নবারুণ-লুব্ধক-ফ্যাতাড়ু: বন্ধুত্বের ঝিনচ্যাক কার্নিভাল
Nabarun Bhattacharya and Lubdhak: অধিকাংশ বামমনস্ক সাহিত্যিকই প্রান্তবাসীদের দেখেছেন এক রঙিন চশমার মধ্যে দিয়ে।
"অসভ্য ডোগোনদের সঙ্গে সভ্য কলকাতার কোনো যোগাযোগ নেই।" তাই তারা দলবেঁধে চলে যাচ্ছে, এ শহর ছেড়ে, চিরকালের মতো। কলকাতা শহর আজ কুকুরদের দখলে। গুটিকয় বিড়ালও এসে পা মিলিয়েছে তাদের মিছিলে। সুদীর্ঘ পথ পড়ে আছে সামনে। তাদের খিদে, তেষ্টা, রাস্তার শক্ত পিচে ঘষা খেয়ে নরম থাবার যন্ত্রণা, সমস্ত বোধ যেন উবে গেছে। হাজার হাজার ট্র্যাফিক স্তম্ভ, পুলিশ সার্জেন্ট, টিভি টাওয়ার, কসাইখানাকে ছেড়ে তারা এগিয়ে চলেছে। সঙ্গে আছে হুঁশিয়ারি,
"পা ফাঁকা করে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সার্জেন্ট, তুমি খিলান বা দরজার মতোই দাঁড়িয়ে থাকো। নড়লেই আমাদের গায়ে পা লাগবে। এবং ঘটনাটা যদি একবার ঘটে তাহলে আজ কেন, আর তোমার কখনই বাড়ি ফেরা হবে না।"
২০০০ সালে 'দিশা সাহিত্য' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় 'লুব্ধক' উপন্যাস। তার ছ' বছর পর উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সে গ্রন্থের মুখবন্ধে নবারুণ লিখছেন,
"কুকুর, বেড়াল, পাখি, মাছ - এদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছোটবেলা থেকেই। তারা যেমন আনন্দ দিয়েছে আমাকে, তেমনই দুঃখ দিয়েছে চলে গিয়ে। শিখিয়েছে অনেক কিছুই যা ঠিক বই পড়ে জানা যায় না।"
আরও পড়ুন- অ্যালকোহল, জ্যোতিষ, তন্ত্র: মার্কসবাদী নবারুণ ঘুরেছেন নানা মার্গে
নবারুণের বক্তব্যকে খানিক মনযোগ দিয়ে দেখা প্রয়োজন। লুব্ধক নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা কম হয়নি। হওয়াটাই স্বাভাবিক। একদল পোস্ট হিউম্যানিজম বা উত্তর মানবতাবাদের তত্ত্বের নিরিখে তাকে দেখতে চেয়েছেন। একদল তাতে সন্ধান পেয়েছেন প্রান্তবাসীদের বিদ্রোহের বীজের। কিন্তু সবার আগে, 'লুব্ধক' বন্ধুত্বের গল্প। এমন বন্ধুত্ব যা সামাজিক ছকের খানিক বাইরে। যা কিছু প্রচলিত, তার বিধিবদ্ধ নিয়মে তাকে ধরা যায় না। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। এ পৃথিবী পাখিদের, গাছেদের, মানুষের আর কোটি কোটি কীট পতঙ্গের। ভূমণ্ডলের সমস্ত কিছু নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা। অথচ তারাই মানবসভ্যতার অপরজন।
এ জগৎ সংলাপময়। Dialogue শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ dialogos থেকে। Dialogos অর্থাৎ কথপোকথন। এ কথপোকথনে শব্দের লেনদেন নেই। আছে শুধু বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নীরব সহাবস্থান। অথচ তাকে কোনওদিন বন্ধুত্ব হিসেবে চিহ্নিত করিনি আমরা। বন্ধুত্বের হাজারও রকমফেরের খবর আর ক'জন রাখে?
উত্তাল চল্লিশ ছিল ভারতের রাজনৈতিক রদবদলের দশক। কালের নিয়মেই একদল শিল্পী-সাহিত্যিকের মনে মার্ক্সবাদী তত্ত্ব জায়গা করে নিয়েছিল। মূলধারার বামপন্থী সাহিত্যিকরা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার প্রচলিত অঙ্কে সাহিত্য রচনা আরম্ভ করলেন। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার কিছু যান্ত্রিক দিক রয়েছে। তার ফলে, অধিকাংশ বামমনস্ক সাহিত্যিকই প্রান্তবাসীদের দেখেছেন এক রঙিন চশমার মধ্যে দিয়ে। তাঁদের লেখাপত্রের মধ্যে শুধু শ্রমিক শ্রেণির মুষ্টিবদ্ধ হাতের প্রসঙ্গই উঠে এসেছে। যেন খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, লাল পতাকার জয়গান গাওয়া।
ফ্রানৎস ফানো তাঁর Black Skin White Masks গ্রন্থে দেখাচ্ছেন, কীভাবে কালো মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রণ করে সাদা চামড়ার মানুষেরা। তিনি লিখছেন,
"...not only must the black man be black; he must be black in relation to the white man."
