এক চিঠিতে দেশ ধ্বংসের পরিকল্পনা! যেভাবে হিটলারের হাত থেকে জার্মানিকে বাঁচালেন তাঁর মন্ত্রী
World War 2: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন একেবারে শেষ পর্যায়ে। সেই সময়ই হিটলারের একটি সিদ্ধান্ত সবাইকে চমকে দেয়...
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ - বলা হয়, এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আপনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে একটি ঘটনাও বলতে পারেন, বা অনেকগুলি ঘটনার সম্মিলিত পরিণামও বলতে পারেন। এই মহাযুদ্ধের এক পক্ষে ছিল মিত্রশক্তি (Allied Forces), যাদের নেতৃত্বে ছিল রাশিয়া, ব্রিটেন, আমেরিকা প্রভৃতি দেশগুলি। অপর পক্ষে ছিল অক্ষশক্তি (Axis Forces)। জার্মানি, ইতালি, জাপান ও তাদের সহযোগী অন্যান্য দেশগুলি এই পক্ষের নেতৃত্বে ছিল। সেইসঙ্গে ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। জার্মানির ফ্যুয়েরার, যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। সেইসঙ্গেই ছিলেন বেনিত্তো মুসোলিনি, উইন্সটন চার্চিলের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বরা।
যাই হোক, ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর এই যুদ্ধ শুরু হয় বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। সমাপ্ত হয় ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে। অক্ষশক্তির শেষ দেশ জাপান আত্মসমর্পণ করতেই এই মহাযুদ্ধ, ইতিহাসের কলঙ্কময় একটি অধায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। যদিও খাতায় কলমে সেপ্টেম্বরে যুদ্ধ শেষের উল্লেখ করা হয়। অবশ্য ১৯৪৫-এর শুরুতেই অক্ষশক্তি বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে, তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। ফলত তারা বেশ কয়েকটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এরমধ্যে অন্যতম পদক্ষেপ ছিল জাপানের কামিকাজি প্রথা। এই প্রথা অনুসারে, জাপানি যুদ্ধ বিমানগুলি একেবারে চালক সমেত শত্রুপক্ষের ডেরায় আছড়ে পড়ত। এতে পাইলটরা নিজেরা তো মরতেনই, সঙ্গে ক্ষতি হত মিত্রশক্তির সৈন্যদের জান এবং অস্ত্রেরও। এই কামিকাজি বিমানের জেরে নাজেহাল অবস্থায় পড়ত মিত্রশক্তিরা।
আরও পড়ুন : আতঙ্ক বিশ্বজুড়ে! ভয়াবহ পরমাণু যুদ্ধর সম্ভাবনা কতটা জোরালো হচ্ছে?
জাপানের এই মারণ কামড় পছন্দ হয় জার্মান ফ্যুয়েরার অ্যাডলফ হিটলারের। একপ্রকার 'অনুপ্রাণিত' হয়ে এরকমই একটি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন অক্ষশক্তির এই নেতা। সালটা ১৯৪৫, ৩০ এপ্রিল। সরকারিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বেশ কয়েক মাস আগেই নিজের বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেন হিটলার। সেই সময় রাশিয়ার লাল ফৌজ বার্লিন পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছিল। তবে ধূর্ত হিটলার আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, 'শেষের সে দিন' খুব দূরে নেই। অক্ষশক্তির পরাজয় অনিবার্য। সেজন্য কামিকাজির ঢঙে তিনি একটি নির্দেশ জারি করেন। এমন নির্দেশ, যার ফলে জার্মানি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। নিজের মৃত্যুর ৪২ দিন আগে অর্থাৎ ১৯ মার্চ, হিটলার জারি করেন সেই নির্দেশ। ইতিহাসের পাতায় যার নাম ‘নিরো ডিক্রি’। নিরো ডিক্রি শব্দটির অর্থ হল 'নিরোর হুকুমনামা'।
হিটলার যেদিন এই হুকুমনামা জারি করেন, তার আগের দিন তার কাছে একটি চিঠি আসে। চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন হিটলারের ‘ডান হাত’ এবং তার ক্যাবিনেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী অ্যালবার্ট স্পিয়ার। স্পিয়ার নিজের চিঠিতে স্পষ্ট করে হিটলারকে জানিয়ে দেন যে, দেশের যা অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যেই দেউলিয়া ঘোষণা করতে হবে জার্মানিকে। চিঠিতে হিটলারকে স্পিয়ার অনুরোধ করেন তিনি যেন যুদ্ধ থামিয়ে দেশের মানুষের কথা একটু চিন্তা করেন। এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যাতে দেশের মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকে।
আরও পড়ুন : ভয়াবহ মারণাস্ত্র রাশিয়ার হাতে, ফিরে আসছে ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতি?
