টুইটারের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? খামখেয়ালি এলন মাস্ক যে প্রশ্ন তুলে দিলেন
Elon Musk Twitter Acquisition: এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি ধনীতম দল এবং যদি সামাজিক মাধ্যম দিয়ে মতামত সংগঠিত করার প্রশ্নটি আসে, তাহলে দেখা যাবে তাঁরাই তাঁদের প্রভাব খাটিয়ে নানান সময়ে ফেসবুক থেকে শুরু করে টুইটারক...
বেশ কিছু ধনী মানুষদের সন্তানদের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা প্রায়শই দেখা যায়। তারা যদি কোনও খেলনা বা অন্য কিছুর বায়না করে, তাদের অভিভাবকেরা যেখান থেকে পারেন সেই বস্তুটিকে সন্তানদের হাতের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তারপর সেই খেলনা নিয়ে কিছুদিন খুব নাড়াচাড়া করে বাচ্চারা, যখন আর সেই খেলনাটি পছন্দ হয় না, তখন তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার নতুন কিছু জিনিসের জন্য বায়না করে। টুইটারের নতুন মালিক, এলন মাস্কের অবস্থা খানিকটা সেই শিশুদের মতো। তফাৎ একটা আছে অবশ্য, এলন মাস্কের অভিভাবক এই টুইটার তাঁকে কিনে দেননি। তাঁর নিজের টাকা দিয়েই তিনি কিনেছেন। যেহেতু তিনি বিশ্বের ধনীতম মানুষ, তাই তাঁর ইচ্ছে হয়েছে, তিনি টুইটার নামের সামাজিক মাধ্যমটি কিনবেন এবং কিনেও ফেলেছেন। এই টুইটার কিনতে তাঁর কত খরচ হয়েছে, তা ভারতীয় মুদ্রায় কত, এই সব হিসেব করতে গেলে আমাদের মতো ছাপোষা মানুষদের নাকের জলে চোখের জলে হতে হবে। তাও মূল্যটা জানা জরুরি- ৪৪ লক্ষ বিলিয়ান মার্কিন ডলার।
খেলনাটি তো কেনা হয়ে গেছে, এবার কী করবেন? প্রথমেই তিনি ঘোষণা করলেন যে, টুইটারের নীল পাখিটাকে মুক্তি দেওয়া হলো। এবার যাঁরা সাধারণ টুইটার ব্যবহারকারী, তাঁরা প্রশ্ন করা শুরু করলেন, তাহলে কি টুইটারের নীল পাখি বা আমাদের মতো সাধারণ ব্যবহারকারীরা এতদিন খাঁচায় বন্দি ছিলেন? কিন্তু কে বা কারা বন্দি করেছিলেন, না কি মুক্তি দেওয়ার কথা বলার মধ্য দিয়ে নতুন মালিক এলন মাস্ক অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন? তারপরেই, আবার তিনি নিজে টুইট করেন, এখন থেকে ঘৃণামূলক ভাষণ বা কাউকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করার বা জাত ধর্ম তুলে খারাপ কথা বললেও কোনও ব্যবহারকারীকে টুইটার আর সারাজীবনের জন্য নির্বাসিত করবে না। অনেকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, তাহলে কি এই সামাজিক মাধ্যমটি আরও বিষময় হয়ে উঠবে? ঘটনাচক্রে দেখা গেল, যতই মুখে বলা হোক না কেন টুইটার একটি সহনশীল মাধ্যম। তারপর থেকে ঘৃণা ভাষণ আবারও বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করল। এর পিছনে অবশ্য একটি প্রযুক্তিগত কারণও আছে।
আরও পড়ুন- ঘৃণা আর ভুয়ো খবরের দরজা খুলে দিলেন এলন মাস্ক? টুইটার কিনে আদতে যা চাইছেন তিনি
