প্রশান্ত কিশোর: 'ছেড়ে রেখেই ধরে রাখা'-র সিদ্ধান্ত তৃণমূলের?
জল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচন-কুশলী প্রশান্ত কিশোর যদি সত্যিই জাতীয় স্তরে কংগ্রেস দলে যোগ দেন, তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস কি সত্যিই বিপাকে পড়বে ?
প্রশান্ত কিশোর এখনও তৃণমূলের প্রধান পরামর্শদাতা৷ নির্দিষ্ট চুক্তির ভিত্তিতেই তিনি এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন৷ পিকে'র পরামর্শেই তৃণমূল বাংলার বাইরে একাধিক রাজ্যে পা রাখার জমি তৈরি করার চেষ্টা করছে৷ বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেস ছেড়ে একাধিক নেতার তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদানের নেপথ্যেও পিকে-র হাতযশ রয়েছে৷ বাংলার বাইরের কয়েকটি রাজ্যে তৃণমূলের ডালপালা মেলার বিষয়টি প্রায় পুরোটাই ছাড়া হয়েছে পিকে'র হাতেই৷ সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে ভাল হলেও দল হিসেবে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সুসম্পর্কের ঘাটতি রয়েছে৷ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে কংগ্রেস পর্যুদস্ত হওয়ার পর তৃণমূলের তরফে এমন কথাও বলা হয়েছে, এখন কংগ্রেস বরং মিশে যাক তৃণমূলের সঙ্গে৷ বিজেপি-বিরোধী শিবিরের পতাকা কংগ্রেসের হাতে থাক, এমনটাও চাইছে না তৃণমূল৷ এমন অপছন্দের দলের কোনও নেতাকে ভবিষ্যতেও নিজেদের পথ চলার কৌশল স্থির করার গুরুদায়িত্বে তৃণমূল রাখবে?
ওদিকে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ডুবন্ত কংগ্রেসকে টেনে তোলার একাধিক পরামর্শ দফায় দফায় সোনিয়া-সহ শীর্ষ কংগ্রেস নেতৃত্বকে ইতিমধ্যেই দিয়ে ফেলেছেন পিকে৷ কংগ্রেসকে ফের স্বমহিমায় ফেরাতে চাইছেন পিকে৷ এই কাজে আপাতত পরামর্শ দিলেও ভবিষ্যতে হয়তো কংগ্রসের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবেই এই বিষয়টিই এককভাবে দেখবেন পিকে৷ রাজনৈতিক মহলের অভিমত, আনুষ্ঠানিকভাবে সে কাজ শুরু করলে তৃণমূলের সঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের Conflict of interest বা স্বার্থের সংঘাতের আশঙ্কা প্রবল৷ তখন নেতা পিকে এবং পেশাদার ভোট-কুশলী পিকে'র মধ্যে একটা ফারাক তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক৷ রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন পিকে বিভিন্ন রাজ্যের যে সব কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে তাঁদের তৃণমূলে পাঠিয়েছেন, অথবা যেসব নাম এখনও পাইপলাইনে রয়েছে, এবার তাহলে তাদের কি ফের ঠেলে দেবেন কংগ্রেসের কোর্টে? পেশাদার পিকে-র কাছে এই কাজ চরম পরাজয়ের হলেও কংগ্রেস নেতা প্রশান্ত কিশোর এমন করতে পারলে প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে সফল হবেন৷ কিন্তু এমন করলে তো পিকে-র সঙ্গে তৃণমূলের চিরস্থায়ী শত্রুতা অনিবার্য৷ পেশাদার একজন নির্বাচন-কুশলী, যাঁর কাজের ক্ষেত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আঙিনার অন্দরে, তাঁর পক্ষে কি চট করে এমন কাজ করা সম্ভব?
আরও পড়ুন: পাখির চোখ ২০২৪, কোন ফন্দি আঁটছেন প্রশান্ত কিশোর?