তবে ইতিহাসবিদদের দাবি, ওই আগুন আসলে নিরোই লাগিয়ে ছিলেন। নিরো ছিলেন তীব্র খ্রিস্টান বিরোধী। পরিকল্পনামাফিক নিজের কয়েকজন অনুচরকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আগুন লাগাতে পাঠিয়ে দেন তিনি। শোনা যায়, নিজে প্যালেন্টাইনের প্রাসাদে বসে এই ধ্বংসলীলা দেখছিলেন নিরো। সেই দৃশ্য দেখে মনের আনন্দে গান-বাজনা করছিলেন। সেই থেকে একটি প্রবাদ চালু হয়ে যায়, “রোম যখন আগুনে জ্বলছিল, নিরো তখন মনের আনন্দে বাঁশি বাজাচ্ছিল।”
আরও পড়ুন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছেন, টাইগার শ্রফের বাঙালি দাদুর গল্প স্তম্ভিত করবে!
যাই হোক, এবার মূল গল্পে ফেরা যাক। মনে আছে নিশ্চয়ই, আমি বলেছিলাম অ্যালবার্ট স্পিয়ার ছিলেন হিটলারের ক্যাবিনেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। আসলে তার দায়িত্বে ছিল অস্ত্র মন্ত্রক। স্পিয়ার অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, নিজের মন্ত্রকের দোহাই দিয়ে রিচ ধ্বংস করার দায়িত্ব হিটলারের থেকে নিয়ে নেন। হিটলারকে তিনি সুকৌশলে বুঝিয়ে দেন, কাজটির জন্য তিনি একাই যথেষ্ট। সুতরাং অন্যান্য মন্ত্রী এবং কমান্ডারদের থেকে দায়িত্ব ফিরিয়ে নেন হিটলার। এবার একটি মোক্ষম চাল দিলেন স্পিয়ার। হিটলারের জারি করা সেই ডিক্রিটি আর নিচের মহলে পাঠালেনই না তিনি। অর্থাৎ নিচুতলার সেনাবাহিনীর কাছে সেই হুকুমনামা আর পৌঁছল না। যেহেতু স্পিয়ার একাই কাজটির দায়িত্ব নিয়েছেন, তাই অন্য কারোর থেকে আর নির্দেশ পাওয়ার কথাও নয়। যথারীতি হুকুমনামা এলো না, তাই আর ধ্বংসলীলাও হলো না। নিজের উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে সে যাত্রায় জার্মানিকে বাঁচিয়ে নেন অ্যালবার্ট স্পিয়ার।
তবে এপ্রিল মাসের শেষভাগে যখন হিটলার বার্লিনে নিজের বাঙ্কারে লুকিয়ে রয়েছেন, তখন সেখানে গিয়ে সব সত্যি কথা বলেন স্পিয়ার। ইতিহাসে এটাই বোধহয় এক এবং একমাত্র ঘটনা যখন হিটলার কাউকে ক্ষমা করে দেন। অবশ্য এর কয়েকদিন পরেই সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন হিটলার। এরপর অ্যালবার্ট স্পিয়ারের কী হলো ? জার্মানিকে বাঁচিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ভুলেও ভাববেন না যে স্পিয়ার একজন নায়ক ছিলেন। এর আগে হিটলারের বহু ঘৃণ্য অপরাধের সহযোগী ছিলেন তিনি। যথারীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় ওয়ার ক্রাইমে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় কুড়ি বছরের জেল হয় অ্যালবার্ট স্পিয়ারের।