টুইটারের নতুন মালিক বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এই সামাজিক মাধ্যমটি কেনার পরে তাঁর মনে হলো, তাঁর নতুন সংস্থায় অনেক বেশি কর্মী আছেন। যেমন মনে হওয়া তেমন কাজ, তিনি সাত পাঁচ না ভেবে, এক ধাক্কায় পঞ্চাশ শতাংশ কর্মীকে ছাঁটাই করলেন। তার মধ্যে বেশ কিছু ভারতীয়ও আছেন। সংস্থার সবচেয়ে উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, পরাগ আগরওয়ালকে তিন মাসের মাইনে দিয়ে বরখাস্ত করা হলো। যাঁরা বরখাস্ত হলেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু প্রযুক্তিবিদ ছিলেন, যাঁদের কাজ ছিল ঘৃণা ভাষণ আছে এমন কিছু বিষয়বস্তুর দিকে নজর রাখা। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, সংস্থায় আর কেউ থাকলেন না, যিনি এই দিকে নজর রাখতে পারেন। ঘৃণা ভাষণ বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করল।
অনেকে হয়তো বলতে পারেন, একটি সামাজিক মাধ্যম যা ভারতের মাত্র ৪ কোটি মানুষ ব্যবহার করেন, তার মালিকানা বদল হওয়াতে কেন এত হইচই হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরও টুইটারের নতুন মালিক দিয়েছেন তাঁর সাম্প্রতিক একটি টুইটে। তিনি বলেছেন, এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের মানুষের যেকোনও মতামত সংগঠিত হয় মূলত টুইটার থেকে এবং সারা বিশ্বের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকরা প্রায় সকলেই এই মাধ্যম থেকেই খবর সংগ্রহ করেন এবং প্রচলিত গণমাধ্যমে যে খবর আসে তা ইদানিং টুইটার থেকেই মূলত আসে। যেহেতু এলন মাস্ক জানেন, তিনি যথেষ্ট চড়া দামে এই মাধ্যমটি কিনেছেন, তাই এই জায়গা থেকে তাঁর মুনাফা আরও বাড়াতে গেলে তাঁকে শুধু বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না, তাঁকে আরও কিছু বন্দোবস্ত করতে হবে। তাই তিনি প্রস্তাব রাখেন, সমস্ত নীল টিক চিহ্ন যুক্ত অর্থাৎ টুইটার দ্বারা ‘স্বীকৃত’ ব্যবহারকারীদের মাসে বিশ ডলার করে এই স্বীকৃতি রাখার জন্য খরচ করতে হবে। পরে অবশ্য তাঁর মনে হয়েছে, সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষের যেহেতু ক্রয় ক্ষমতা এক নয়, তাই এই খরচ কমানো প্রয়োজন এবং তা মাসিক আট ডলার ধার্য করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ‘স্বীকৃত’ ব্যবহারকারীর কাছ থেকে কেন এই টাকা এলন মাস্ক চাইছেন? তিনি জানেন, মানুষ মুখিয়ে থাকেন কখন কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা অন্যান্য নেতামন্ত্রীরা বা বিশিষ্ট সাংবাদিকরা কী টুইট করছেন- তার দিকেই। তাই এই ধরনের ব্যক্তিত্বরা তাঁর জন্য যেমন জরুরি, তেমন তাঁরাও জানেন কীভাবে টুইটার তাঁদের প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করে। গোটা বিষয়টা একে অন্যের পরিপূরক। তাই এই ধরনের ‘স্বীকৃত’ ব্যবহারকারীরাও নিশ্চয় চাইবেন যাতে তাঁদের স্বীকৃতি থাকে এবং উল্টোদিকে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁর সংস্থারও লাভ বাড়বে। এর সঙ্গে অবশ্য ভারতীয় রাজনীতির একটা যোগ আছে, সেদিকেও নজর দেওয়া জরুরি।
আরও পড়ুন- কর্মী ছাঁটাই, ছুটি বাতিল! ক্ষমতায় এসেই টুইটার নিয়ে আসলে কী করতে চাইছেন এলন মাস্ক?