তাই, পিকে কংগ্রেসে যোগ দিলে তৃণমূল কংগ্রেস বিপাকে পড়বে অথবা তিনি নিজেই বিপাকে পড়বেন, এতখানি সরলীকরণ করা বোধহয় ঠিক নয়৷ গোটা বিষয়টির মধ্যে দু'তরফের কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকাই স্বাভাবিক৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে অন্ধকারে রেখে প্রশান্ত কিশোর কংগ্রেসের ত্রাতা হতে চলেছেন, এমন ভাবার বুদ্ধিগ্রাহ্য কোনও কারণ আছে বলে মনে হয় না৷
তবে এটাও ঠিক, কিছুটা অস্বস্তিতে পড়বেন গোয়া, মেঘালয় বা জাতীয় স্তরের বেশ কিছু প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা, যাঁরা এই প্রশান্ত কিশোরের ডাকে সাড়া দিয়েই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন৷ পিকে-র দৌত্যেই মেঘালয়ের মুকুল সাংমা ১১ জন বিধায়ককে নিয়ে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছেন৷ মেঘালয়ে তৃণমূলের বিস্তার ঘটানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রশান্তের তৈরি সংগঠন আইপ্যাক-কে। আজ পিকে-র কংগ্রেস-প্রীতি দেখে সাংমারা হয়তো ভাবছেন, 'আমও গেল, ছালাও গেল'৷ সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মেঘালয়ের তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি চার্লস পিংরোপ তো বলেই দিয়েছেন, "এটা অনৈতিক৷ মেঘালয়ে একই সঙ্গে কংগ্রেস ও তৃণমূলের জন্য কাজ করতে পারেন না পিকে বা তার টিম।" এদিকে এআইসিসি-তে গুঞ্জন, পিকে কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এলে ২০২৩-এ যেসব রাজ্যে ভোট হবে, সেই রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস সংগঠন শক্তপোক্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হবে প্রশান্ত কিশোরকেই। এই রাজ্যগুলির মধ্যেই আছে মেঘালয়। মুকুল সাংমা-রা হয়তো তাই নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ইদানীং গভীরভাবে চিন্তা করছেন৷ এমন ভাবনায় ডুবে আছেন আরও দু'একটি রাজ্যের দলবদলু নেতারাও৷
প্রশান্ত কিশোর নিজের ব্যাপারে অন্যরকম ভাবনার কথা প্রকাশ্যে আনলে এমন 'সংকট' যে হতে পারে, সে সম্পর্কে তৃণমূল প্রথম থেকেই অবহিত৷ এটা নিশ্চিত৷ তাহলে পিকে-কে থামাল না কেন তৃণমূল? কেন কংগ্রেসের হয়ে ব্যাট ধরার আগ্রহ প্রকাশ করতে দেওয়া হলো পিকে-কে? তৃণমূলের সঙ্গে পিকে নিশ্চয়ই চুক্তিবদ্ধ৷ সেই চুক্তিতে সম্ভবত একথা বলা আছে, কোনও রাজনৈতিক দল যদি তৃণমূলের বৃহত্তর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার অভিপ্রায় প্রকাশ্যে আনে, তাহলে চুক্তিবদ্ধ সময়কালে প্রশান্ত কিশোর অবশ্যই সেই দলের ব্রিফ নিতে পারবেন না৷ তাহলে এমন পরিস্থিতিতে তৃণমূল পড়তে চলেছে কেন ?
আরও পড়ুন: প্রশান্ত কিশোরের জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় কি আদৌ প্রাণ ফিরবে কংগ্রেসের!
