ঋতুপর্ণর ছবি মেয়েরাই বেশি দেখে, এই ভাবনার আড়ালে লুকিয়ে যে সত্যি
'অসুখ'-ই সম্ভবত প্রথম ছবি, যেখানে রবীন্দ্র-আঙ্গিককে আধুনিক ছবির ভাবনায় কাজে লাগানো হয়েছিল মৌলিক গল্পের মোড়ক দিয়ে।
আজ ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্মদিন। বাঙালি মনন এখনও যাঁদের নিয়ে নিত্যযাপন করে, তার গেরস্থালির আনাচ-কানাচে, তাঁদের মধ্যে ঋতুপর্ণও একজন! এই মন্তব্যর মধ্যে হয়তো কিঞ্চিৎ মেয়েলিপনা আছে। ঋতুপর্ণ তো মেয়েদের বুঝতেন, তাই ওঁর ছবি বেশি মেয়েরাই দেখেন- এহেন স্টিরিওটাইপকে সরাসরি অস্বীকার না করে বরং এই প্রশ্ন রাখা যায়, মেয়েদের দেখার কথাও তো কেউ ভেবেছেন! অনেকে তো তেমনটাও ভাবেননি। তেমন যদি হয় তো, মেয়েরাই না হয় দেখল, তাঁদেরই বা সংখ্যাটা কম কোথায়?
যারা নয়ের দশকের গোড়ার দিকের ছেলেমেয়ে, তারা সরাসরি যত না রবীন্দ্র রচনা পড়েছে, তার চেয়ে বেশি অন্যের লেখায়, বলায় তাঁকে জেনেছে আরও। জানতে জানতে যে জায়গাটায় বড্ড পাঠ্যবইয়ের মতো ঠেকেছে, সেই জায়গাটায় থমকে দিয়েছেন ঋতুপর্ণ। তাঁর আপন মনের মাধুরী মিশায়ে রবি ঠাকুরকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখিয়েছেন নানাভাবে। ঋতুপর্ণর হাত ধরেই আমার মতো অনেকের রবি ঠাকুর পড়া শুরু।
ঋতুর লেখা 'ফার্স্ট পার্সন'-এর বহু অংশে তাঁর রবীন্দ্র-ভক্তি ও রবীন্দ্র-প্রেমের কথা লেখা আছে। এ যেন পূজা পর্যায়ের গানের মতো! প্রেম না পুজো বুঝতে বুঝতেই আজীবন কেটে যায় প্রতি প্রজন্মের একবার করে! তেমনই এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঋতুপর্ণর। এই প্রসঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি ছবি নিয়ে কথা বলা যাক, 'অসুখ', একটি আদ্যোপান্ত অচর্চিত ছবি! অথচ কী নিদারুণ সূক্ষ্ম, সহজ ভালবাসার মায়াজাল বোনা সমস্ত ছবিজুড়ে!
আরও পড়ুন: সমপ্রেমের আলোয় রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’-কে নতুন করে দেখেছিলেন ঋতুপর্ণ
'অসুখ'-ই সম্ভবত প্রথম ছবি, যেখানে রবীন্দ্র-আঙ্গিককে আধুনিক ছবির ভাবনায় কাজে লাগানো হয়েছিল মৌলিক গল্পের মোড়ক দিয়ে। একটা পারিবারিক গল্প, নিতান্তই বাবা-মা এবং সন্তানের মনস্তত্ত্ব দিয়ে গড়া, তারই ছোট ছোট মুহূর্ত ঋতু আপন রঙে সাজিয়েছিলেন রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে সঙ্গে। আমরা জানি, ঋতুর ছবির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ছবির সংলাপ এবং এই সংলাপের ছন্দ, তাল, সুর, নৈঃশব্দের ওপর নির্ভর করে একটা ছবির ভারসাম্য, সিনেম্যাটিক টাইমিং। 'অসুখ' ছবিটা এই দিক থেকে ভীষণভাবে ম্যাজিকাল! ছবির যে যে জায়গায় আমরা গান দেখে অভ্যস্ত, সেই সেই জায়গায় রবীন্দ্র-কবিতার ব্যবহার ছবিটিকে কেবল ভিন্ন নান্দনিক মাত্রা দেয়নি, এর সঙ্গে সমগ্র ছবিটির ছন্দগত ভারসাম্যের স্তর কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আপনা থেকেই।
ছবির কয়েকটা দৃশ্যের কথা বলা যাক। একদম শুরুতে আমরা দেখি রোহিণীর সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। রোহিণীর মনে দ্বন্দ্ব, প্রেমিক অনিরুদ্ধ বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে। রোহিণী তাকিয়ে আছে ঠায়, ওর মনে ভেসে আসছে "ওগো মা, রাজার দুলাল যাবে আজি মোর ঘরের সমুখপথে"... কত না-বলা কথা কবিতায় বলছে সে নিত্যদিনের কাজের মাঝে। রোহিণী যেখানে বসত, তার ঘরে, যে কোনও উদ্বেল মুহূর্তে আমরা দেখতাম, ফ্রেমের ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্রনাথের মস্ত ছবি। অনেকটা কুলহারা হৃদয়ে তরীর সন্ধান পাওয়ার মতো। রবি ঠাকুর তো এমনই, যে কোনও কঠিন সময়ে পাশে এসে দাঁড়ান কবিতার মতো এক দীর্ঘকায় ছায়া হয়ে।
এরপর একটি দৃশ্যে রোহিণী তার বাবার সঙ্গে ট্যাক্সিতে ফিরছে এবং আলোকিত রাস্তার মাঝে সারি বেঁধে হেঁটে যাওয়া কচিকাঁচাদের দেখে রোহিণীর মনে পড়ছে, "ছোট্ট আমার মেয়ে, সঙ্গিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নিচের তলায় যাচ্ছিল সে নেমে"... আমাদের শৈশব আমরা সারাজীবনই বয়ে বেড়াই। যে কোনও পথের মাঝে হঠাৎ বাঁকে কোনও সম্পর্কের ভিড় যখন বহুবিধ জটিলতায় ক্লান্ত করে, আমাদের মনে হয় শৈশবে ফিরে যাই। কিন্তু ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি? তাই শৈশব আর যৌবনের দোলাচলে প্রতিবারের মতো বলে উঠতে ইচ্ছে করে, 'হারিয়ে গেছি আমি!'
