জামা ছিঁড়ে খালি গায়ে রঙ খেলার কাছে হাজার গোলে হেরে যায় তিন আঙুলের আবিরের দোল
Holi 2023: এই কয়েকদিন আগেও দোলের শেষে সবার জামা একসঙ্গে ছিঁড়ে পরপর বেঁধে রাস্তায় উঁচু তারে ঝুলিয়ে খালি গায়ে বাড়ি ফিরতাম!
এই সময় দুপুরে খেলে আসার পরের একটা নির্দিষ্ট গন্ধ আছে। ফ্রুট স্কোয়াশের গন্ধ। ফ্রিজে ঠান্ডা জল রাখা সবে শুরু হয়েছে। এবারের মাসকাবারির কোণায় তাই লাজুক হাত লিখে রেখেছে রসনা, আরেকটু স্বচ্ছল হলে কিসান। এই খর দুপুরে খেলার পর সব বন্ধুরা যখন বসার ঘরের পাখা ৫-এ করে হাঁপাতাম, রান্নাঘর থেকে ফুলতোলা ডিজাইনের কাঁচের গ্লাসে করে মা নিয়ে আসত উপশম। সে এত ভীষণ এক কমলা রঙের পানীয় ছিল যে স্বয়ং কমলালেবুও লজ্জা পেয়ে যেত! এতই ঠান্ডা ছিল যে আন্টার্কটিকাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত! আর আরাম ছিল মায়ের চেবানো পান খাওয়ার মতো। দুপুরের থালাকে মুগ্ধ করে রাখে সদ্য যৌবন ছুঁয়ে দেওয়া পটল, এঁচোড়, ঝিঙে, আর এই সময়ে মায়ের আরেক মুশকিল আসান পাড়ার দোকানের দই। যেদিন পদ কম বা মাছ নেই, গো টু দই! পান্তা দিয়ে ডালের বড়া, কুচো চিংড়ির ঝাল আর শেষ পাতে আম ঝোল খাওয়ার পর শরীর আর বইতে না চাইলে মা ঘরের জানলা বন্ধ করে দিত। কাঠের জানলা, আজকের ফ্ল্যাটের কাঁচের জানলা নয়। সেই জানলা দিয়ে দেওয়ার অর্থ নিকষ কালোকে অভ্যর্থনা জানানো। সেই অন্ধকারে অনুপ্রবেশের অধিকার ছিল শুধু ভেন্টিলেটরের আলোর। ভেন্টিলেটরের ছোট্ট খোলামুখ দিয়ে আলো ঢুকে নকশায় জারিত হয়ে অন্ধকার ঘরের ছাদে ছড়িয়ে পড়ত। আমার ওই ছড়িয়ে পড়া জাফরি কাটা আলো দেখে মনে হতো বিশাল ঘেরের নাইটি পরে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা গা ছমছম সিলিং আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত।
ঘুম ভাঙত পাড়ার বন্ধুদের ডাকে। সবাই না এলে টিম করা যাচ্ছে না, তাই এক্ষুণি দরকার আমাকে। গিয়ে প্রথম কাজ, মাঠের অবাধ্য ধুলোকে শান্ত করতে বালতি বালতি জল ছেটানো। পরীক্ষা শেষের বিকেল শেষে যে সন্ধ্যা নামে তার মতো পিছুটানহীন হতে এক জন্মের সাধনা লাগে। কেউ পড়তে বসতে বলার নেই, কেউ নেই তাড়া দেওয়ার, অখণ্ড ছুটি বলতে যা বোঝায়। এরকম সন্ধ্যেবেলা, যখন অন্ধকারে বন্ধুর মুখ মিশে যায়, আদর্শ সময় নিজের গোপন কথা বলার, বা বন্ধুর গোপন কথা শোনার। মাথার উপরের মশা ইনিয়ে বিনিয়ে গুজব রটানোর ভয় দেখায় বটে, তবে পাত্তা বিশেষ পায় না। হঠাৎ দেখি চিত্রহারে বাজছে 'রং বরসে' বা 'হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়', বুঝতে পারতাম হাওয়ায় হাওয়ায় দোল এসে হাজির।
আরও পড়ুন- হাতকাটা দুঃখরা ফুলহাতা হয় শীতেই, খোসা ছেড়ে আসে কমলালেবু, না হওয়া প্রেমরা…
বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রকম হয় দোল। অভিনেতা হওয়ার দরুণ আরও নানারকম স্তরে দোল খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে। শিল্পপতি, অধ্যাপক থেকে পুলিশকর্তা কে নেই সেই লিস্টে! কিন্তু এক ধরনের মাতাল থাকে না, যাদের যত দামি মদই খাওয়াও বাড়ি ফিরে নিজের চেনা সস্তার রোজকার মদ না খেলে ঘুম আসে না, আমার দশাও হয়েছে তাই! যেখানে যেমন খুশি দোল খেলি, পাড়ায় না ফেরা অবধি, দোল না খেলা অবধি আত্মা শান্তি পায় না। কী হয় আমার পাড়ায়? নির্ভেজাল দুষ্টুমি, ফাজলামি এবং হো হো হাসির এক আরামদায়ক দুপুর। আসলে যখন আমরা পাড়ায় বেরোই পুরনো জামা বের করে পরি, যাতে দাগ লাগলেও আপশোস না হয়, আমরা ওই পুরনো জামার সঙ্গে বের করে নিই আমাদের পুরনো পরিচয়ও। কাজেই আমরা যখন পাড়ায় পৌঁছই তখন আর ব্যাঙ্কের কর্তা, আইটির উচ্চপদস্থ অফিসার বা চলচ্চিত্রের অভিনেতা- এসব পরিচয় বাড়ির তাকে তোলা থাকে, এখানে জয়জয়কার শুধু ডাকনামের। এখন যখন আমি এই লেখা লিখছি, তখনও আমাদের পাড়ার হোয়াটস্যাপ গ্রুপে ধুন্ধুমার চলছে শুরু কী দিয়ে হবে তাই নিয়ে। শেষ পর্যন্ত যা খবর তাতে, আমোদি মাছ বেশ কিছু ভোটে এগিয়ে।
আরও পড়ুন- সরস্বতীপুজোয় খুঁজি ব্যক্তিগত বনলতা সেনকে, মুখে যার শ্রাবস্তীর কারুকাজ ব্রণ হয়ে ফুটে থাকে…
দেখুন, একটা কথা শুরুতেই স্বীকার করা ভালো। ফাগুন লেগেছে বনে বনে গেয়ে তিন আঙুলের ডগায় আবির লাগানোর যে দোল হয় ওসব বোঝার মতো সূক্ষ্মতা হয়তো আমার নেই। এই কয়েকদিন আগেও দোলের শেষে সবার জামা একসঙ্গে ছিঁড়ে পরপর বেঁধে রাস্তায় উঁচু তারে ঝুলিয়ে খালি গায়ে বাড়ি ফিরতাম, সে আর কত ভদ্রসভ্য হবে? আমি চেষ্টা যে করিনি তা নয়, কিন্তু নিজের কাছে নিজেকেই অসৎ মনে হয়েছে। বারবার মনে হয়েছে, হেথা নয় হেথা নয়, এই তিন আঙুলের আবিরের দোল আমার নয়। তাই সযত্নে মাপা হাসি-চাপা কান্না মার্কা নেমন্তন্ন আমি এড়িয়ে যাই। আমি তাদের সঙ্গেই আনন্দ করব যারা বাবিনকে গুরুত্ব দেয়, রাহুল সেখানে কেউ নয়। রানাদা, মিমিদি, সন্টাই এরা আমার নেশা বেশি হয়েছে বুঝলে চ্যাংদোলা করে বাথরুমে বসিয়ে স্নান করিয়ে দেবে দরকার হলে, আমাকে নিয়ে হাসবে না। তবে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখা কিছু গালাগাল খেতে নিশ্চয়ই হবে। সেটা বরং ভালো। আজকাল তো বকার লোক কমে যাচ্ছে আর সব কিছুতে 'বাহ' বলার লোক বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওই, এইখানেই ডাকনাম জিতে যায়। জিতে যায় মাঠের অন্ধকারে মিশে থাকা মুখ যার কাছে সেই প্রথম সত্যি বলার পর আগল খুলে গেছে। তাকে আজও আমার সব জানানো চাই, জিতে গেছে শাহরুখ, সলমান তর্কে বয়ে যাওয়া দুপুর।হারেনি কি কিছুই? হেরেছে সময়ের আমাদের কে সাদা কালো করার চক্রান্ত। আমরা রঙিন ছিলাম, আছি, থাকব। হোলি হ্যায়!