সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক-কমেন্ট না পেলেই বিষণ্ণ! চরম আসক্তির দায় আসলে কার?
Social Media Addiction: আমরা নিজেরাও জানি সামাজিক মাধ্যম অন্তরের শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলতে পারে না, কিন্তু মন খারাপ হলে বা নিতান্তই একঘেয়ে লাগলে হাতটা অজান্তেই ফোনের কাছে চলে যায়।
অফিসে কাজের ফাঁকে বা দিনের শেষে বিছানায় গিয়ে স্মার্ট ফোনটা হাতে নিয়ে একবার ভাবলেন ফেসবুকটা দুই মিনিটের জন্য একটু স্ক্রল করি বা ইনস্টাগ্রামে গিয়ে একটা রিল দেখি! তারপর সেই দুই মিনিট পেরিয়ে কখন দুই ঘণ্টা হতে চলল বা ইনস্টাগ্রাম রিলের সংখ্যা এক পেরিয়ে কখন দশ বা বিশ ছুঁয়েছে, সে খেয়াল আর নেই আপনার। কেবল কম বয়সীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধ প্রায় সবাই ইন্টারনেটের নেশার জাঁতাকলে আবদ্ধ। শুধুই কি ইন্টারনেটে উপচে পড়া পোস্ট, ভিডিও বা ছবিই আপনার এই বেলাগাম নেশার পারদ চড়াচ্ছে? না কি আরও কিছু আছে যা আপনাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেশায় বুঁদ করে রাখে! সময় কখন আঙুলের ফাঁক দিয়ে ফসকে যায় আপনি সেই নেশার ঘোরে বুঝতেও পারেন না!
ইন্টারনেটে উপচে পড়া ‘রসদ’-কে দোষারোপ করে লাভ নেই। পুরোটাই মস্তিষ্কে নিউরোনের খেলা, যা আপনাকে ইন্টারনেটের নেশায় বুঁদ করে রাখে। বললে অবাক হবেন, ঠিক যে নিউরোনাল বর্তনী বা সার্কিটরি, আপনাকে সামাজিক মাধ্যমের নেশায় বুঁদ করে রাখে, একই নিউরোনাল সার্কিটরি কোকেনের মতো মারণ নেশায় মানুষকে বশ করে রাখে।
ডোপামাইন রিওয়ার্ড সিস্টেম:
ডোপামাইন- সেই নিউরোহরমোন যা সরাসরি আমাদের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা, আবেগপ্রবণ আচরণ এবং নতুন কিছু শেখার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু তার পাশাপাশি ডোপামাইন যা করে, তা হল ‘প্লেজা়র অ্যান্ড রিওয়ার্ড সিকিং বিহেভিয়ার’, নেশা এবং উপলব্ধির ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এ ক্ষেত্রে রিওয়ার্ড শব্দটিকে ঠিক পুরস্কার অর্থে ব্যবহার করা যায় না। বলা যেতে পারে এমন কিছু কাজ, যা করে আমাদের ভালো লাগবে। অর্থাৎ কোনও কাজ শেষ করার পরে বা পছন্দের গান শুনে, প্রিয় খাবার খেয়ে যে আনন্দটা পাই তা কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করে ডোপামাইন। আবার এই যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে কাটানো, সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটার যে নেশা- তার নেপথ্যেও রয়েছে ডোপামাইন। সারাক্ষণই যেন মনে হয় ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো সামাজিক মাধ্যম বুঝি আমাদের আনন্দ দেবে, মনের যে শূন্যতা তা ভরিয়ে দেবে। আমরা নিজেরাও জানি সামাজিক মাধ্যম অন্তরের শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলতে পারে না, কিন্তু মন খারাপ হলে বা নিতান্তই একঘেয়ে লাগলে হাতটা অজান্তেই ফোনের কাছে চলে যায়। আর ঠিক এটাকেই বলে ‘প্লেজা়র সিকিং বিহেভিয়ার’।
আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও কিছু পোস্ট করার পর আশা করেন আপনার কৃত্রিম জগতের বন্ধু-বান্ধব বা আপনার অনুগামীরা আপনার পোস্ট লাইক করবেন, সেখানে নিজের মতামত জানাবেন, দুটো ভালো কথা বলবেন। আর একেই বলে ‘রিওয়ার্ড সিকিং বিহেভিয়ার’। এখানে পুরস্কার হল কয়েকটা লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ার। কিন্তু এর অন্যথা হলে অর্থাৎ আশানুরূপ লাইক, ভালো কমেন্ট বা শেয়ার না হলে আমরা হতাশ হই। কারণ আমরা ‘রিওয়ার্ড’ পাই না, রিওয়ার্ড না পেলে ডোপামাইন ক্ষরণ হবে না। আর ডোপামাইন ক্ষরণ না হলে প্লেজা়র বা আনন্দ পাব না আমরা।
আরও পড়ুন- দুধের শিশুর শরীরে বিষ হয়ে ঢুকছে দুধ! জানেন কী বিপদ ডেকে আনছেন
