ছিলেন কাপড় কারখানার মজুর! যেভাবে বিশ্বফুটবলের কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন গার্ড মুলার...

1974 Football World Cup: জার্মানির ফুটবলের ইতিহাসে সে-দেশের লিগে কিংবা জাতীয় দলের হয়ে মুলারের চেয়ে বেশি গোল আর কেউ করেনি।

১৯৭৪-এর বিশ্বকাপ

মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন তখন সরু দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে, হাঁটু নড়বড় করছে, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থা। তুমুল হইহল্লা করে বৃহস্পতি অভিমুখে একখানা মহাকাশযান ছোঁড়া হয়েছে। ভিয়েতনামে অন্তত একশো নিরপরাধ মানুষকে কোতল করার দায়ে অভিযুক্ত এক যুদ্ধাপরাধী লেফটেন্যান্টকে ওয়াশিংটনের আদালত বেকসুর খালাস করে দিল; করবে না-ই বা কেন, খুব বেশি তো নয়, মাত্রই শতখানেক লোক মেরেছে। তার ওপরে লোকগুলো যে নেহাতই এলেবেলে সাধারণ মানুষ, আর ভুললে চলবে কী করে ওরা ভিয়েতনামি।

দুই ঔপন্যাসিক, গুয়েতেমালার মিগেল আঙ্খেল আস্তুরিয়াস এবং সুইডেনের পার লগেরকিস্ত মারা যাচ্ছেন, একই অবস্থা মেহিকোর শিল্পী দাভিদ আলফারো সিকেইরোসের। আরহেন্তিনার ইতিহাসে দাগ কেটে যাওয়া জেনারেল পেরন ততদিনে মৃত্যুশয্যায়। জ্যাজ় সংগীতের মুকুটবিহীন সম্রাট ডিউক এলিংটনেরও একই অবস্থা। মার্কিন সংবাদব্যাবসার সবচেয়ে বড় পুঁজিপতির মেয়ে প্যাট্রিসিয়া হার্স্টকে যারা অপহরণ করেছিল, তাদেরই একজনকে প্যাট্রিসিয়া ভালোবেসে ফেলল, তারপর তাদের সঙ্গে মিলে গিয়ে শুধু ব্যাঙ্ক ডাকাতিই করল না, নিজের বাপকে বুর্জোয়া শুয়োর পর্যন্ত বলল। মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু!

গ্রিসের স্বৈরশাসনের লৌহকপাট ভাঙছিল, পর্তুগালেও অবস্থা তথৈবচ। ‘গ্র্যান্দোলা ভিলা মোরেনা’র সৌভ্রাতৃত্বের সুরে নাচতে-নাচতে পর্তুগিজ়রা সেদেশে কারনেশন ফুলের নামে রঙিন বিদ্রোহ ঘটিয়ে দিল। চিলেতে অগুস্তো পিনোশে স্বৈরশাসনের ফাঁস টান করছে, ওদিকে হিস্পানি দেশের স্বৈরাচারী শাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো নিজেরই নামাঙ্কিত ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অতিরিক্ত ক্ষমতা আর বয়সের জ্বালায় মারা যাচ্ছে।

ঐতিহাসিক গণভোটে ইতালির মানুষ বিবাহবিচ্ছেদকে আইনি স্বীকৃতি দিচ্ছে। বৈবাহিক জটিলতা কাটাতে স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা ছোরা-ছুরি আর বিষ প্রয়োগের হ্যাপা সামলানোর চাইতে বিবাহবিচ্ছেদ অনেক সভ্য রীতি বলে তারা মেনে নিল। সুইৎজ়ারল্যান্ডে আরেক ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিশ্ব ফুটবলের মাতব্বরেরা এতকালের সম্মানিত সভাপতি স্ট্যানলি রাউসকে হঠিয়ে দিয়ে জোয়াও আভেলাঞ্জিকে ফিফার সভাপতি নির্বাচন করল। ওদিকে জার্মানিতে দশম বিশ্বকাপের ঘণ্টা বাজল।

এবার এল একেবারে ধাঁ-চকচকে নতুন কাপ। আগের জুলে রিমে কাপের চাইতে দেখতে অবিশ্যি কুৎসিত। সে যাইহোক, এই কাপের লড়াইয়ে অংশ নিল ইয়োরোপের ন'টা আর আমেরিকার পাঁচটা দেশ, সঙ্গে ছিল অস্ট্রেলিয়া আর জ়াইয়ের। চিলের ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে যোগ্যতা নির্ণায়ক ম্যাচ খেলতে অস্বীকার করায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবারের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়নি। চিলের ওই স্টেডিয়াম কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল রাজনৈতিক বন্দিশিবির। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের ওখানেই ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে মারা হতো। স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ওখানে খেলতে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। চিলে কিন্তু সেই ম্যাচটা খেলতে নেমেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে অমন ভয়াবহ ম্যাচ আর কখনো হয়নি; চিলে খেলতে নামলেও তাদের প্রতিপক্ষ বলে কেউ ছিল না। তারা অনেকগুলো গোলও করে, যদিও বিপক্ষের গোল সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল। ফাঁকা গোলে বল ঢোকানোর আনন্দে স্টেডিয়ামের দর্শকের উল্লাসেও কিছু খামতি ছিল না। সেবারের বিশ্বকাপের মূল পর্বে চিলে একটা ম্যাচও জেতেনি।

এবারের বিশ্বকাপের কয়েকটা অবাক করা কাণ্ড : ডাচ ফুটবলাররা তাদের স্ত্রী কিংবা বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে জার্মানিতে খেলতে এসেছিল এবং গোটা টুর্নামেন্টটাই তারা প্রেয়সীদের সান্নিধ্যে কাটায়। এই প্রথম ফুটবলাররা এমন সুযোগ পেল। আরেকটা অত্যাশ্চর্য কাণ্ড হলো ডাচ খেলোয়াড়রা এবার যেন পায়ে ডানা বেঁধে খেলতে নেমেছিল। তারা উড়তে উড়তে সব ম্যাচে অপরাজিত থেকে ফাইনালে পৌঁছয়। এই যাত্রায় তারা চোদ্দোটা গোল করে আর মাত্রই একটা গোল খায়। ওই একখানা গোলও খেয়েছিল নেহাতই দুর্ভাগ্যবশত, কেননা ওটা ছিল সেমসাইড গোল। ’৭৪-এর বিশ্বকাপের সব আলো শুষে নিয়েছিল হল্যান্ড দলের ঘড়ির কাঁটার মতো মসৃণ কমলা রঙের ফুটবল। যে খেলাটা কোচ রিনাস মিশেলের তাড়নায় ক্রুয়েফ, নিসকেন্স, রেনসেনব্রিঙ্ক, ক্রোল এবং ডাচ ফুটবল দলের অক্লান্ত খেলোয়াড়দের নিষ্ঠায় গড়া।

ফাইনালের শুরুতে ক্রুয়েফ বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে পতাকার রং বদলাবদলি করে নিল। এরপরেই তৃতীয় আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল। ‘কাইজ়ার’ এবং তার দলের ছেলেরা উড়ন্ত ওলন্দাজদের বেলুনে ছ্যাঁদা করে দিল। মায়ার সেদিন গোলে দাঁড়িয়ে সব রুখে দিয়েছিল, মুলার যা পাচ্ছিল মনে হচ্ছিল গোলে ভরে দেবে, ব্রাইটনার সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ানদের মাথায় দু' গামলা ঠান্ডা জল ঢেলে কমলা ঝড় থামিয়ে দেয়। যাবতীয় প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে জার্মানি ২-১ গোলে জেতে। সেই ’৫৪-র সুইৎজ়ারল্যান্ড বিশ্বকাপের মতো এবারও জার্মানি সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দিল। সেবার হারিয়েছিল হাঙ্গেরিকে, এবার কুপোকাৎ হলো নেদারল্যান্ডস।

পশ্চিম জার্মানি আর হল্যান্ডের পরেই উঠে এল পোল্যান্ড। ব্রাজ়িল এবার একেবারেই নিষ্প্রভ ছিল, তারা চতুর্থ স্থান পেল। পোল্যান্ডের খেলোয়াড় লাতো সাতটা গোল করে তালিকায় সবার ওপরে ছিল, তারপরেই ছিল আরেক পোল জ়ারমাখ এবং জার্মানির নিসকেন্স, দু'জনেই পাঁচটা করে গোল করেছিল।

আরও পড়ুন- ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?

ক্রুয়েফ

সবাই সেসময়ের ওলন্দাজ ফুটবল দলের খেলা ভালোবেসে বলত, ঘড়ির কাঁটার মতো মসৃণ কমলা রঙের ফুটবল। সেই কমলা ঝড়ে যান্ত্রিকতার লেশমাত্র ছিল না। বরং ডাচ দলের খেলোয়াড়দের উচ্চাঙ্গের কল্পনাশক্তি আর ক্রমাগত খেলার চাল পালটে ফেলার ক্ষমতাই দুনিয়ার সবাইকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিয়েছিল। সেই পুরনো দিনে রিভার প্লেটের ‘মেশিন’ দলটার কথা মনে আছে তো! ওই দলটাকেও এমনই একখানা ডাকনাম দিয়ে ছোট করা হতো। ডাচদের কমলা রঙের আগুন মাঠের সামনে পেছনে মসৃণ গতিতে এগিয়ে যেত, কখনও পিছিয়ে আসত। ঠিক যেন সর্বজ্ঞ কোনও হাওয়ার ঝাপটায় তারা প্রবল গতিতে আক্রমণে যেত, আবার একই রকমভাবে নীচে নেমে এসে রক্ষণ সামলাত। দলের সবাই আক্রমণে যেত, সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ভোঁতা করত। বিপক্ষের গোলের সামনে সৈন্যসামন্ত নিয়ে আক্রমণ গড়ে তুলত এবং প্রয়োজনে পশ্চাদপসারণ করত দুরন্ত ঘূর্ণির পাকে। এমন একটা দল যার প্রতিটি খেলোয়াড়ই এগারোজনের জন্য নির্ধারিত যেকোনও জায়গায় খেলতে পারে। এই দলের সামনে পড়লে বিপক্ষের কী হাল হতো বুঝতেই পারছেন। কমলা ঝড়ের সামনে কেউ নিজের পায়ের ছন্দ খুঁজে পেত না।