বাংলা সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ক্ষেত্রেও যেন কতকটা তেমনই ঘটল। প্রান্তিকের অস্তিত্ব বাঁধা পড়ল মধ্যবিত্তের চেতনার গতে।
তবে এই গতের বাইরের বিশ্বকে তুলে ধরেছিলেন নবারুণ, তাঁর ফ্যাতাড়ু সিরিজের গল্প, উপন্যাসে। প্রান্তবাসীরা সেখানে কোনও রঙিন চশমার অধীনস্থ নয়। তাঁদের জীবনের যাবতীয় ক্যাওড়ামো থেকে আরম্ভ করে খিল্লিযাপনের চিত্র এঁকেছিলেন নবারুণ। একদিকে ডিএস, পুরন্দর আর মদনের ঘুঘুচক্কর। অন্যদিকে চোক্তার আর চাকতির খেল। যেন বন্ধুত্বের ঝিনচ্যাক কার্নিভাল।
বাংলার পুরনো মার্ক্সীয় দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটলে দেখা মিলবে আরেক বিরল বন্ধুত্বের। সে বন্ধুত্বে ছিল মতাদর্শের কলমখোঁচা, বাদি-বিবাদির তুমুল লড়াই। কিন্তু সবশেষে সবশেষে ছিল রাজনৈতিক সৌজন্য এবং নিকটজনকে হারানোর দীর্ঘশ্বাস।
আরও পড়ুন- কলকাতার রাস্তার মতো পানশালা আর কোথাও নেই…
১৯৩৮ সালে 'In Defense of the Decadents' নামে সমর সেন একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি যান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, যে শ্রেণিকে চেনো, যাকে ভালভাবে বুঝেছ, তাকে নিয়েই লেখ। তিনি লিখেছিলেন,
"It is best to...write about the class you know well than to exult in the future glories of a classless society."
সরোজ দত্ত অচিরেই সে প্রবন্ধকে এক হাত নিয়েছিলেন। সমর সেনের কথায়, "শূন্যে ছোবল" চালিয়েছিলেন। প্রায় চার যুগ ধরে চলে তর্ক-বিতর্ক। অবশেষে সমরবাবুই 'উড়ো খই' নামে এক জবানবন্দির মধ্যে দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটান, সাতের দশকের শেষে। ততদিনে সরোজ দত্ত খুন হয়েছেন রাষ্ট্রীয় গুন্ডাদের হাতে। সমরবাবু সে লেখায় সরোজ দত্তকে নিয়ে খানিক স্মৃতিরোমন্থন করেন। ত্রিশের দশকের শেষে একটি বৌভাতের নিমন্ত্রণে তাঁর সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়ার কথা বলেন। তারপর খানিক দ্বিধান্বিত হয়েই সরোজ দত্তর পাল্টা প্রবন্ধকে স্বীকৃতি দিয়ে লেখেন,
"বহুদিন পরে লেখাটি পড়ে মনে হলো, সরোজ দত্ত ঠিক লিখেছিলেন। তিরিশের দশকে অনেক লেখক বোধহয় বিপ্লবীর অভিনয় করে বাহবার চেষ্টায় থাকতেন, তাঁদের আসল চেহারা সরোজ দত্ত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।"
তবে মাথায় রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রেও সমরবাবু সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিলেন। বন্ধুত্বের সৌজন্য দেখাতে গিয়ে নিজের মতপ্রকাশে পিছপা হননি।
লেখক সত্ত্বা বিবর্তনশীল। কিরানা ঘরানার বিস্তারের রাস্তা যেমন স্থির, অথচ নদীর মতো এঁকেবেঁকে চলে, তেমনই কলম ব্যাপারীদের অনুভূতিও বাঁক বদল করে। চল্লিশের দশকের অরুণ মিত্র বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁদের নব্বইয়ের দশকের কবিসত্ত্বার ফারাক বিস্তার। কিন্তু এ সমস্ত কেতাবি আলোচনার কোনও মানে এখানে সত্যিই দাঁড়ায় না। সমর-সরোজ বিতর্কের সমাপ্তি প্রবন্ধটি পড়ার পর বাকি থাকে শুধুই নীরবতা। বন্ধুত্বের এই শেষ চিঠি ছিল "থাকার জগৎ থেকে না থাকার প্রতি"। আমরা অস্তিত্বের বন্ধুত্ব দেখে এসেছি। কিন্তু অনস্তিত্বেরও বন্ধুত্ব হয়। তাকে আমরা বুঝতে পারিনি।