'প্রথম প্রেম' বিদেশিনীর সঙ্গে || আড়ালে থেকে গেলেন প্রেমিক সুভাষচন্দ্র বসু
Netaji Subhas and Emili Schenkl: শোনা যায়, এমিলি-সুভাষের একসঙ্গে থাকা এবং তাঁদের সন্তানের বিষয়ে সবটা ভারতে ‘একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি’-ই জানতেন।
ভারতে ‘হিরো’ হওয়ার ঝঞ্ঝাট কম না। হিরো বলতে যাঁদের হামেশাই সিনেমায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, তারাই তো নন কেবল। ‘হিরো’ যেহেতু একটি ধারণা, সেহেতু ধারণার ল্যাজ বেয়ে বেয়ে সারা দেহেই ছড়িয়ে পড়েছে যোদ্ধাবেশের কল্পনা, ত্রাণকর্তার (কর্ত্রী পপুলার নয় কি না, তাই বাদ) উদাত্ত স্বর। যে স্বরে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে নিপীড়িত জনগণের, স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার পোকা আবার চাগাড় দিচ্ছে মাথার ভেতর, হিরোর স্লোগানে রাজা খান খান হয়ে যাচ্ছে, পতপত করে উড়তে থাকা একটা পতাকার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ‘হিরো’। আর হিরোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে ভারতবাসী। এই দুর্দান্ত হিরো অথবা সুপারহিরো ইমেজ এতই সুপ্রোথিত যে, কেউ বিশ্বাসই করতে পারেন না হিরো ফুটোওয়ালা বাজারের থলি নিয়ে বেছে বেছে চালকুমড়ো কিনতেই পারেন। হিরো কোনও ঝাঁকড়া বোগেনভেলিয়ার গাছ দেখে মুগ্ধ হতেই পারেন, হিরো সমস্ত বিপ্লবের বইয়ের মাঝে লুকিয়ে রাখতেই পারেন প্রাক্তন কোনও গাছের পাতা।
ভারত চিরকালই নেতার মুখাপেক্ষী, গণঅভ্যুত্থান অপেক্ষা করে থাকে কোনও এক এমন ইমেজের, যাকে সামনে রেখে হাল্লা বোল উচ্চারণ করা যায়। ঘুমিয়ে থাকা মানুষ যার নাম করে নিশ্চিন্তে জেগে উঠতে পারে। সুতরাং, এই ইমেজের সঙ্গে জাগতিক, বৈষয়িক, সাংসারিক বিষয়গুলোকে কোনওভাবেই জোড়া যায় না। ভারতে হিরো বা সুপারহিরো শুধুই যোদ্ধা নন, সাধকও। সে বিপ্লবের হোক বা সাহিত্যের। রবি ঠাকুরের স্ত্রীকে লেখা কেজো চিঠির মধ্যে যে জমিদার রবি রয়েছেন, তাকে ভারত বাদ দিয়ে দেয়। গায়কের তীব্র ঘৃণাত্মক সব মন্তব্য বাদ দিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে দিনবদলের গান। সুভাষের প্রেমটুকু বাদ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে আজাদ ভারতের ডাক। শুধু ভারত নয়, এঁরা নিজেরাও সেই সমস্ত জাগতিক, বৈষয়িক, সামাজিক ও রোমান্টিক যাপনকে পর্দার বহু দূরেই রেখেছেন ‘বৃহত্তর স্বার্থ'-এর খাতিরে।
যার ওপরে নির্ভর করে দেশ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে, সে জনৈকা বিদেশিনীর সঙ্গেই প্রেম করছে, একসঙ্গে থাকছে- হিরোর এমন ইমেজ দেখতে তৎকালীন ভারত প্রস্তুত ছিল না, এখনও নয়। সেই কারণেই নেতাজি জীবনের প্রায় ১০টা বছর যে ইমেজকে গোপন রেখেছিলেন, যোদ্ধা নেতাজির কথা ভাবলে এখনও সেই দশখানি বছর বাদই থেকে যায়। বাদ থেকে যায় এমিলির কথা, বাদ থেকে যায় নেতাজির না থাকার পর এমিলিদের বেঁচে থাকার কথা। এমিলি শেঙ্কল, সুভাষের বই টাইপ করতে এসে যিনি আড়ালেই থেকে গেলেন মৃত্যু অবধি।
আরও পড়ুন: বারবার হত্যার পরিকল্পনা || কারা ছিল গান্ধী-নিধনের নেপথ্যে?