এক ব্রাজ়িলীয় সাংবাদিক ডাচ দলের খেলার রহস্যভেদ করে বলেছিল গোটা ব্যাপারটাই হচ্ছে খেলায় ‘পরিকল্পিতভাবে অপরিকল্পনা’কে প্রশ্রয় দেওয়া। হল্যান্ড একটা সুরের মূর্ছনার মতো ফুটবল খেলছিল তখন, সেই সুরে হরেক লয়-তাল-ধ্বনিকে এক সুতোয় গাঁথার কাজটা করছিল জোহান ক্রুয়েফ। ক্রুয়েফ একদিকে ছিল অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টর, আবার নিজের যন্ত্র বাজাতেও তার জুড়ি ছিল না। হল্যান্ডের ওই দলে তার মতো আর কেউ খাটতে পারত না।
ছিপছিপে প্রাণচঞ্চল ক্রুয়েফ আয়াক্সের কাজে লেগে যায় নেহাতই নাদান বয়সে, তার মা তখন ক্লাবের বারে কাজ করত। বড়রা যখন অনুশীলন করত তখন ছোট্ট ক্রুয়েফ মাঠের বাইরে যাওয়া বল কুড়িয়ে আনত। খেলোয়াড়দের জুতো পালিশ করে চকচকে করত, খেলার আগে মাঠের চারকোণে পতাকা পুঁতে দিত। ক্রুয়েফ জানত তাকে কী কী করতে বলা হবে, তাই সে নিজে নিজেই সব কাজ করে রাখত, বড়দের কিছু বলার সুযোগই দিত না। সে শুধু মাঠে নেমে ফুটবল খেলতে চাইত, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে একবারেই মাঠে নামতে দিতে চাইত না। তার ইচ্ছাশক্তি জবরদস্ত হলেও চেহারা ছিল একেবারে ল্যাকপেকে সিংয়ের মতো। তবে শেষমেশ তারা বাধ্য হয়ে সেই যে একবার খেলার সুযোগ দিল, ক্রুয়েফ আর কখনও সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি। জাতীয় দলের হয়ে তার আত্মপ্রকাশের সময়েও সে একেবারে বাচ্চা ছেলে। প্রথম আবির্ভাবের দিনই ক্রুয়েফ তাক লাগিয়ে দেয়। সেদিন সে একটা গোল করে, আর রেফারির নাকে বিষাক্ত এক ঘুষি মেরে লোকটাকে মাটিতে শুইয়ে দেয়।

সেই রাত থেকেই রগচটা, পরিশ্রমী আর প্রতিভাবান বলে ফুটবল দুনিয়া চিনে নিল তাকে। দু' দশকের বেশি সময় ধরে হল্যান্ড আর হিস্পানি দেশে বাইশটা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে। সাঁইত্রিশ বছরে অবসরের দিনও ক্রুয়েফ একটা গোল করেছিল। তার ভক্তরা ফুটবলের এই অবিসংবাদিত নায়ককে কাঁধে তুলে নিয়ে স্টেডিয়াম থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।

মুলার

টিএসভি মিউনিখের কোচ তাকে বলেছিল, "ফুটবলে তোমার কিছু হবার নয়, অন্য কিছু ভাবো হে ছোকরা"।

সেসময় গার্ড মুলার একটা কাপড়ের কলে দিনে বারো ঘণ্টা মজুরের কাজ করত।

এর ঠিক এগারো বছর পরে, ১৯৭৪-এর বিশ্বকাপে, এই গাঁট্টাগোট্টা খেলোয়াড়ই দুনিয়া জয় করল। জার্মানির ফুটবলের ইতিহাসে সে-দেশের লিগে কিংবা জাতীয় দলের হয়ে তার চেয়ে বেশি গোল আর কেউ করেনি।

