দেশজুড়ে বন্ধ ডেলিভারি সার্ভিস? দীপাবলিতে কেন হরতালের ডাক মহিলা গিগ শ্রমিকদের?

Woman Gig Labor Diwali: সারা দেশে গিগ কর্মীদের ফোন বন্ধ থাকবে এদিন, 'ডিজিটাল নীরবতা' পালন করবেন তারা।

আমরা ঘরে বসে প্রদীপ জ্বালাব, হালকা কিছু আতশবাজি, সঙ্গে দেদার ফটোসেশন। বন্ধু-স্বজনরা আসবে গৃহে। জমাটি আড্ডা, খাওয়াদাওয়া। কিন্তু উৎসবের দিনে সেজেগুজে কি রান্নাঘরে এতজনের হেঁশেল টয়হেলা যায়! কুছ পরোয়া নেহি! হাতে আছে মোবাইল, আর মোবাইলে আছে অ্যাপ। আঙুলের কারিকুরিতে নিমেষে অর্ডার পছন্দের খাবার, দোরগোড়ায় হাজির খাবার। যিনি খাবার নিয়ে আসছেন, বহু ঘরে বহু মানুষের রূপচর্চা করে দিচ্ছেন, মিস্ত্রির নানা কাজ করে দিচ্ছেন তিনি প্রদীপ জ্বালাবেন না? তাঁর ঘরে আসবে না স্বজনরা? চাকরি বড় বালাই। পেটের কাছে উৎসবের কোনও মূল্য নেই। বিশেষ করে সেই চাকরি যদি হয় বেসরকারি, অসংগঠিত, গিগ অর্থনীতি নির্ভর তাহলে সেখানে অধিকারের আওয়াজ খাটেও না। দেশজুড়ে হু-হু করে বাড়ছে গিগ শ্রমিকদের সংখ্যা। তাই ক্রমেই জোটও বাঁধছেন তারা। গিগ অ্যান্ড প্ল্যাটফর্ম সার্ভিস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন (জিআইপিএসডব্লিউইউ) হচ্ছে ভারতের প্রথম মহিলা নেতৃত্বাধীন গিগ শ্রমিকদের ইউনিয়ন। এই এই সংগঠন ৩১ অক্টোবর, দীপাবলিতে দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। জানিয়েছে, সারা দেশে গিগ কর্মীদের ফোন বন্ধ থাকবে এদিন, 'ডিজিটাল নীরবতা' পালন করবেন তারা।

২০২৩ সালে গঠিত হয় এই ইউনিয়ন। এর লক্ষ্য গিগ শ্রমিকদের, বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকদের শোষণের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। শ্রমিকদের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার, পক্ষপাতমূলক রেটিং সহ অন্যায়ভাবে অধিকার কেড়ে শ্রমিককে শোষণ করার বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপের আহ্বান জানায় এই সংগঠন। কাজের নিরাপত্তাহীন পরিবেশ বদলের ডাক দেয় তারা। নিজেদের প্রতিবাদের অংশ হিসাবেই এই শ্রমিক সংগঠনটি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম সংস্থাগুলির বা অ্যাপভিত্তিক সংস্থার কর্মচারী হিসাবে গিগ কর্মীদের স্বীকৃতি, মর্যাদাপূর্ণ কাজের পরিস্থিতি, ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন, শ্রমিকদের নানা অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা এবং শ্রমিকদের অধিকারের স্বীকৃতি দাবি করছে।

একটি বিবৃতিতে জিআইপিএসডব্লিউইউ জানিয়েছে, ভারত জুড়েই গিগ কর্মীরা ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, প্রতিকার ব্যবস্থা এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেশ কিছুকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে, গিগ কর্মীদের তাদের দায়িত্ব পালনের সময় হেনস্থা করা হচ্ছে, বৈষম্যমূলক আচরণ কর হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও হিংসার সম্মুখীনও হচ্ছেন তারা। এই চ্যালেঞ্জগুলির প্রেক্ষাপটেই GIPSWU ডিজিটাল স্ট্রাইক ডেকেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে শ্রম আইনের মাধ্যমে গিগ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, গিগ কর্মীদের জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরি এবং তাদের অধিকার রক্ষা করার আহ্বানও জানিয়েছে এই সংগঠন।

আরও পড়ুন- Exclusive : ডেলিভারি শ্রমিকদের নিয়ে কী ভাবছে কংগ্রেস? যা জানালেন কানহাইয়া কুমার

সরকারকে গিগ কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন স্কিম, বীমা প্রকল্প এবং আরও নানা সামাজিক সুরক্ষার অধিকাররক্ষার দাবিও জনিয়েছে এই শ্রমিক সংগঠন। গিগ কর্মীদের জন্য ম্যাটারনিটি বেনিফিট (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০১৭ এর অধীনে সুযোগ সুবিধার সম্প্রসারণের কথাও বলা হয়েছে।