নির্বাচন বন্ডের দৌলতে, এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি ধনীতম দল এবং যদি সামাজিক মাধ্যম দিয়ে মতামত সংগঠিত করার প্রশ্নটি আসে, তাহলে দেখা যাবে তাঁরাই তাঁদের প্রভাব খাটিয়ে নানান সময়ে ফেসবুক থেকে শুরু করে টুইটারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। ভুয়ো খবর থেকে শুরু করে তাঁদের সমস্ত ধরনের প্রচার তাঁরা মূলত এই সামাজিক মাধ্যম দিয়েই করে থাকেন। যদি পয়সার জোরে তাঁরা বেশ কিছু এইরকম ‘স্বীকৃত’ ব্যবহারকারীদের টুইটারে নিয়ে আসেন এবং তাঁরা যদি ঘৃণামূলক এবং বিদ্বেষপূর্ণ টুইট করেন, তাহলে কি সামাজিক মাধ্যম ছাড়িয়ে জনমানসে তা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না? এই স্বীকৃতি দিতে গিয়েও এলন মাস্ক আবারও সমস্যায় পড়লেন। অনেক সংস্থা টাকা খরচ করে নিজেদের জন্য টুইটারের ‘ভুয়ো’ স্বীকৃতি আদায় করে নিয়ে এমন এমন টুইট করল, যে তাদের প্রতিযোগী সংস্থাদের লাভ হয়ে গেল। এবার বিশ্বজুড়ে হইচই লেগে গেল, ভুয়ো অথচ স্বীকৃত টুইটার ব্যবহার করে যদি বিশ্ববাণিজ্য মহলে এমন তোলপাড় ফেলে দেওয়া যায়, তাহলে তো অনেক কিছু করা সম্ভব।
বাধ্য হয়ে এলন মাস্ক এই প্রক্রিয়াও মুলতুবি রাখলেন। জানালেন আপাতত এই প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হচ্ছে, আগামী দিনে ভাবা যাবে। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ আসার আগেই মনে হচ্ছে, টুইটারের মৃত্যু ঘোষণা হবে, অন্তত ইঙ্গিত তারই পাওয়া যাচ্ছে। যে সময়ে লকডাউন করা হয়েছিল কোভিডের কারণে, সেই সময়ে বহু মানুষের চাকরি যেতে দেখেছে বিশ্ব। সেই সময়ে অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, চাকরি যাওয়া বা কাজ যাওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য। উচ্চবিত্ত, আইটি সেক্টরে কাজ করা মানুষদের কখনও চাকরি যায় না। কিন্তু একজন পুঁজিপতির কাছে তাঁর কর্মীর চাকরির নিশ্চয়তার থেকেও বেশি জরুরি মুনাফা। সেই মুনাফার জন্য যদি তাঁর বেশিরভাগ কর্মীকে বরখাস্ত করতে হয়, তাহলেও এই সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত ভাবতে হবে না। যে কর্মীরা আজ হয়তো বেঁচে গেছেন, কতৃপক্ষের সুনজরে থাকার কারণেই হোক বা দক্ষতার কারণেই হোক, আগামী দিনে তাঁর চাকরিও যে যাবে না, তা কি জোর দিয়ে বলা যায়? সারা বিশ্বজুড়েই এখন এই ধরনের সংস্থাগুলো আরও মুনাফার জন্য এই কাজটিই করে চলেছে। যে বাইজুসকে আমরা বিকল্প শিক্ষার মাধ্যম ভাবতে বসেছিলাম, যে ফেসবুক-টুইটারকে আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম, তারাই আজ একের পর এক কর্মী সঙ্কোচনে হাত দিয়েছে।
আমরা কিন্তু এখনও ভেবেই চলেছি, পুঁজিবাদই বিকল্প, পুঁজিবাদই মানব মুক্তির পথ। কিন্তু বিষয়টা কি এতখানি সরল? আজকের টুইটারের নতুন মালিকের খামখেয়ালিপনার জন্য কত মানুষের চাকরি যাচ্ছে, তার হিসেব কি আমরা করছি? না কি, এখনও বুঁদ হয়ে আছি, সেই স্বপ্নে যেখানে আমার সন্তানকে দুধে ভাতে রাখতে পারলেই সব সমস্যা নিজেরাই সামলে নিতে পারবো আমরা! আদৌ পারব কি? এই মুহূর্তে এলন মাস্ক যে জায়গায় আছেন আরও কিছুদিন হয়তো তাঁর এই নতুন খেলনা নিয়ে খেলতে ইচ্ছে করবে। তারপরে যখন আর ইচ্ছে করবে না তখন কিন্তু সেই খেলনাকে ফেলে দিতেও তিনি দু’বার ভাববেন না। সেই দিন কিন্তু বেশি দূরে নেই।