ফুটবল মাঠে তার মতো বুনো নেকড়েও আর কখনও দেখা যায়নি। যেন কোনও বৃদ্ধার ছদ্মবেশে, নিজের বিষদাঁত আর ধারালো নখ লুকিয়ে রেখে, সে মাঠের মধ্যে চলে-ফিরে বেড়াত। সহখেলোয়াড়দের দিকে একের পর এক অপাপবিদ্ধ সব পাস বাড়াত, মাঠের মধ্যে আরও নানারকম দাতব্য কাণ্ডকারখানা চালাত বন্ধুদের জন্য। এইসব করতে করতে কখন যেন সবার অলক্ষ্যে পিছলে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়ত। বারপোস্টে টাঙানো জালটা তার কাছে ছিল কোনও তুমুল আকর্ষণীয়ার বিয়ের সন্ধেয় পরা জরির ওড়নার মতো। ফাঁকা গোলের সামনে দাঁড়িয়ে সে ঠোঁট চাটত। কল্পনায় সে বুঝি নিজেকে উলঙ্গ ভাবত। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে গোলে বল ঢুকিয়ে দিত।

আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি

আভেলাঞ্জি

১৯৭৪-এ অনেকটা খাড়াই রাস্তা পেরিয়ে জঁ-মারি ফস্তিন দে গোদেফ্রয়িদ আভেলাঞ্জি [হ্যাভেলাঞ্জ] ফিফার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছল। ক্ষমতায় এসেই সে ঘোষণা করেছিল : "আমি একটা পণ্য বিক্রি করতে এসেছি, যার নাম ফুটবল"।

সেই থেকে বিশ্ব ফুটবলে আভেলাঞ্জির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ফুটবলের সর্বোচ্চ ক্ষমতার সিংহাসনে তার শরীর যেন আঠা দিয়ে সাঁটা, সে জ়ুরিখে নিজের প্রাসাদে পেশাদারি ফুটবলের সর্বগ্রাসী মাতব্বরদের সভার মধ্যমণি হয়ে সাম্রাজ্য চালায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের চেয়ে বেশি দেশ শাসন করে, তাকে মহামহিম পোপের থেকে বেশি সফরে বেরোতে হয়, আর যতগুলো মেডেল সে পেয়েছে তার ভগ্নাংশও কোনও বীর যোদ্ধা পায় না।

আভেলাঞ্জির জন্ম ব্রাজ়িলে, সে-দেশের সবচেয়ে বড় পরিবহন কোম্পানি কোমেত-এর মালিক সে। তার আর পাঁচটা ব্যবসার মধ্যে আছে শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলা, অস্ত্র বেচাকেনা এবং জীবন বীমা। কিন্তু তার ধ্যানধারণা ব্রাজ়িলের আম-আদমির সঙ্গে খুব একটা মেলে না। লন্ডনের দ্য টাইমসের এক সাংবাদিক একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ফুটবলের কোন দিকটা আপনাকে বেশি করে টানে? "এই খেলার মহিমা? এর সৌন্দর্য? কাব্যময়তা? না কি জয়?"

উত্তরে আভেলাঞ্জি বলেছিল, "ফুটবলের শৃঙ্খলা"।

এই সেকেলে রাজতান্ত্রিক ধারণা কিন্তু শুধু ফুটবলের ভূগোলটাই বদলে দেয়নি, খেলাটাকে বিপুল লাভজনক এক বহুজাতিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করেছে। তার শাসনকালের মেয়াদে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে : ১৯৭৪-এ খেলেছিল ষোলোটা দেশ, ১৯৯৮-এ সেটা হবে বত্রিশ। ফিফার আয়ব্যয়ের হিসেবের ধোঁয়াশা কাটিয়ে আমরা এইসব টুর্নামেন্ট থেকে এমন বিপুল লাভের অঙ্ক পাঠোদ্ধার করতে পারি যে বাইবেলে বর্ণিত পাঁচ টুকরো পাঁউরুটি আর দু'টি মাছ দিয়ে যিশুর পাঁচ হাজার মানুষের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জাদুকেও প্রগাঢ় ঠাট্টা বলে মনে হয়।

বিশ্ব ফুটবলের নতুন নায়কেরা, আফ্রিকার নানান দেশ, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার দেশগুলো আভেলাঞ্জিকে অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়ে চলে। সর্বোপরি তার ক্ষমতাকে পরিপুষ্ট করে দুনিয়ার অতিকায় বাণিজ্য সংস্থাগুলো। কোকা-কোলা আর অ্যাডিডাস যেমন। অ্যাডিডাস ১৯৮০ সালে আভেলাঞ্জির পরামর্শেই তার বন্ধু হুয়ান আন্তনিয়ো সামারাঞ্চকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পদে বসাতে দেদার খরচ করে। সামারাঞ্চ চালু জিনিস, স্বৈরাচারী ফ্রাঙ্কোর আমলে সে নীল শার্ট পরে হাতের তালু বাড়িয়ে ফ্রাঙ্কোকে দিব্যি স্যালুট করে গেছে। আজ সে খেলার দুনিয়ার আরেকজন রাজা। দুই বন্ধু মিলে অকল্পনীয় রকমের টাকা সামলায়। ঠিক কত টাকা, তা কিন্তু কেউ জানে না। তারা লাজুক মুখে এসব কথা এড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন- পোলিওতে কাবু, দুই পা অসমান, বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়েই ফুটবলের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা

বলের মালিক

ফিফার রাজসভা জ়ুরিখে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি রাজপাট চালায় লোজ়ান থেকে। আইএসএল [ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস অ্যান্ড লেজ়ার] তার ক্রীড়া বিপণনের ব্যাবসা চালায় লুসান থেকে, এরাই ফুটবল বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিকের হাতি থেকে আলপিন সবটা সামলায়। এই তিনটে মহাক্ষমতাধর সংস্থা নিজেদের সদর দপ্তর খুলেছে সুইৎজ়ারল্যান্ডে। সেই সুইৎজ়ারল্যান্ড, যার নাম শুনলেই আপনার মনে পড়ে যাবে আসামান্য ধনুর্ধর উইলিয়ম টেলের কিংবদন্তি, বিশ্বের সেরা ঘড়ি আর তথ্য গোপন রাখার ধর্মে নিষ্ঠাবান ব্যাঙ্কের কথা। আরও আশ্চর্য সমাপতন হলো ফিফা, অলিম্পিক কমিটি এবং আইএসএল- তিনটি সংস্থাই টাকাপয়সার কথা উঠলে চরম লাজুক হয়ে পড়ে। তাদের হাত দিয়ে কত টাকার লেনদেন হলো, হাতেই-বা রইল কত, এ ধরনের প্রশ্নে তাদের বিনয়ের অবতার মনে হয়।

আইএসএল কোম্পানি গত শতকের শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোয় স্টেডিয়ামের বিজ্ঞাপন, সিনেমা-ভিডিও, লোগো, ব্যানার, ম্যাসকট ইত্যাদির যাবতীয় স্বত্ব ভোগ করত। এই ব্যাবসাটা আসলে ছিল অ্যাডলফ ডাসলারের বংশধরদের। সেই অ্যাডলফ ডাসলার, যে অ্যাডিডাসের প্রতিষ্ঠাতা এবং পুমা কোম্পানির মালিক রুডলফ ডাসলারের সহোদর ভাই আর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। দুই দোস্ত, আভেলাঞ্জি আর সামারাঞ্চ, বিশেষ কৃতজ্ঞতাবশত নেহাতই মহৎ আবেগে ডাসলার পরিবারকে ক্রীড়া বিপণনের জগতে একচেটিয়া ব্যাবসার সুযোগ করে দিয়েছিল। হবে না, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ক্রীড়া-পোশাক নির্মাতা অ্যাডিডাসও যখনই প্রয়োজন হয়েছে আভেলাঞ্জি-সামারাঞ্চের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য অকাতরে ব্যয় করেছে। ১৯৯০ সালে ডাসলাররা অ্যাডিডাস বেচে দেয় ফরাসি ব্যবসায়ী বেরনার তাপিকে, কিন্তু ডাসলার পরিবার এখনও আইএসএল আঁকড়ে পড়ে আছে। তারা ওই কোম্পানিটা ইদানীং জাপানি বিজ্ঞাপন সংস্থা দেনৎসুর সঙ্গে যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

বিশ্বমানের কোনও খেলাকে নিয়ন্ত্রণ করা তো আর পাড়ার বাজারে আলু বেচা নয়। ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে নিউ ইয়র্কে একদল শিল্পপতির সঙ্গে বৈঠকে আভেলাঞ্জি স্বভাববিরুদ্ধভাবেই কয়েকটা কথা বলে ফেলেছিল, "গোটা বিশ্বে ফুটবল এখন বছরে ২২৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের ব্যাবসা করে"। সে রীতিমতো জাঁক দেখিয়ে বলে ফুটবলের ব্যবসার সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় জেনারেল মোটরসের ব্যবসা, যারা বার্ষিক ১৩৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের ব্যবসা করে এবং ১৯৯৩ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বহুজাতিক সংস্থার শিরোপা পেয়েছে।

সেদিনের কথোপকথনে আভেলাঞ্জি প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে বলে, "ফুটবল একটা বাণিজ্যিক পণ্য, তাকে যথাযথভাবে বিপণন করাটাই আসল ব্যাপার" এবং এরপরই সে আজকের পণ্যায়িত দুনিয়ায় প্রজ্ঞার প্রথম পাঠটি স্মরণ করিয়ে দেয়, "কোনও জিনিস বেচতে হলে সব থেকে বেশি মনোযোগ দিতে হয় তার মোড়কে"।

