পরবাসে আগমনীর জলছাপ এঁকে গেলেন বাণীকুমার

Mahishasura Mardini by Banikumar became harbinger of Puja in Barbil: সেই ঘুমভাঙা ঘোর, যখন গোটা টাউন জুড়ে সহসা বেজে উঠেছিল, 'তব অচিন্ত্য'…আমার বাবা’র মুখটা আজও প্রাণে গেঁথে আছে।

শীতের রাত, বাস চলেছে পা টিপে টিপে বা কখনও আনতাবড়ি লয়ে, যেভাবে চিরভীতু বালক দু'টো ঘরের মাঝের উদাসী হলঘর বন্ধ চোখে দৌড়ে যায় কোনও মতে, ঠিক ভূতে জামার নাগাল পেতে পেতে পেল না যেন। কিন্তু ওই যে অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ, যেখানে ভূতের ভয়, সেখানেই… অতএব, সামনে-পিছনে পুলিশের গাড়ি থাকা সত্ত্বেও, ডাকাতিয়া একটা জঙ্গুলে অংশে, বাস-কে থামতেই হল। কার্টসি, এই বান্দা। ড্রাইভারকাকুর কাছে হেল্পারদাদা যেই না সেই অলক্ষুণে বার্তা নিয়ে গেছে, যে গাড়ি থামাতেই হবে, সে হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি বলাই বাহুল্য, প্রথম বেশ কিছু ক্ষণ। আর সত্যি তো, ইয়ার্কি নাকি! যে স্ট্রেচে ডাকাত পড়ে বলে (সু)নাম আছে প্রবল, আর সে দাপট এমনই যে সামনে-পিছনে পুলিশের এসকর্ট জিপ পার করায় বৈতরণী, সেখানে নাকি বাস-কে থামতে হবে! তার চেয়ে ডাকাতদের বাড়ি থেকে বেল বাজিয়ে ডেকে আনলেই তো হয়!

কিন্তু পাপী পেট কা সওয়াল। অর্থাৎ আমার পাপী পেটের কথা হচ্ছে। ইন আ ডিফারেন্ট সেন্স যদিও! মানে সোজা বাংলায় বলতে গেলে, আমার তলপেটে সহসা শুরু হল ঘমাসান কুরুক্ষেত্র। আমার মুখ বেঁকেছে যদ্দুর মনে পড়ে ও কপাল ঘামের রাজ্য। বাবা’র এগজ্যাক্ট ইমোশন মনে নেই, শুধু মনে আছে প্রাণপণ বন্ধ জানলার বাইরে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল, সে ভ্যাবাচ্যাকা প্রহরের শেষ হওয়ার। বেচারি মায়ের কিছু করা নেই কারণ আমি গা ঘেঁষে বসা আর যাবতীয় কঁকিয়ে ওঠা, মায়ের মুখ চেয়েই। এখন বুঝি সে পৃথিবীতে বড় সহৃদয় মানুষের সমাগম ছিল, নয়তো কে-ই বা রাজি হয়, বাস থামাতে দিতে! এখান থেকে আরও একটা জানিস প্রমাণ হয় কিন্তু, যে তলপেটে বিপ্লবের চেয়ে সর্বগ্রাসী এ হোমাসেপিয়েনকূলে আর কিচ্ছুটি নেই। ফুলন দেবী, মান সিং, এমনকী রঘু-বিশে’রাও তার সম্মুখে নকুলদানা।

আরও পড়ুন: বুনো গন্ধের ঝোঁক ধরিয়েছিলেন গুহমশাই

অতএব, একটি জলের বোতল নিয়ে মা নেমে এল প্রায় বিধ্বস্ত আমায় নিয়ে, দু’পা পিছনে বাবা, নিশ্চিত গজগজ করছিল। সত্যি আই সিম্প্যাথাইজ। লাইন দিয়ে খান তিনেক বাস ও পুলিসের জিপ থ হয়ে দাঁডি়য়ে রইল, যেন বড় যত্নে রথের চাকা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আর নিয়তির মতো অপেক্ষা করে চলেছে সে সমষ্টি, অলিগলি থেকে তির উড়ে আসার। ওই কাঠ ঠান্ডায়, জঙ্গলের কিছুটা ভেতরে আমি বসে পেলাম শান্তির ছিঁটে আর বাকিরা... মাথা ঠান্ডা রাখার জন্যে ডিজার্ভ করেন শান্তির নোবেল ন্যূনতম। কিন্তু এ জীবন অতীব কণ্টকময়, কারণ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, সেই বাসের কেউই নোবেল কমিটির কাঙ্খিত ফোন পাননি। প্যাথোজ! এবং আমার নীরব প্রতিবাদও।