আসলে পেশাদার প্রশান্ত-র একাধিক স্টেডিয়ামে খেলার দক্ষতা রয়েছে৷ ওঁর ট্র্যাক-রেকর্ড বলছে,২০১২-তে বিজেপির হয়ে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে, ২০১৪-তে সেই বিজেপির হয়েই লোকসভা ভোটে, ২০১৫-তে জেডিইউ-র হয়ে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে, ২০১৭-তে কংগ্রেসের হয়ে পাঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে, ২০১৭-তেই কংগ্রেসের হয়ে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে, ২০১৯ সালে ওয়াইএসআর-এর হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে, ২০২০-তে আম আদমি পার্টির হয়ে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে, ২০২১-এ তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে, ২০২১-এ ডিএমকে-র হয়ে তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে ভোটকুশলী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন প্রশান্ত কিশোর৷ সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, কোনও বিশেষ দলের হয়েই তিনি একমাত্র 'কাজ' করবেন, এমন নয়৷ ফলে তৃণমূলের সেভাবে আপত্তি করার প্রশ্ন নেই৷ তাই ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে এবং তার আগে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে পিকে কংগ্রেসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মধ্যে বিস্ময়েরও কিছু নেই৷ তবে এবার তিনি যদি সরাসরি কংগ্রেসে যোগ দিয়ে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেন, সেটাই হবে পিকে-র ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ ৷
কিন্তু গোটা বিষয়টি এত সহজ-সরল নাও হতে পারে৷ ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের জন্য হোমওয়ার্ক করতে বসে প্রশান্ত কিশোর হয়তো দেখেছেন, কয়েকটি দল কংগ্রেসকে বাইরে রেখে জাতীয় স্তরে বিজেপি- বিরোধী জোট গঠন করতে সচেষ্ট হয়েছে৷ তৃণমূল কংগ্রেসও এই একই ধারণা পোষণ করছে৷ এই জোট প্রাথমিকভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গুরুত্ব দিলেও সঠিক সময়ে নিজেদের মত বদল করতে পারে৷ তাছাড়া কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে তৈরি জোটের পক্ষে মোদিকে হারানো সম্ভব নয়৷ অভিজ্ঞ প্রশান্ত কিশোর জাতীয় রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিজেপি-বিরোধী মহাজোটের অন্যতম প্রধান মুখ হিসেবে তৃণমূল সুপ্রিমো'র ওপরও সে ভাবে আস্থা রাখতে পারছেন না৷ পিকে নিজে তৃণমূলের পরামর্শদাতা হলেও, তাঁর ধারণা, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ২০২৪-এ মোদিকে হারানো সম্ভব নয়। এর পরই নতুন কৌশল রচনা করেছেন পিকে৷ পোড় খাওয়া ভোটকুশলী পিকে নিশ্চিত হয়েছেন এই মুহূর্তেই বিজেপি-বিরোধী জোটের পতাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেওয়া ঠিক ততখানি সহজ হচ্ছে না৷ অথচ ওই নির্বাচনে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক রাখতে হবে মমতাকে৷ এর একমাত্র দাওয়াই কংগ্রেসকে সামনে রেখেই জোট গড়া৷ সেই জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী হবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ আর এই কাজ সহজতর হবে পিকে যদি কংগ্রেসে যোগ দেন অথবা কংগ্রেসের পরামর্শদাতা হন৷ তাই কংগ্রেসকে সামনে রেখেই মোদি-বিরোধী মহাজোট হবে৷ পিকে হয়তো দায়িত্ব নিয়েছেন, তিনি নিজে সোনিয়া গান্ধী বোঝানোর চেষ্টা করবেন ওই জোটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আনা হোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷ ২০২৪-এ বাংলায় কংগ্রেস আসন সমঝোতা করুক তৃণমূলের সঙ্গে৷ এই জোট কমপক্ষে ৩৮-৪০টি আসন লাভ করবে৷ আর পিকে নিশ্চিত, তিনি কংগ্রেসে যোগ দিন বা না দিন, শুধুমাত্র পরামর্শদাতা হিসেবে তাঁর দেওয়া এই ফরমূলা সোনিয়া গান্ধী মেনে নেবেন৷ সেক্ষেত্রে মেঘালয়েও কংগ্রেস জোট করতে পারবে তৃণমূলের সঙ্গে৷ মুকুল সাংমাদের অস্বস্তিও দূর হবে৷ পিকে-র এই পরিকল্পনা সম্ভবত তৃণমূলের ছাড়পত্র পেয়েছে৷ প্রশান্ত কিশোরকে আপাতত 'ছেড়ে রেখেই ধরে রাখা'-র সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের সুপ্রিমো৷
অভিজ্ঞ এবং পেশাদার প্রশান্ত কিশোর তৃণমূলকে বোঝাতে পেরেছেন, জাতীয় স্তরে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে থাকলেই লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের রাজনৈতিক ফায়দা শতগুণে বেশি৷