দীপাবলিতে গিগ কর্মীদের ফোন বন্ধ করার পাশাপাশি, তাদের এবং তাদের পরিবারের ছবি ‘ডিজিটালস্ট্রাইক’ ‘জিআইপিএসডব্লিউ’ এবং ‘ব্ল্যাকদিওয়ালি’ হ্যাশট্যাগ সহ সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করতে বলেছে এই সংগঠন। দিল্লির একজন গিগ কর্মী বলছেন, বাড়িতে গিয়ে পার্লারের কাজ করে দেন তিনি। ২০১৮ সাল থেকে হোম সার্ভিস ফার্ম আর্বান কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত তিনি। তিনি জানাচ্ছেন, কোম্পানি নিজেই তার কাছে এসেছিল। অন্যান্য কাজ করার স্বাধীনতার পশাপাশি এই কাজ এবং নিজের সুবিধামতো বাড়ি থেকে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সংস্থা। ওই কর্মী নিজেদের সন্তানের কথা ভেবেই আর্বান কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভেবেছিলেন জীবন অর্থনৈতিকভাবে আরও সহজ হবে। সাত দিনের প্রশিক্ষণও নেন তিনি। সেখানে তাকে আর্বান কোম্পানির ব্যবহৃত পণ্যগুলির সঙ্গে পরিচয় করানো হয় এবং পরে বলা হয় তাকে ৩৫,০০০ টাকার একটি কিট কিনতে হবে।

অনেক মহিলাই এই কিট কেনার জন্য ধার নেন। অনেকে আবার নগদেই কিনে নেন। এতে ডিসপোজেবল নানা উপকরণ, ইউনিফর্ম, ব্যাগ এবং আরও অনেক কিছু থাকে। কোনও কর্মীই নিজস্ব ডিসপোজেবল ব্যবহার করতে পারবেন না। যদি কেউ করেন তাহলে তাঁর আইডি ব্লক করে দেওয়া হয়। কর্মীর রেটিং কমে গেলেই তাঁর আইডি ব্লক হয়ে যায়। কোনও কর্মী যদি একজন গ্রাহকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করেন, তাহলেও আইডি ব্লক হয়ে যায়।

গিগ কর্মীরা সংগঠনের অভ্যন্তরে ঘটে চলা বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে অনেক প্রতিবাদ সংগঠিত করলেও, ডিজিটাল ধর্মঘট এই প্রথম। কর্মীরা বলছেন, তারা চান তাঁদের আওয়াজ সরকারের কাছে পৌঁছক। কোম্পানিকে বলে কোনও লাভই হয় না। কোম্পানিতে ঢুকতেই দেওয়া হয় না। তাহলে অভিযোগ শুনবে কে? তাই সঠিক আইন প্রণয়ন করার দাবি জানিয়েছেন তারা। দীপাবলি প্রত্যেকের কাছে উত্সব হলেও গিগ কর্মীদের কাছে খুব সাধারণ এক দিন। উত্সবের দিনে অন্য দিনের থেকে বেশি পরিশ্রম করেও দিনের শেষে বেতন পাওয়া যায় না! গিগ কর্মীরা এই কোম্পানিগুলোকে যে কমিশন দেয় তা, এই কর্মীরা যে পরিমাণ আয় করে তার চেয়ে অনেক বেশি। এই সংস্থাগুলি কর্মীদের কথা ভাবে না বলেই অভিযোগ তাঁদের। আর নির্দিষ্ট বিধি না থাকায় কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব নিয়ম তৈরি করছে সুবিধামতো। আর্বান কোম্পানি, জোমাটো, সুইগি, ইয়েস ম্যাডাম এবং আরও অনেক কোম্পানিই নিজেদের নিয়মে চলে।

আরও পড়ুন- ডেলিভারি কর্মীদের জন্য বড় খবর! চাকরি-নিরাপত্তা রক্ষায় যে বিল আনছে এই রাজ্য

কম রেটিং হলেই কাজ না করতে দেওয়া, ছুটি নিলে বা অর্ডার বাতিল করলে ব্লক করে দেওয়া মতো যা ইচ্ছে চালিয়ে যায় কোম্পানিগুলি। আর কোনও কর্মীই কখনও স্থায়ী কর্মচারী হতে পারেন না এই সংস্থার। এই কর্মীদের বলা হয় 'পার্টনার' কিন্তু ন্যূনতম মজুরিও পান না। কখনও কখনও মাত্র ১০০-১৫০ টাকা উপার্জন করেন বলেও অভিযোগ তাঁদের। ডিজিটাল ধর্মঘটের মাধ্যমে গিগ কর্মীরা সাধারণ মানুষ, কোম্পানি এবং সরকারের কাছে এই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে চান। কীভাবে দীপাবলি উদযাপন করবেন তারা? দীপাবলিতে কাজ করতে যদি চানও, বিনিময়ে কী পাবেন তারা? প্রশ্ন করেছেন কর্মীরা।

নীতি আয়োগের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে বর্তমান গিগ কর্মশক্তি ৭.৭ মিলিয়ন। ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে তা বেড়ে ২৩.৫ মিলিয়ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই কর্মশক্তির একটা বড় অংশই মহিলা। তাদের কাজ পুরুষ গিগ শ্রমিকদের কাজের মতো হলেও তাঁদের দাবি দাওয়া গুলি আরও চাপা পড়ে থাকে। কোম্পানিগুলো নিজেদের সুবিধার জন্য এটিকে কাজে লাগায়।

জিআইপিএসডব্লিউইউ-এর সভাপতি চন্দন কুমার বলছেন, বেশিরভাগ মহিলা গিগ কর্মীরাই বাড়িতে বিবাহবিচ্ছেদ বা যৌন, মৌখিক বা শারীরিক নির্যাতন সহ নানা ধরনের হিংসার মুখোমুখি হন। এই মহিলারা যখন রক্ষণশীল পারিবারিক কাঠামো এবং হিংসাকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই তারা আবার কর্মক্ষেত্রে হিংসার শিকার হন। আর এই কোম্পানিগুলোই হিংসাকে ব্যবহার করেও বিলিয়ন ডলার আয় করছে। তাই উপযুক্ত আইন না থাকলে এই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের বঞ্চনা কমবে না কোনওভাবেই।

More Articles