আন্তর্জাতিক খেলার আসরে অতুলনীয় সম্পদের খনি হলো টেলিভিশনে সম্প্রচারের স্বত্ব পাওয়া। ফিফা এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি সেখান থেকেই লভ্যাংশের সিংহভাগ পায়। এই টাকাটা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে দুনিয়া জুড়ে টেলিভিশনে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলো সরাসরি সম্প্রচার শুরু হবার পর থেকে। ১৯৯৩-এর বার্সেলোনা অলিম্পিকে টেলি-স্বত্ব থেকে ১৯৬০-এর রোম অলিম্পিকের তুলনায় ছ'শো তিরিশ গুণ বাড়তি আয় হয়েছে। ১৯৬০-এ অবিশ্যি সম্প্রচার কেবল সে-দেশের জাতীয় স্তরের বাজারেই সীমাবদ্ধ ছিল।

যখন সিদ্ধান্ত নেবার সময় আসে কোনও টুর্নামেন্টে কোন কোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন ব্যবহার করা হবে, আভেলাঞ্জি, সামারাঞ্চ এবং ডাসলার পরিবার কিন্তু এ নিয়ে আদৌ কোনও ঝগড়াঝাঁটি করে না। যাদের সমস্ত আবেগ পয়সা লোটার পবিত্র চিন্তায় নিয়োজিত, তাদের ভাবার সময় নেই সমর্থকদের পক্ষে ক্ষতিকর বিজ্ঞাপন কোনগুলি আর প্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপনই বা কোনগুলি। এমন চিন্তা করাকে বিলাসিতা মনে করে প্রথম থেকেই পরিত্যাগ করা হয়েছে। তারা চোখ বুজে নিলামে যে সর্বোচ্চ দর হাঁকে তার হাতে স্বত্ব তুলে দেয়। তারা শুধু জানতে চায় মাস্টারকার্ড ভিসার চাইতে বেশি পয়সা দেবে কিনা, কিংবা ফুজিফিল্ম কোডাকের চেয়ে বেশি নোটের বান্ডিল টেবিলে রাখবে কিনা। আর কোকা-কোলার রসায়ন ছাড়া তো কোনও অ্যাথলিটের শরীরের পুষ্টি সম্পূর্ণ হয় না! এই পানীয়ের গুণাবলি প্রশ্নাতীত।

গত শতাব্দীর শেষে ফুটবলকে বিপণন আর বিজ্ঞাপনে এমনভাবে মুড়ে ফেলা হলো যে, ইওরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো কার্যত কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়েছে, সে কোম্পানি আবার আরও বড় কোনও কোম্পানির অংশ। তুরিনের জুভেন্টাস ফিয়াট কোম্পানির মতোই অ্যাগনেলি গ্রুপের ক্লাব। মিলান বার্লুসকোনি গ্রুপের তিনশো কোম্পানির নক্ষত্রপুঞ্জের একটি। পারমার মালিক পারমালেত কোম্পানি। সাম্পদোরিয়া মান্তোভানি তেল কোম্পানির হাজারও ব্যবসার একটি। ফিয়োরেন্তিনা চিকি গোরি ফিল্ম প্রযোজনা সংস্থার অংশ। মার্সেইয়ের অলিম্পিক বেরনার তাপির কোম্পানির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার পর ইওরোপের প্রথম সারিতে উঠে এসেছিল। তাপির বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ্যে আসার পর অবিশ্যি ক্লাবটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। পারির সাঁ-জ়ারমাঁ কানাল প্লাস টিভি কোম্পানির তাঁবে আছে। পোজো অটোমোবাইল কোম্পানি সোশো ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক হয়ে তাদের স্টেডিয়ামটারও মালিক হয়ে বসেছে। হল্যান্ডের আইন্দহোভেনের পিএসভি ক্লাবের মালিকানা ফিলিপসের হাতে। বায়ার জার্মানির দুটো প্রথম বিভাগের ক্লাবের নামের সঙ্গে জুড়ে আছে যাদের তারা টাকা দেয় : বায়ার লেভারকুশেন আর বায়ার উরদিঙ্গেন। আমস্ত্রাদ কম্পিউটারসের আবিষ্কর্তা এবং মালিকরা বিলেতের টটেনহ্যাম হটস্পার ক্লাবেরও মালিক। এই ক্লাবের শেয়ার আবার বাজারে নথিভুক্ত। ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের মালিক ওয়াকারস্টিলের সর্বেসর্বা জ্যাক ওয়াকার।

