অকাল বৈধব্য, কোলে চার মাসের ছোট্ট মেয়ে! যেভাবে একাই লড়লেন ভারতের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার
India’s 1st Female Engineer : পেশাগত কর্মজীবন ছাড়াও, তিনি অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্স এবং ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন সহ বেশ কয়েকটি মহিলা সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সমাজে নারীদের অধিকার এবং লিঙ্গ সাম্যের জন্য...
বাঁধন ছেড়ে স্বাধীন হওয়ার পথে মেয়েরা আজ স্বতন্ত্র। জীবনের প্রতিটা বাঁকেই সে স্বয়ংসম্পূর্ণা। আজকের আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে হয়তো সেকালের ছবিটা ঠিক আঁচ করা যায় না। কিন্তু সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য মেয়েদের যে লড়াই তা চিরকালই অন্তহীন। পুরুষের পরিচয়েই মেয়েদের পরিচয়, সমাজের এই কালা কানুন আজ অতীত, আর এই অতীত করার কাজটা একদিন হয়নি। একটু একটু করে নিয়ম ভাঙার কাজ চলেছে, আর সেই কাজেই বিভিন্ন সময়ে এগিয়ে এসেছেন মেয়েরা। একটা সময় আমাদের দেশেই স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় তুলে দেওয়া হতো স্ত্রীকেও। সেখান থেকে শুরু লড়াইটা।
সময়টা ১৯৩৭ সাল, অর্থাৎ পরাধীন ভারতবর্ষ। তখনও হিন্দু সমাজের মর্মে মর্মে প্রোথিত গোঁড়ামি। ঠিক তখনই মাত্র চারমাস বয়সী এক কন্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে বিধবা হন মাত্র আঠারো বছর বয়সী আয়ালসোমায়াজুলা লালিথা। ওই পরিস্থিতিতে ওইটুকু সন্তানকে নিয়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন, এটাই যেন কঠিন লড়াই হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মানুষ তিনি নিন, শক্ত হাতেই তাই হাল ধরলেন। বিচ্ছিন্নতা এবং চিরস্থায়ী দুঃখের রীতিনীতিকে অস্বীকার করে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোকেই বিকল্প হিসেবে স্বীকার করেন তিনি।
আরও পড়ুন - আইনের পথে ব্রাত্য মহিলারা! দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতি আজও আড়ালেই
১৯১৯ সালে চেন্নাইয়ের একটি মধ্যবিত্ত তেলেগু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লালিথা। মোট সাত জন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। তাঁর বাকি ভাইয়েরা সকলেই সেই সময়ে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। আর তাঁর ছোট বোন তখনও প্রাথমিক পড়াশোনা করছে। ঠিক এরকম সময়ে মাত্র পনেরো বছর বয়সে যখন তিনি দশম শ্রেণীতে পড়ছে তখন তাঁর বাবা বিয়ে দিয়ে দেয়।
জীবন মোটেই খুব একটা সহজ নিয়মে চলেনি তাঁর। বছর তিনেকের মাথাতেই চরম বিপর্যয়। স্বামীকে হারিয়ে তখন জীবনে ঘর অন্ধকার। অন্যদিকে ১৬ তম সন্তানকে হারানোর সব দায় কার্যত তাঁর ঘাড়েই চাপিয়ে দেন শাশুড়ি। কিন্তু না, নিয়তিকে মেনে নিয়ে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া রীতিনীতির কাছে নতি স্বীকার করেননি ললিতা। বরং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠিত গিয়ে চাকরি করে পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে। আর করেও ছিলেন ঠিক তাই। আজ এত বছর পরে এসে তাঁর একমাত্র কন্যা শ্যামলা চেনুলু, যিনি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন তবে স্মৃতিচারণে ফিরে ফিরে আসছে সেদিনের সেই লড়াইয়ের গল্প।
প্রথম থেকেই ডাক্তার হতে চাননি লালিথা, কারণ একজন পেশাদার চিকিৎসককে চব্বিশ ঘণ্টাই কাজের মধ্যে থাকতে হয়। তাই তিনি বেছে নেন বিকল্প রাস্তা। তাঁর বাবা পাপ্পু সুব্বা রাও এবং তার ভাইদের মতো তিনিও সিদ্ধান্ত নেন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। মেয়ের এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবের মাটিতে প্রোথিত করা প্রথম কাজটা করেন বাবা পাপ্পু রাও। কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, গিন্ডি (সিইজি), মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক, কলেজের অধ্যক্ষ কে সি চাকো এবং পাবলিক ইন্সট্রাকশন ডিরেক্টর আর এম স্ট্যাথামের সাথে কথা বলেন। উভয় কর্মকর্তাই রাজু হন একজন মহিলা শিক্ষার্থীকে জায়গা করে দিতে। প্রসঙ্গত জেনে রাখা দরকার, একজন মহিলা হিসেবে এটিই সিইজির ইতিহাসে প্রথম।
আরও পড়ুন - তিনি না থাকলে জানাই হত না সমুদ্র তলদেশকে! প্রথম মহিলা ভূতত্ত্ববিদের লড়াই আজও অন্তরালে
