কীভাবে তৈরি হত কন্ডোম? তাজ্জব করবে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ প্রাচীন কন্ডোমের এই ইতিহাস
History of Condom: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ত্রের পাশাপাশি কন্ডোমও জোগান দেওয়া শুরু হয়। যদিও কন্ডোম ব্যবহারে বেশ নাক সিঁটকাত আমেরিকান ও ব্রিটিশ সেনারা।
ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস। দেহপসারিনীদের বাড়িতে আসা-যাওয়া লেগেই থাকতো রাজার। যার ফলস্বরূপ তিনি জন্ম দিয়েছিলেন বেশ কিছু ‘অবাঞ্ছিত’ সন্তানদের। মজার বিষয় হল, সেই ‘অবাঞ্চিত’ সংখ্যাটি হাতে গোনা যেত না এবং অনেকেই এসে দাবি করতেন তাঁরা রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সন্তান। বড়ই সমস্যায় পড়লেন রাজামশাই। রাজার ডাক্তার তখন এক উপায় বাতলালেন। ডাক্তারের জানা ছিল যৌন সঙ্গমের সময় শিশ্নকে পাতলা আবরণে ঢাকা রাখলে যৌন রোগ আটকানো যায়। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ বন্ধ করতে তিনি রাজাকে সেই রকমই পাতলা আবরণ ব্যবহার করতে নির্দেশ দিলেন।
রাজা দ্বিতীয় চার্লসের এই ডাক্তারের নাম ছিল কলোনেল কন্ডোম। অনেকে বলেন জন্মনিরোধক বা কন্ডোম নামই এসেছে কলোনেল কন্ডোমের নামানুসারে। মতান্তরে ল্যাটিন শব্দ ‘Condus’ থেকে এসেছে কন্ডোম শব্দটি, যার অর্থ পাত্র বা ভেসেল। আবার অনেকেই বলেন পার্সি শব্দ ‘Kemdu’ থেকে এসেছে কন্ডোম শব্দটি, যার অর্থ আবার অন্ত্রের দীর্ঘ কোনও অংশ, যা কোনও কিছু সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।
আর উঠল যখন অন্ত্রের ব্যবহারের প্রসঙ্গ, সেখানেই লুকিয়ে আছে কন্ডোমের ইতিহাস। অনেকে বলেন পৃথিবীর প্রাচীনতম কন্ডোমটি ১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এবং সেই কন্ডোম আবার পাওয়া গেছিল তুতেনখামেনের মমির পাশেই। সেই সুতির কন্ডোমে পাওয়া শুক্রাণুর জেনেটিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল, তার সঙ্গে তুতেনখামেনের জিনের হুবহু মিল। অর্থাৎ সেই কন্ডোম যে স্বয়ং তুতেনখামেনেরই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এটি ছিল সুতির তৈরি। কোনও প্রাণীর অন্ত্রের নয়।
আরও পড়ুন- যৌনসুখে বাধা নয় কন্ডোম, চরম মুহূর্ত দীর্ঘ করতে কী টোটকা লুকোনো নিরোধে?
১৯৬৪ সালে প্রকাশিত বি ই ফিনচ এবং এইচ গ্রিনের লেখা বই ‘কন্ট্রাসেপশন থ্রু দি এজেস’ সূত্রে জানা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রথম কন্ডোমটি (এখনও অবধি যার নথিবদ্ধকরণ হয়েছে) ব্রোঞ্জ় যুগের, অর্থাৎ প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। ক্রীটের রাজা কিং মিনোস এটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। এমনকী এর উল্লেখ পাওয়া যায় হোমারের লেখা ইলিয়াডে। তাঁর সমস্ত স্ত্রী, যারাই তাঁর সঙ্গে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিলেন, ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছিলেন। তখন বাতাসে রটছে কিং মিনোসের বীর্যে রয়েছে সাপ এবং বিছের বিষ। যার প্রভাবেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন তাঁর স্ত্রীরা। অগত্যা তাঁকে এবং তাঁর তৎকালীন স্ত্রী পাসিফিকে বাঁচাতে ছাগলের মূত্রথলি ব্যবহার করে দেখা হল। সঙ্গমের সময়ে সেই মূত্রথলি মহিলাদের যোনিদেই বসানো হতো, যোনির চাপে সেটি আটকে থাকতো যোনির গায়ে। আবার মতান্তরে পাসিফি নয়, সঙ্গমের সময়ে রাজা মিনোস নিজেই ব্যবহার করতেন সেই ছাগলের মূত্রথলি।
এ কলারের লেখা ‘দ্য হাম্বল লিটল কন্ডোম: আ হিস্ট্রি’ (২০০৭) সূত্রে জানা যাচ্ছে, ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরেই প্রথম গর্ভনিরোধক পাতলা আবরণের ব্যবহার শুরু হয়। তবে গর্ভনিরোধের আগেও সেই সময় যে বিষয়টিতে নজর দেওয়া হয়েছিল, তা হল বিলহার্জি়য়ার মতো যৌনরোগকে প্রতিহত করা। পরবর্তীকালে মিশরীয় পুরুষেরা কন্ডোমে রঙও ব্যবহার করা শুরু করে। যার মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল সেই পুরুষটির সামাজিক অবস্থানকে কন্ডোমের রঙ দিয়ে চিনিয়ে দেওয়া। ‘দ্য হাম্বল লিটল কন্ডোম: আ হিস্ট্রি’ বইটি থেকেই জানা যাচ্ছে প্রাচীন রোমে লিনেন এবং ছাগল ও ভেড়ার মতো বিভিন্ন প্রাণীর অন্ত্র থেকে তৈরি করা হতো কন্ডোম।