রোহিণীর মা, যিনি রোহিণীকে সঞ্চয়িতা পড়ে ঘুম পাড়াতেন একসময়। আবার সেই পড়ুয়া মেয়েই যখন বড় হয়ে ঘুমের ওষুধ ধরে, মায়ের বিস্ময় জাগে। কারণ, মা তো নিজেই জানেন, রবীন্দ্র-ওষুধের গুণাবলী কেমন, তিনি থাকতে অন্য বদ্যির প্রয়োজন হলো কেন মেয়ের?
মেয়ের যে সত্যিই বদ্যির প্রয়োজন হয়েছে সে-খবর আমরা আরেকটি দৃশ্যেও পাই। রোহিণী রীতিমতো সন্দেহপরায়ণ হয়ে প্রেমিক অনিরুদ্ধকে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গ পড়িয়ে শোনাচ্ছে। "হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে"... ছলে-বলে-কৌশলে রোহিণী বোঝানোর চেষ্টা করছে তার ভালবাসার প্রতি আকুতি। আসলে তো ঘুমের ওষুধ নয়, ভালবাসার মরণঘুম তাকে প্রতি মুহূর্তে জাগতে দিচ্ছে না, তবু তার আকুতি, যদি সে ফিরে আসে!
"ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া, বকুলবনে মাতাল হয়ে এল/ বােল ধরেছে আম্রবনে-বনে, ভ্রমরগুলাে কে কার কথা শােনে!"... কবিতা ওদের নিত্যসঙ্গী। আলাদা করে কোনও প্রস্তুতিপর্বের দরকার হয় না। হয় না স্থান-কাল-পাত্র ভেবে শব্দ বলার পালা! তাই হাসপাতালের বদ্ধ পরিবেশে মা মেয়ের কাছে এলে হোরিখেলার শব্দবন্ধগুলো আপন খেয়ালে যে যার স্মৃতিকে উসকে দেয় হঠাৎই!
রোহিণীর মাতৃবন্ধন, প্রায় অনেকটাই ঋতুপর্ণর আদলে গড়া এক চরিত্র। যেমন করে অসুস্থ মা-কে শেষের দিকে আগলে রাখতেন ঋতু, তেমন করেই রোহিণীও আগলে রাখতে চাইত তার মা-কে সমস্ত দিন। মায়েরা বয়সকালে মেয়ের মতো হয়ে যায়, আর মেয়েরা মায়ের মতো। তাই কখনও-সখনও সেবা-শুশ্রুষার ফাঁকে ফাঁকে রোহিণীর মায়ের মনে পড়ে যায়, "মনে হয় তোর মুখে চেয়ে, তুই যেন কোন দেশের মেয়ে, যেন আমার অনেক কাছের অনেক দূরের মা।"
এই ছবিতে ব্যবহার করা সমস্ত কবিতার মধ্যে সবচয়ে সিনেম্যাটিক মনে হয় 'অসম্ভব' কবিতাটা। এই কবিতায় এমনিই দৃশ্যপট এঁকে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানসচক্ষে। এবার ঋতুপর্ণ কী অদ্ভুতভাবে, সম্পর্কের বিচ্ছেদ এবং ভাবনার বিচ্ছেদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন সিনেমায়, কবিতার ছোট ছোট ছন্দের মধ্যে দিয়ে। একদিকে বিচ্ছেদকে বিচ্ছেদ হিসেবে মেনে নিতে চেয়েও না পারার দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে সেই সন্দেহের রেশ টেনে নিয়ে আসা নিজের পরিবারে। কুলকিনারাহীন অহেতুক রোগগত কুচিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সংসারের সর্বত্র। রোহিণী জানত, "পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ...", রোহিণী গেরস্থালির সর্বত্র প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়েও গুনগুন করত, "যূথী বন হতে বাতাসেতে আসে সুধার স্বাদ, বেনী বাঁধনের মালায় পেতেম যে সংবাদ, ওই তো জেগেছে নবমালতীর সে সৌরভ, মন শুধু বলে অসম্ভব এ অসম্ভব।" যা কিছু অসম্ভব তার সবই যে সম্ভব, এবং উল্টোটাও- তেমন এক দোলাচল যে সিনেমাতেও বোঝানো সম্ভব, অসুখ না দেখলে তা আমার জানা হতো না।
এই ছবির শেষে কোনও কবিতা নেই, তবে অন্ধকারের ভেতর থেকে দেখতে পাওয়া একটা আশার আলো আছে, যে আলোর সন্ধান রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ লেখায় আমরা পাই। সেই আলোর পথে ঋতুও হেঁটেছিলেন তাঁর প্রতিটি ছবির শেষে, হাঁটিয়েছিলেন রোহিণীকেও, ওর বাবার হাত ধরে।
হেঁটে চলেছি আমরাও একই সঙ্গে, ঋতুর রেখে যাওয়া চরিত্রদের সলতেগুলো সঙ্গে নিয়ে।