জাপানের মতো দেশে, যেখানে পেশাদার ফুটবলের এখনও হাঁটি-হাঁটি পা-পা অবস্থা, সেখানেও বড় বড় কোম্পানিগুলো নিজেদের ক্লাব গড়ছে এবং বিদেশ থেকে তারকা ফুটবলার আমদানি করছে। তারা কেন করছে একটু ভেবে দেখুন, ফুটবলে বাজি ধরার মধ্যে ঝুঁকি সবচাইতে কম যে! ফুটবল নিজেই একটা বিশ্বজনীন ভাষা, ফলে তাদের ব্যবসার বিজ্ঞাপন কতদূর ছড়াবে বুঝতেই পারছেন। ফুরুকাওয়া ইলেকট্রিক কোম্পানি জেফ ইউনাইটেড নামে একটা ক্লাব তৈরি করে জার্মান মহাতারকা পিয়ের লিটবারস্কি এবং দুই চেক খেলোয়াড় ফ্রন্তিশেক আর পাভেলকে নিয়ে যায়। টয়োটা গোরাম্পস ক্লাব তৈরি করে ইংল্যান্ডের স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকারকে সই করায়। তুলনায় বয়স্ক কিন্তু চির-প্রতিভাবান জ়িকো কাশিমা-র হয়ে খেলে, যে-ক্লাব আবার সুমিতোমো কোম্পানির হরেক শিল্প ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ব্যাবসার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। মাজ়দা, মিৎসুবিশি, নিসান, প্যানাসোনিক, জাপান এয়ারলাইন্স- সবার নিজস্ব ফুটবল দল আছে।

এইসব ফুটবল দল যতক্ষণ কর্পোরেট মালিকের উজ্জ্বল ছবি পেশ করবে, ততক্ষণ মাঠে নেমে হারলেও খুব বেশি ক্ষতি নেই। সেজন্যই দলগুলোর আসল মালিক কে তা নিয়ে কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই; ফুটবল ওইসব কোম্পানির জবরদস্ত বিজ্ঞাপন চালায়। সত্যি বলতে কী, দুনিয়ায় ফুটবলের চেয়ে বেশি জনসংযোগের উপায় আজ পর্যন্ত আবিষ্কারও হয়নি। সিলভিয়ো বার্লুসকোনি যখন দেউলিয়া হয়ে যাওয়া মিলান ক্লাবটা কিনে নিয়ে ক্লাবের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল সেরেফ বর্ণময় বিজ্ঞাপনের ছন্দে ছন্দে। ১৯৮৭-র সেই বিকেলটা মনে আছে তো! মাঠের ঠিক মধ্যিখানে একটা হেলিকপ্টার ধুলো উড়িয়ে এসে দাঁড়াল, আর তার পেটের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল মিলানের এগারোজন খেলোয়াড়, লাউডস্পিকারে তখন রণতুর্যের বদলে বাজছে ভাগনারের ‘ভালকিরি’। বেরনার তাপি, ফুটবলের আরেক বর্ণময় চরিত্র মার্সেইয়ের অলিম্পিক ক্লাব জিতলে বিরাট পার্টি দিত। আর সেসব পার্টির জেল্লাই আলাদা ছিল, আতশবাজির রোশনাই এবং লেজ়ারের খেলায় চোখ ধাঁধিয়ে যেত, সেরা রক ব্যান্ডগুলো এসে গানবাজনা করত।

এত প্রবল আবেগ উৎসারিত হয় যে ফুটবল থেকে, তা যে খ্যাতি আর ক্ষমতার উৎস হবে সেটা আলাদা করে বলার কিছু নেই। যদিও কিছু ফুটবল দল কিন্তু খানিকটা স্বায়ত্বশাসন ভোগ করে। ব্যাপারটা আর কিছুই না, ওই দলগুলো চালায় হয় কোনও কুখ্যাত ব্যবসাদার, নইলে কোনও দ্বিতীয় শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা। তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে, ফুটবলের মতো অভিজাত একটা খেলার সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে নিয়ে জনমানসে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। ফুটবল তাদের কাছে সেরেফ গুলতির মতো, যা মালিকের উজ্জ্বল ছবি জনতার চোখে ছুড়ে দেবে। অবিশ্যি সামান্য হলেও এর ব্যতিক্রমও আছে; অনেক সম্মাননীয় মানুষ সারাজীবনের অর্জিত খ্যাতি ফুটবলের সেবায় নিয়োজিত করেন। যেমন ইংরেজ গায়ক এলটন জন করেছিলেন নিজের ভালোবাসার ক্লাব ওয়াটফোর্ড কিনে নিয়ে, কিংবা বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ফ্রান্সিসকো লোম্বার্দির কথা ভাবুন, পেরুর স্পোর্টিং ক্রিস্তাল দলটা সেই চালায়।