‘কন্ট্রাসেপশন থ্রু দি এজেস’ বইটি থেকে জানা যাচ্ছে নিউ গিনিতে জুকাস নামে প্রাচীন উপজাতিটিও নিজেদের মতো করে তৈরি করেছিল গর্ভনিরোধী কন্ডোম। তবে পুরুষদের জন্য নয়। এই কন্ডোম বানানো হয়েছিল মেয়েদের জন্যেই। এবং সভ্যতার ইতিহাসে মিশর, রোমান বা গ্রিকদের বানানো যত কন্ডোম ছিল, তার থেকে জুকাস উপজাতিদের তৈরি কন্ডোম ছিল সবথেকে আলাদা। সম্ভবত এই উপজাতিই প্রথম যারা গাছ থেকে তৈরি আবরণ জন্মনিরোধক হিসেবে ব্যবহার করত।
সিল্কজাত বস্ত্র উৎপাদনে চিনাদের সুনাম দীর্ঘকাল থেকেই। প্রাচীন চিন সভ্যতায় গর্ভনিরোধক পাতলা আবরণ তৈরি হতো সিল্ক থেকে। আর সেই সিল্ক দিয়ে তৈরি গর্ভনিরোধী আবরণের ব্যবহার হু হু করে বাড়ল যখন প্লেগ-সহ বিভিন্ন জটিল রোগ পূর্ব থেকে মধ্য ইউরোপ অবধি ছেয়ে গেল। গর্ভনিরোধক আবরণ তৈরিতে পিছিয়ে থাকেনি জাপানও। তারাও বানাল কবুতা-গাতা। যা আদতে কচ্ছপের তৈরি খোলস দিয়ে বানানো। তবে সম্পূর্ণ শিশ্ন নয়, কবুতা-গাতা আবরণ করতো শিশ্নের উপরিভাগটুকুই। অন্যদিকে এই কবুতা-গাতাই ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো লিঙ্গোত্থানের (erectile disfunction) সমস্যা দেখা গেলে।
আরও পড়ুন- যৌনমিলনের জন্য লাল-নীল হয় কচ্ছপের মাথা! কেমন আছে চম্বলের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীরা?
তারপর পনেরো থেকে আঠেরো শতকে যখন ইউরোপে রেনেসাঁ চলছে, যখন চার্চ ব্যক্তিগত জীবন, সাহিত্য কিংবা বিজ্ঞানচর্চায় নাক গলায়নি, সেই সময় গ্যাব্রিয়েল ফ্যালোপিনো বর্ণনা দিচ্ছেন ফ্যালোপিয়ান টিউবের, গবেষণা করছেন কন্ডোম নিয়ে। তাঁর লেখা বই ‘দ্য মরবো গ্যালিকো’, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘দ্য ফ্রেঞ্চ ডিজি়জ়’, সেখানে তিনি বর্ণনা দিচ্ছেন লিনেনের তৈরি পাতলা আবরণের। ১১০০ জন পুরুষের উপর গবেষণা করে তিনি দেখান, এই ধরনের লিনেনের পর্দা সিফিলিস-সহ বহু যৌনরোগ প্রতিরোধ করতে পারে। তারপর চার্চ যখন ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানো শুরু করল, কন্ডোমের ব্যবহারকে পাপ বলে ঘোষণা করলো চার্চ। কারণ আঠেরো শতকের শেষের দিকে কন্ডোম কেবল ইউরোপ নয়, সারা ইংল্যান্ড জুড়ে জনসংখ্যা বহুলভাবে হ্রাস করে ফেলেছে। সেই কথা মাথায় রেখেই রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে কন্ডোম ব্যবহারের পরামর্শ দেন তাঁর ডাক্তার কলোনেল কন্ডোম।
আঠেরো শতকের পরে, কন্ডোমেরর উপাদানে বিপুল পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আমেরিকার চার্লস গুডইয়ার আদতেই আধুনিক কন্ডোম তৈরিতে বিপ্লব আনেন একপ্রকার। তখন শিল্পস্তরে কন্ডোম তৈরি করা শুরু হয়ে গেল সালফার আর প্রাকৃতিক রাবারকে একসঙ্গে উত্তপ্ত করে। আঠেরো শতকের মাঝামাঝি কন্ডোম তৈরি শুরু হল বিপুল পরিমাণে, যাকে শিল্পের ভাষায় লার্জ-স্কেল প্রোডাকশন বলে।
১৯২০ সাল নাগাদ আবিষ্কার হল ল্যাটেক্স। তখন ল্যাটেক্স দিয়ে কন্ডোম তৈরি শুরু হল, যা আদতে প্রাকৃতিক রাবারের ঘনত্ব কমিয়ে তৈরি করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ত্রের পাশাপাশি কন্ডোমও জোগান দেওয়া শুরু হয়। যদিও কন্ডোম ব্যবহারে বেশ নাক সিঁটকাত আমেরিকান ও ব্রিটিশ সেনারা। যদিও তাঁরা ভালোভাবেই জানতেন কন্ডোম যৌনরোগ আটকাতে পারে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন সিফিলিস, গনোরিয়ার পাশাপাশি এইডস বাড়ছিল হু হু করে, তখন আমেরিকা অবশেষে নিজেদের সৈন্যদের জন্য কন্ডোম সরবরাহ করা শুরু করে।
পাতলা লিনেন থেকে আজকের এক্সট্রা থিনে আসার মাঝে অনেকটা ইতিহাস এবং সর্বপরি অনেকটা সচেতনতার ধাপ আমরা পেরিয়ে এসেছি। শুধু সেখানে দাঁড়িয়ে এখনও কিছু ধর্ম রিপ্রোডাকটিভ রাইটের মতো বিষয়ে নাকগলানো এখনও বন্ধ করতে পারেনি।