেন। যার ফলে তিনি শৌচাগার ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ট্রেন এসে একটি স্টেশনে থামতে তিনি ট্রেন থেকে নেমে শৌচাগারে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু শৌচাগারে থাকাকালীনই তিনি ট্রেনের গার্ডের হুইসলের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যাবে, এদিকে তাঁর শৌচকর্ম তখনও বাকি। তাও তিনি কোনওমতে তা সেরে একহাতে ধুতি এবং অপর হাতে লোটা নিয়েই ট্রেন ধরতে ছুটেছিলেন। যদিও তাঁর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি ট্রেন ধরতে পারেননি। ট্রেন ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে অভিমানে তিনি ২ জুলাই ভারতীয় রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লিখে তাঁর অবস্থার বিস্তৃত বিবরণ জানিয়েছিলেন। এই ঘটনার পূর্বে ভারতে ট্রেনের মধ্যে শৌচাগার থাকত না। যাত্রীদের শৌচাগার ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হলে পরবর্তী স্টেশন অবধি অপেক্ষা করতে হতো। অখিলচন্দ্র সেনের লেখা সেই চিঠির ফলে ভারতীয় রেল যাত্রীদের কথা মাথায় রেখে ট্রেনে শৌচাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করে। আজও সেই চিঠি নিউ দিল্লির রেল জাদুঘরে সযত্নে সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

বাংলা, বাঙালি এবং ভারতীয় রেলের বিভিন্ন মজাদার গল্প রয়েছে, যা আজ বহু মানুষের কাছেই অজানা। ১৮৪৩ সালে মুম্বই এবং থানের মধ্যে ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা হলেও ১৬ এপ্রিল, ১৮৫৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৬ এপ্রিল দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ একুশ তোপের সেলামি দিয়ে সেই ট্রেন বোড়ি বন্দর স্টেশন থেকে ছেড়েছিল। ১৮৫৪ সালের ১৫ অগাস্ট হাওড়া স্টেশন থেকে প্রথম ট্রেন হুগলির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তখন ইংরেজ শাসকরা জানত না যে, এই দিনটি আগামী একশো বছরের মধ্যে তাদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে চলেছে।

১৮৪৩ সালে ভারতে প্রথম ট্রেন-চলাচল শুরু হলেও এক বিখ্যাত বাঙালি ব্যক্তিত্ব তার আগেই ট্রেনে চেপেছিলেন। যদিও ভারতে ট্রেন চলাচল চালু হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হওয়ার কারণে তিনি ভারতে কোনওদিন ট্রেন দেখেননি। সেই বিখ্যাত ব্যক্তির নাম রাজা রামমোহন রায়। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ট্রেন দেখে তিনি খুবই আশ্চর্য হয়েছিলেন। তাই ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৩১ সালে তিনি স্টিম ইঞ্জিনে টানা ট্রেনে চেপেছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি যে ট্রেনে চেপেছিলেন, তার সাত ঘণ্টার যাত্রাপথে চড়াইয়ের সময়ে তার গতি খুব কমে যাওয়ার কারণে তিনি ট্রেনের প্রতি খুব একটা প্রসন্ন হতে পারেননি। সেই সময়ের সংবাদপত্রে তাঁর এই ট্রেনযাত্রার খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন: ট্রেনের হর্নেই লুকিয়ে সমস্ত ইঙ্গিত! ভারতীয় রেলের হর্ন ব্যবস্থার অজানা যেসব তথ্য