আমাদের মস্তিষ্কে চারটি ডোপামাইন পাথওয়ে রয়েছে, যা এই সমস্ত ধরনের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। পাথওয়ে বলতে বোঝায় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে যে পথে কোনও জৈবরাসায়নিক পদার্থ নিজেদের রাসায়নিক বার্তা পাঠায়। ঠিক সেই রকম, ডোপামাইনের ক্ষেত্রে এই রকম চারটি ভিন্ন ধরনের পাথওয়ে আছে, যারা ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভাবে কাজ করে। এই চারটি পাথওয়ে হল মেসোকর্টিক্যাল, মেসোলিম্বিক, নিগ্রোস্ট্রায়াটাল এবং টিউবেরোইনফান্ডিব্যুলার পাথওয়ে। এর মধ্যে প্রথম তিনটিকে বলে ‘রিওয়ার্ড পাথওয়ে’। তবে যে কোনও ধরনের নেশার ক্ষেত্রে এই তিনটে পাথওয়ে যথাযথ ভাবে কাজ করে না। কিন্তু যখনই আমরা আশা করি আমরা ‘রিওয়ার্ড’ পাব (যেমন ফেসবুক স্ক্রোল করে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করার পর তাতে লাইক, কমেন্ট ইত্যাদি পাওয়া), তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠে প্রথম তিনটি পাথওয়ে।
খাবারের গন্ধ পেলে বা খাবার দেখতে পেলে আমাদের খিদে পেতে শুরু করে বা জিভে লালা ক্ষরণ ঘটে। এক্ষেত্রে খাবার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। ঠিক তেমন ফেসবুকে একটি নোটিফিকেশন, ইনস্টাগ্রামে একটি লাইক, এমনকী একটি মেসেজ সেই রিওয়ার্ডের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
কখন কতটা ডোপামাইন ক্ষরণ হচ্ছে:
ধরুন, আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করার পরে একটি নোটিফিকেশন এল। আপনি আশা করছেন আপনি ‘রিওয়ার্ড’ পাবেন। ঠিক এই সময়ে আপনার ডোপামাইন ক্ষরণ তুমুলভাবে হয়। কিন্তু নোটিফিকেশনটি খুলে দেখলেন, কেউ বাজে ভাবে সমালোচনা করছে আপনার পোস্টকে। ঠিক সেই সময় ডোপামাইনের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে হঠাৎ করে নেমে যায়। বা আপনি নোটিফিকেশন দেখে আশা করছেন, কেউ ভালো কথা বলবে। ডোপামাইনের ক্ষরণ পৌঁছেছে চরমে। দেখলেন, ভালো কথাই লিখেছেন আপনার বন্ধু বা অনুগামী। তখন আর ক্ষরণ বাড়ে না বরং আবার স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসে এই নিউরোহরমোনটির ক্ষরণ।
আরও পড়ুন- গীতা ছুঁয়ে শপথ, ঋষি সুনককে কেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানল ব্রিটেন
আবার দেখা গেল, কেউ হুট করেই ‘রিওয়ার্ড’ পেল। তখন মেঘ না চাইতেই জল! রিওয়ার্ড পাওয়া মাত্রই ডোপামাইন ক্ষরণ আবার বাড়ে হু হু করে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডোপামাইন-চালিত ফিডব্যাক লুপ:
ভেবে দেখুন আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখতে ভালোবাসেন, তাই দেখতে পান মূলত। এবং আপনি যেমন মানুষ, ঠিক সেরকম মানুষের সঙ্গেই আলাপ হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলিতে। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়ে লাভ নেই। এটি নিতান্তই সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগোরিদম। প্রোগ্রামাররা খেটে-খুটে, অনেক অঙ্ক কষে এবং অবশ্যই আপনার-আমার মনস্তত্ত্বকে বুঝে এসব অ্যালগোরিদম বানান। যার ফলে আপনি যা দেখতে চান সোশ্যাল মিডিয়ায় তাই দেখতে পান এবং আপনি যা দেখতে পান, তাই দেখতে চান।
আপনার ‘প্লেজার অ্যান্ড রিওয়ার্ড সিকিং বিহেভিয়ার’ আপনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ করে রাখে। এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিওয়ার্ড এবং আনন্দ না পেলে বা ডোপামাইন ক্ষরণ কমে গেলে আপনি আবারও হতাশা ও একঘেয়েমি কাটাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘প্লেজার এবং রিওয়ার্ড’ খোঁজেন। মোদ্দা কথায় যাকে বলা হচ্ছে ডোপামাইন-চালিত ফিডব্যাক লুপ। ভেবে দেখুন, কী সীমাহীন একটা চক্রের মধ্যে আমাদের ফেলেছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং সামগ্রিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা।
‘ভেরিয়েবল রিওয়ার্ড শিডিউল’। এই বিষয়টির কথা প্রথম বলেছিলেন বি.এফ. স্কিনার। তখন ১৯৩০-এর দশক। তিনি ল্যাবের খাঁচায় বন্দি ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখেছিলেন, যখনই ইঁদুরদের রিওয়ার্ড (ইঁদুরদের ক্ষেত্রে খাবার) দেওয়া হয়, তখনই তারা সেই উদ্দীপনায় সাড়া দেয়। এখানে ল্যাবের খাঁচা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি। শুধু ইঁদুর (এবং তাদের পরীক্ষক) কারা, তা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার।