উচ্চ রক্তচাপ মানেই মৃত্যুর হাতছানি, ভারতে হু হু করে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি
অনুমান করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর ৮০ শতাংশই হবে মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে। আগামী দিনে ভারতীয়দের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
হৃদরোগের সমস্যা, স্ট্রোক এবং ফলস্বরূপ দীর্ঘমেয়াদি অক্ষমতার অন্যতম কারণ হাইপারটেনশন বা অত্যধিক রক্তচাপ, এমনটাই জানা গেছে নতুন এক রিপোর্টে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, ভারতীয়দের মধ্যে হৃদরোগের কারণে মৃত্যু ও অক্ষমতার দ্বিতীয় প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর চিকিৎসকদের মতে, দেশে যে-হারে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে ইতিমধ্যেই উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। একমাত্র তবেই বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে।
ভারতে স্ট্রোক এপিডেমোলজির একটি সমীক্ষা অনুসারে, গত চার দশকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে স্ট্রোকের ঘটনা প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে। অনুমান করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর ৮০ শতাংশই হবে মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে। আগামী দিনে ভারতীয়দের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
নতুন রিপোর্টে কী বলা হয়েছে?
গবেষণায় দেখা গেছে যে, কমপক্ষে ৬৪ শতাংশ স্ট্রোক-আক্রান্ত রোগীর উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যার ফলে মারাত্মক কার্ডিওভাসকুলার রোগ দেখা দেয়। ভারতে প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে ১১৬ থেকে ১৬৩ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। যোধপুর এইমসের চিকিৎসক পঙ্কজ ভরদ্বাজের মতে, "স্ট্রোক এবং উচ্চ রক্তচাপের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে তার হাজার একটা প্রমাণ রয়েছে।তাই তৃণমূল স্তরে রক্তচাপের চিকিৎসা করানো প্রয়োজন এবং স্বল্প খরচে ও সহজে যে কোনও বড় ক্ষতি সামলানো সম্ভব।"
আরও পড়ুন: পুরুষদের মধ্যে হু হু করে বাড়ছে প্রস্টেট ক্যানসার, কোন অভ্যাস ডেকে আনছে বিপদ?
অভিজ্ঞ কার্ডিওলজিস্ট সুরিন্দর দেওরা জানিয়েছেন, "স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীদের ৫০ শতাংশই বাকি জীবনের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে যান, ফলে স্ট্রোকের আর্থসামাজিক প্রভাব মারাত্মক।"
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ স্টাডি তাদের রিপোর্টে বলেছে, ২০১৬ সালে অর্থাৎ অতিমারী শুরুর আগেই ভারতে ১৬.৩ লক্ষ মানুষ উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে মারা গেছেন। এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের কারণে ৫৭ শতাংশ মানুষ স্ট্রোক-আক্রান্ত হয়েছেন এবং বাকিদের মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাকের ফলে। প্রতি বছর স্ট্রোক-আক্রান্তদের ৭০ শতাংশই প্রথমবার আক্রান্ত হন। তাই একেবারে গোড়া থেকেই উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
তবে এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা প্রয়োজন, কাকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে ধরা হয় এবং কীভাবে অতিরিক্ত রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক আক্রান্ত হন একজন ব্যক্তি।
উচ্চ রক্তচাপ কী?
হৃদপিন্ডর ধমনীর দেওয়ালের বিরূদ্ধে রক্ত যে বলপ্রয়োগ করে, তাকেই সাধারণত রক্তচাপ বলা হয়। এই চাপ দু'ভাবে রেকর্ড করা হয়, যথা, সিস্টোলিক চাপ এবং ডায়াস্টোলিক চাপ। এখন হৃদপিন্ডর ধমনিতে রক্তপ্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ হয় ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। কিন্তু যদি এই রিডিং ১৪০/৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে যে, ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। চিন্তার বিষয় হলো, ভারতে প্রতি চার জনের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছেন।
সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। তবে অনেকের ক্ষেত্রে জিনগত কারণ, স্থূলতা,ধূমপান, অত্যধিক লবণ গ্রহণ, স্ট্রেস এবং শরীরচর্চার অভাবেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে।
স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপ
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শরীরের প্রতিটি কোশে, এমনকী, মস্তিষ্কের কোশগুলিতেও অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন। কোনও কারণে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনির পথ সংকীর্ণ হয়ে বা বাধাপ্রাপ্ত হলে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। আবার উচ্চ রক্তচাপের কারণে ধমনিতে যে চাপ সৃষ্টি হয় তার ফলে নালি ছিঁড়েও যেতে পারে। ফলস্বরূপ অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের কোশগুলি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এই অবস্থাকেই চিকিৎসকরা স্ট্রোক বলে থাকেন।
মূলত দু'রকমের স্ট্রোক হয়। ইসকেমিক স্ট্রোক এবং হেমারেজিক স্ট্রোক। এর মধ্যে হেমারেজিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনির দেওয়াল ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে স্নায়ুকোশগুলি নষ্ট হয়ে যায়। রক্তবাহী ধমনির দেওয়ালে রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে নালি ফেটে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের কারণেই ইসকেমিক রোগে আক্রান্ত হন কোনো ব্যক্তি।
স্ট্রোকের লক্ষণ
• শরীরের একদিক অবশ হয়ে যায়।
• হঠাৎ কথা জড়িয়ে যায় আবার অনেকের ক্ষেত্রে মুখ বেঁকেও যেতে পারে।
• রোগীর শরীর যে কোনও একদিকে হেলে যায়, অর্থাৎ শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন রোগী।
উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের চিকিৎসা
সুস্থ থাকতে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা জরুরি। পাশাপাশি জীবনধারা পরিবর্তন এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খাওয়া উচিত। খাবারে সীমিত পরিমাণ লবণ গ্রহণ করে পরিমাণমতো টাটকা ফল ও শাকসবজি খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ধূমপান এবং মদ্যপান সম্পূর্ণ ত্যাগ করুন।
তবে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক আক্রান্ত হলে সেই ব্যক্তিকে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এই সময়ের মধ্যে রোগীর চিকিৎসা শুরু হলে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবন্ধকতাগুলিকে কমানো যেতে পারে। সাধারণত সিটি স্ক্যান, এমআরআই করে রোগীর স্ট্রোক নিশ্চিত করা হয়। অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপের কারণে স্ট্রোকের চিকিৎসায় প্রাথমিকভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। তবে মারাত্মক ক্ষেত্রে অপারেশনেরও প্রয়োজন হয়। তাই শুরু থেকেই কঠোরভাবে জব্দ করুন উচ্চ রক্তচাপকে এবং সুস্থ থাকুন।