ভারতীয় রেলের কথা বললে অপর এক বাঙালির নাম উঠে আসতে বাধ্য। তিনিও ইংরেজ সরকারকে ভারতে ট্রেন সংক্রান্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর নাম প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮৪৩ সালে তাঁর লেখা এক চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনি গঙ্গাপথে কলকাতা থেকে এলাহাবাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। যদিও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তাঁকে ভাগলপুরে তাঁর যাত্রা বাতিল করে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়। তিনি লিখেছিলেন, 'আমাদের গঙ্গা তোমাদের দেশের নদীর মতো নয়।' তাই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁকে মাঝপথে তাঁর যাত্রা স্থগিত করতে হয়েছে। এই দু'টি জায়গার মধ্যে রেলপথ থাকলে তার যাত্রা এইভাবে স্থগিত হতো না। বহু ক্ষেত্রে তাঁর লেখা এই চিঠিকেও ভারতে রেলপথ স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হিসেবে ধরা হয়।

দেড়শো বছরের বেশি সময় অতিবাহিত করে ভারতীয় রেল আজ বহুবার রূপ পরিবর্তন করেও প্রতিদিন পণ্য থেকে যাত্রী, সব পরিবহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ট্রেন এবং রেল ব্যবস্থার সঙ্গে বহু চরিত্র বাংলা সাহিত্যের পাতায় উঠে এসেছে। কোথাও হর্ষবর্ধন এবং গোবর্ধন ট্রেনে উঠে টিকিট ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে, আবার কোথাও শঙ্কর একা এক রেল স্টেশনে বসে রয়েছে আবার কোথাও ফেলুদা এবং কোম্পানি গোপীনাথ গোরে-কে ট্রেনের কামরায় ধরে ফেলছে।

বর্তমানে কলকাতা শহরের বুকে থাকা ট্রামলাইন যেখানে অদৃশ্য হতে শুরু করেছে, সেখানে ভাবতেও অবাক লাগতে পারে যে, খাস কলকাতার বুকে ট্রেন চলাচল করত। যদিও তার পরবর্তী প্রজন্মের একটা ছোট অংশ আজও অবশিষ্ট রয়েছে। বাংলায় বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে মার্টিন লাইট রেলওয়ের ন্যারো অথবা ছোটো লাইনের ট্রেন চলত। কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে দু'টি রুটে মূলত এই ট্রেনগুলো চলত, তার মধ্যে শ্যামবাজার (যদিও স্টেশনটি বেলগাছিয়া এলাকার কাছে ছিল) থেকে বারাসাত, কালীঘাট থেকে ফলতা রেলপথ ছিল। এই ট্রেনগুলোর গতি কম থাকার কারণে এবং পরবর্তীকালে সর্বত্রই বাস চলাচল শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে লোকসানের ফলস্বরূপ স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেই এই রেলপথদু'টি বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতা ছাড়াও প্রায় একই সময়ে হাওড়া আমতা, আহমেদপুর কাটোয়া, শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর নবদ্বীপ ঘাটের মধ্যে মার্টিন লাইট রেলওয়ের ন্যারো গজ অথবা ছোট লাইনের ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল। ১৮৭৫ সালে শুরু হলেও চক্ররেলের প্রথম উদ্দেশ্য যাত্রী পরিবহণ ছিল না। কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য পরিবহণ করে বন্দর এলাকায় সেই পণ্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই এই রেলপথ চালু হয়েছিল। পুরো রেলপথ কলকাতার চারিদিকে একটি বৃত্ত তৈরি করে বলেই এই রেল পথের নাম হয়ে যায় চক্ররেল। যদিও বর্তমানে পণ্য পরিবহণের সঙ্গে চক্ররেলের রেলপথ যাত্রী পরিবহণের কাজেও ব্যবহৃত হয় কিন্তু যাত্রী পরিবহণের জন্য এই লাইনে ট্রেন সংখ্যা খুবই কম। কলকাতা স্টেশন এই চক্ররেলপথের একটি স্টেশন। কলকাতা স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে পাতিপুকুর স্টেশনের দিকে গেলে চক্ররেলের নামের সার্থকতা বোঝা যায়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে গল্পের পাতা, বাংলা, বাঙালি এবং রেল যেন কোথাও এসে একই সঙ্গে যাত্রা করে।

More Articles