অবশ্য সে কালে যা দেখেছি, বড়দের থোড়াই কেয়ার ছিল, কে কী বলল, কে কী ম্যারাপ বেঁধে সম্মাননা দিল, এই সবে। বাবা, গোরাকাকুদের একটা অদৃশ্য কোড ছিল নির্ঘাৎ, যা ওরা ওদের মতো করে মেনে চলত। তাতে ওই যে বললাম কে কী বলল, কিছুই এসে যেত না। আর তাতে যুৎসই সঙ্গত করত মা, খুকুমা, গৌরি কাকিমা, মোহরের মা, আমার আর পম-এর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু তুষারের মা, কাকিমা, পলি আন্টি, মধু আন্টি- সবার। এই পুজোর কালে সত্যি কী এক হাওয়া দিত সারান্ডার আকাশজুড়ে। এক অমোঘ রোগ এসে বাগে পেত আমাদের সকলকে। মহা-আনন্দের এক প্লেগ যেন। তীব্র ছোঁয়াচ যার। বিকল, অবশ করে দিত বাকি দৈনন্দিন। বরবিলের পুজো গ্রাউন্ড তখন কাশপরিবৃত চিরাচরিত রূপকথা, বাঙালির। ক্যাপ বন্দুক, ফটফটফট… থুপ, কখন যে ফাটে, কখন মুখচোরা। মায়ের কাছে আবদার করে দশ টাকা হাতে, যেন 'আপুন হি ভগওয়ান'! দৌড়েছুটে ছোট্ট লাইনের পিছনে, রঙিন বাক্সে চোখ রেখে দেখব অন্য ভূবন, দেখতে না দেখতেই গন্নু ভাইয়ার কাছে গুপচুপ, মানে ফুচকা, মাইকে তখন জগৎ কাঁপাচ্ছে হাসান জাহাঙ্গীর, 'হাওয়া হাওয়া অ্যায় হাওয়া খুসবু লুটা দে'…বা 'আ জানা দিল হ্যায় দিওয়ানা'...

How Mahishasurmardini by Banikumar became harbinger of Puja also in barbil by Anirban Bhattacharya in chhoto town proper noun

কিছুক্ষণ পরেই তো বেরোব আমরা, ঠিক যখন সন্ধে নাইট ডিউটি দিতে আসবে। লাইন দিয়ে গাড়ি আর স্কুটারে আমাদের হি-ম্যান গোরাকাকু, পেছনে বাবা। সত্যি তখনও কি জানতাম, এক দিন প্রখর শীতের একাকী রাতে, ভয়াবহ অসুস্থ বাবাকে, প্রায় তেল না থাকা জিপে করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে সেই গোরাকাকু-ই। কী করে যে! সে অন্য কোনও দিন। আজ পুজোয় বিসর্জন না হয় না-ই বা এল।

তাই চলুক স্কুটার, চলুক গাড়ি। গাড়ির পেছন থেকে শত বকুনি অগ্রাহ্য করেও ঝুঁকে, মুখ বাড়িয়ে আমি, কেটে চলি হাওয়া, মেপেও কি চলি? কে জানে! আঁধার নেভিগেট করে আপাতত তাই যাই কলিঙ্গ, গুয়া, নোয়ামুন্ডি, বাঁশপানি… আমার, পমের বরবিলি পুজো পরিক্রমা। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারময় দ্বীপসম রাস্তা নিরেট জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে উড়ে বেড়ায়, যেন পাটপাট চুল আঁচড়ে থাকা ফার্স্ট বয়, একবারের জন্যে মা-কে স্বেচ্ছায় হারিয়েছে। আর তাতে চেপে চাঁদের ইশারা বুঝে আমরা পাড়ি দিই ক্রমে আবছা এক আলোর বিন্দুর মুখে। সেই বিন্দুর মাঝমধ্যেই যে কলিঙ্গের মেলা, রাত ঝলমল, নাগরদোলা, কাঠি আইসক্রিম, কাঠের পুতুল, জলের মধ্যে ফটফট করে চলা সলতে-জ্বলা টিনের নৌকো। তখন নির্ঘাৎ মনে হত, সে নৌকোয় চড়ে আমরা আলবাত ফিরতে পারব যখন ইচ্ছে, যার কাছে ইচ্ছে। নাকি ভুল বললাম, সে হাওয়া কখনও মিথ্যে হয়ে যাবে, অধরা হয়ে পড়বে, সে ভাবনার কি সাধ্য ছিল আদৌ সিঁধ কেটে ঢোকার সারান্ডার অরণ্যমনে?

আরও পড়ুন:কৃপাসিন্ধু মাংসঠাকুর ও গুহমশাইয়ের রাতবিরেতের ফোন

কারণ সে অরণ্যমন জেনেছিল, একটু পর, বাড়ি ফেরার পথে হয়তো বাবা দাঁড় করাবে গাড়ি। রাস্তার ধারে ইয়া বড় সাদা পর্দা টাঙিয়ে দেখানো কোনও জিতেন্দ্র-জয়াপ্রদা’র সিনেমার কাছে। বা খুকুমা আগামীকাল যে মাংস দিয়ে ঘুগনি বানাবে, তার গন্ধ আগের দিন থেকেই মৌতাত পেতে বসেছে রেললাইন পেরিয়ে। বা খবর ইতিমধ্যেই রটি গেছে, বাইরে থেকে বুলু-পাপ্পা’র অর্কেস্ট্রা আসছে ফাংশন করতে। আনন্দের ফ্যাক্টরি ছাড়া হয় নাকি এমন সব ক্রমাগত ঘনঘটা? আর এ সবের আগে, সেই ঘুমভাঙা ঘোর? যখন গোটা টাউন জুড়ে সহসা বেজে উঠেছিল, 'তব অচিন্ত্য'…আমার বাবা’র মুখটা আজও প্রাণে গেঁথে আছে। বাবা কি কস্মিনকালেও ভেবেছিল, যে বাবা’র অনুমতি নিয়ে ও কিঞ্চিৎ অভিমান সামলে চাকরি করতে এ বরবিলে এসেছিল, সেখানেই এক দিন অমন ভাবে, সেই বাবা, অর্থাৎ বাণীকুমারের রচনা ও পরিচালনা করা মহিষাসুরমর্দিনী আগমনীর জলছাপ রেখে যাবে…পরবাস এ ভাবেই নিজভূম কি হয়ে ওঠে না?

More Articles