কলেজে তখন ছেলেদের ভিড়ে একমাত্র মেয়ে লালিথাই। অথচ কোনও দিনই তাঁকে কোনও রকম অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়নি। মেয়েকে নিজের দাদার কাছে রেখে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতে থাকেন ললিতা। প্রতি সপ্তাহে অবশ্য মেয়েকে দেখতে বাড়ি আসতেন তিনি, এমনটাই জানা মেয়ে শ্যামলা।
কিন্তু কলেজে প্রবেশের কয়েক মাস পর, লালিথা হোস্টেলে খুবই একাকী বোধ করতে শুরু করেন ললিতা এবং তার বাবাকে বিষয়টি জানান। মেয়ের কথায় টনক নড়ে, পাপ্পু রাও তখন এই কলেজের দরজা আরও মহিলাদের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ভাবেন। এভাবেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেয়েদের পড়াশুনা করার সুযোগ তৈরি হয়। কিছুদিনের মধ্যে যোগ দেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের জন্য লীলাম্মা জর্জ এবং পি কে থ্রেসিয়া।
তিনি শিমলায় সেন্ট্রাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশনের সাথে অল্প সময়ের জন্য কাজ করেছিলেন। পরবর্তীতে, তিনি চেন্নাইতে তার বাবার সাথেও কাজ করেছিলেন, তাকে জেলেট্রোমোনিয়াম, একটি বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র, একটি বৈদ্যুতিক শিখা উৎপাদনকারী এবং ধোঁয়াবিহীন চুলা উদ্ভাবনে সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু তার বাবার কর্মশালায় যোগ দেওয়ার নয় মাসের মধ্যে, লালিথা কলকাতার অ্যাসোসিয়েটেড ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজে চাকরি নেন।
লালিথা সারা জীবন তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। তাঁর টানা ২০ বছরের কর্মজীবনে, তিনি সেন্ট্রাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন, অ্যাসোসিয়েটেড ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউশন সহ বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্য কাজ করেছেন। পাশাপাশি, তিনি শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং বাংলাদেশে প্রকৌশল প্রকল্পের উপর জাতিসংঘের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন।
আরও পড়ুন - স্টেশন মাস্টার থেকে শৌচাগারের রক্ষণাবেক্ষণ, রাজ্যের প্রথম মহিলা পরিচালিত স্টেশনের খোঁজ
এখানেই শেষ নয়, পেশাগত কর্মজীবন ছাড়াও, তিনি অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্স এবং ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন সহ বেশ কয়েকটি মহিলা সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সমাজে নারীদের অধিকার এবং লিঙ্গ সাম্যের জন্য চিরকালই সোচ্চারছিলেন তিনি। লালিথা বিশ্বাস করতেন যে সমাজে নারীদেরও শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের সমান সুযোগ থাকা উচিত। এই আদর্শ প্রচারের জন্য তিনি আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। অবশেষে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নারী অধিকারের ক্ষেত্রে তাঁর এই অবদানের স্বীকৃত হয়। প্রকৌশল ক্ষেত্রে তাঁর কাজের জন্য ১৯৬৯ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাঁকে।
১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে মহিলা প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্যও তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে তিনি তিনি ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। এই অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য যেন সত্যিকারের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর জীবনের সমস্ত ওঠা পড়া এবং ঘুরে দাঁড়ানোর যে গল্প তা যেন বিশ্বের চোখে মেয়েদের লড়াইকে নতুন করে স্বীকৃতি দেয়। মেয়ে শ্যামলার কথায়, এই সম্মেলনের সময়ই বিশ্বজুড়ে মানুষের, বিশেষ করে মহিলাদের উপর তাঁর মায়ের প্রভাবের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।
মানুষের প্রতি অসম্ভব ধৈর্য্য এবং শুধু কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হওয়ার যে মন্ত্র তাও মায়ের কাছ থেকেই শিখেছিলেন শ্যামলা চেনুলু। জীবনে দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করার কথা কখনওই ভাবেননি আয়ালসোমায়াজুলা লালিথা। মেয়েকেও কোনও দিন বাবার অভাব বুঝতে দেননি। তিনি কেবল একটা কথা বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ একটি নির্দিষ্ট কারণে কারোর জীবনে আসে এবং উদ্দেশ্য শেষ হলে চলে যায়। বাকি জীবনটা একাই লড়াই করতে, জিতে নিতে হয়। আর এই বিশ্বাসে ভর করেই আজীবন বিপরীত স্রোতে সাঁতার কেটে গিয়েছেন আয়ালসোমায়াজুলা লালিথা। ভারতীয় হিসেবে তো বটেই এমনকী সারা বিশ্বের ইতিহাসে আজও তিনি সত্যিকারের একজন উদাহরণ।