[পেশাদারি খেলার গলাকাটা ব্যাবসায় যেমনটা দস্তুর, এই বই ১৯৯৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হবার পরে, অনেকগুলো ক্লাবের মালিকানা হস্তান্তরিত হয়েছে। কিছু কোম্পানি চিৎপটাং হয়ে লালবাতি জ্বেলেছে। পারমা, সাম্পদোরিয়া, ফিয়োরেন্তিনা, পারি সাঁ-জ়ারমাঁ, উরদিঙ্গেন, টটেনহ্যাম- সব দলই এখন বাইবেল-বর্ণিত বেহিমথ জলহস্তির মতো সব কর্পোরেটের দখলে। আইএসএল মার্কেটিং কোনো সতর্কীকরণ ছাড়াই ২০০১-এ লালবাতি জ্বেলেছে। আইএসএল উঠে যাওয়ার পরেই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বুঝতে পারল যে তারা নিজেরাই টিভি স্বত্ব বেচতে পারে, এর জন্য কোনো মধ্যস্বত্বভোগী লাগে না। ওদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যাইহোক, গল্পটা কিন্তু এখনও অপরিবর্তিতই থেকে গেছে, যে ফুটবল দুনিয়ার কোটি মানুষকে বশ করে রাখে, সেই ফুটবল কার্যত কিছু বড়লোকের বশ।]

আরও পড়ুন- মহিলাদের যাতে অসম্মান না হয়, তাই সর্বাঙ্গ ঢাকা জামা পরে মাঠে নামতেন ফুটবলাররা!

হা ঈশ্বর!

১৯৬৯-এর মাঝামাঝি হিস্পানি দেশের হুয়াদাররামা পাহাড়ে একখানা বিশাল প্রাসাদ তৈরি হয়েছিল বিয়ে, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদান কিংবা বড়সড় কোনও সম্মেলনের জন্য। ওই ব্যাঙ্কোয়েট হলের রাজকীয় উদ্বোধন যখন পুরোদমে চলছে, তখনই সেই অট্টালিকার মেঝে ধসে গেল, হুড়মুড়িয়ে ছাদ ভেঙে পড়ল। ধংসস্তূপে চাপা পড়ল সেদিনের অতিথিরা। মোট বাহান্ন জন মানুষ মারা গেল। প্রাসাদটা বানানো হয়েছিল সাধারণ মানুষের করের টাকায়। কিন্তু কোনও পারমিট-লাইসেন্সের তোয়াক্কা করা হয়নি, এমনকী গোটা কাজের দায়িত্বে কোনও স্থপতিকেও নিয়োগ করা হয়নি।

ক্ষণস্থায়ী ওই হর্ম্যের মালিক এবং নির্মাতা হিসুস খিল ই খিল অবিলম্বে জেলে গেল। দু'বছর তিনমাস তাকে কারান্তরালে কাটাতে হলো। প্রতিটি মৃত্যুর জন্য দু'হপ্তা করে, যতক্ষণ না হেনেরালিসিমো ফ্রাঙ্কো তার শাস্তি মকুব করে। জেলের বাইরে পা রেখেই হিসুস পিতৃভূমির উন্নয়নের দায়বদ্ধতা থেকে ফের নির্মাণ ব্যবসায় লেগে পড়ল।

কিছুদিন পরে সে মাদ্রিদের আতলেতিকো ফুটবল ক্লাবের মালিক হয়ে বসল। ফুটবলের দৌলতেই অল্প সময়ের মধ্যে টেলিতারকার পরিচিতিও পেয়ে গেল। এইভাবেই তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও শুরু হয়ে গেল। ১৯৯১ সালে হিসুস মারবেয়া পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হল। তার ভোটে জেতা কিন্তু যেমন তেমন ব্যাপার নয়, গোটা দেশে তার মতো এত বেশি ভোট আর কোনও পৌরসভার প্রার্থী পায়নি। নির্বাচনী জনসভাগুলোতে সে আরব শেখ আর বিদেশি মাফিয়াদের আমোদ করার জায়গাগুলোতে রাস্তায় যাতে কোনও চোর, মাতাল, পাতাখোর না থাকে সেই ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও ওইসব আরব শেখ আর বিদেশি মাফিয়ারা বন্দুক চালানো এবং ড্রাগের ব্যাবসার একেকজন খলিফা ছিল।

আতলেতিকো মাদ্রিদই ছিল তার যাবতীয় ক্ষমতা আর সম্মানের উৎস। যদিও তার দল হরদম হারত। কোনও কোচেরই দু'এক সপ্তাহের বেশি চাকরি থাকত না। হিসুস খিল ই খিল তখন পরামর্শ করত তার তুষারশুভ্র আবেগপ্রবণ ঘোড়া ইম্পেরিয়োসোর সঙ্গে।

"ওহে ইম্পেরিয়োসো আমরা তো ফের হারলাম।"

"জানি, খিল"।

"কার দোষ বলো তো?"

"তা বলতে পারব না বাপু।"

"কেন পারবে না, ভালো করে ভাবো। আমার মনে হয় কোচ ব্যাটাই যত নষ্টের গোড়া।"

"তাহলে হাটাও মালটাকে।"

More Articles