ভিয়েনায় অস্ট্রিয়ান ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে এমিলির শর্টহ্যান্ড টাইপ করতে পারার কথাও না। বাবার মোটেও ইচ্ছা ছিল না মেয়েকে গতানুগতিক স্কুলে পড়াশোনা শেখানোর। সন্ন্যাসিনী হওয়ার শিক্ষা দিতে চার বছরের জন্য একটি নানারিতেও ভর্তি করেন মেয়েকে। যদিও এমিলির সন্ন্যাস-শিক্ষায় কোনও ইচ্ছাই ছিল না, ফের স্কুলে ভর্তি হয়ে যান। ১৯৩৪ সালের জুন মাস, এমলির বয়স প্রায় ২৩। ভিয়েনায় একজন ভারতীয় চিকিৎসক ডা. মাথুরের মাধ্যমে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ এমিলির। সুভাষ তখন ভিয়েনায় থাকবেন, এমনটাই নিশ্চিত। প্রকাশনা সংস্থা উইশার্টের সঙ্গে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ বই লেখার চুক্তি হয়েছে। কিন্তু বই লেখার জন্য একজনের সাহায্য প্রয়োজন, যে ইংরেজি জানে, শর্টহ্যান্ডে ডিকটেশন নিতে পারে এবং টাইপিংয়ে দক্ষ। ১৯৩৪ সালের ২৪ জুন এই পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে আসেন এমিলি। বয়সে প্রায় ১৩ বছরের বড় সুভাষচন্দ্রের সহকারী পদে নিযুক্ত হন এমিলি।
শুরুটা সুভাষের দিক থেকেই হয়েছিল, এমনটাই বলেন সুভাষ-ঘনিষ্ঠ অনেকেই। ১৯৩৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৩৬ সালের মার্চ পর্যন্ত অস্ট্রিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়ায় একসঙ্গে সময় কাটান সুভাষ-এমিলি। নিপাট তরুণী সহকারী বিপ্লবী সুভাষের সঙ্গিনী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৬ সালে ভারতে ফেরার কথা ভাবেন সুভাষ। তবে সেই সময়ে এমিলিকে লেখা একাধিক চিঠি থেকে স্পষ্ট, ভারতে ফিরে জেলবন্দি হওয়ার চেয়েও এমিলিকে ছেড়ে আসার চিনচিনে ব্যথা নেতাজিকে দ্বিধায় ফেলেছিল। চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি জানি না, ভবিষ্যতে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। হতে পারে বাকি জীবন কারাগারে কাটাব, হতে পারে আমাকে গুলি করা হবে বা ফাঁসি দেওয়া হবে। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, আমি তোমার কথা ভাবব। আমার প্রতি তোমার এই ভালবাসার জন্য নীরবে কৃতজ্ঞতা জানাব।”
দুই ভিন্ন দেশের, দুই ভিন্ন সংস্কৃতির, দুই ভিন্ন মানুষের প্রেমকে স্বাধীনতাকামী এই অস্থির দেশ কীভাবে গ্রহণ করবে? এদেশে প্রেমিক নেতাজিকে চায়নি কেউ, ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধাকে দেখতে চেয়েছে মানুষ। সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রাজনৈতিক সহযোগী এসিএন নাম্বিয়ারের লেখা থেকে স্পষ্ট, দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো নেতাজির প্রেমের কথা কেউ জানতে পারলেই তাঁর স্বপ্ন ও আন্দোলন খানখান হয়ে যাবে নিমেষে। যে সামাজিকতা ও সংসারে ভারতীয়রা অভ্যস্ত, তাঁদের ত্রাণকর্তাকেও একই রূপে দেখতে পছন্দই করে না আমজনতা।
আরও পড়ুন: বাসর রাতেই ফেরার বিদ্রোহী কবি! এ এক অন্য নজরুলের গপ্পো
১৯৩৬ সালের ৮ এপ্রিল সুভাষের জাহাজ বম্বেতে নোঙর ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই আর্থার রোডের কারাগারে সুভাষকে বন্দি করে পুলিশ। পরে কার্সিয়াংয়ে এক বাংলোতে নজরবন্দি করা হয় সুভাষকে। এই সময়ের চিঠিগুলোতে একে অপরকে মি. বোস এবং মিস ফ্রাউলিন শেঙ্কল নামেই ডাকতেন তাঁরা। ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর অবধি এমিলি আর সুভাষের মধ্যে চিঠিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অস্ট্রিয়ার রাজনীতি, বই, সংগীত, আধ্যাত্মিকতা এবং পরস্পরের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের পাশাপাশি রয়েছে কালিদাসের নাটকও! কালিদাসের শকুন্তলা থেকে অনুপ্রাণিত জার্মান কবি জোহান উলফগ্যাং ভন গোয়েটের কবিতার উল্লেখ রয়েছে এমিলিকে লেখা সুভাষের একটি চিঠিতে। এমিলিকে নিজের জীবনের ‘প্রথম প্রেম’ হিসেবে স্বীকারও করেছেন নেতাজি।
১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাডগাস্টেইনে গোপনে বিয়ে করেন সুভাষ-এমিলি, কোনও পুরোহিত বা আইনি কাগজপত্র ছাড়াই। সম্পর্ক এবং বিয়েকে যত্নে গোপন রেখেছিলেন দু’জনেই। নেতাজির লক্ষ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা। আর সেই মুহূর্তে নেতাজির বিয়ের বা প্রেমের কোনওরকম খবর প্রকাশ্যে এলে বৃহত্তর আন্দোলন লক্ষ্যচ্যুত হবে, এই আশঙ্কা মোটেও অমূলক ছিল না। বিয়ের পরই ভারতে ফিরে আসেন সুভাষ এবং পরে ১৯৪১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি সময়কালজুড়ে বার্লিনেই ছিলেন সুভাষ।
সুভাষ বার্লিনে আসার কিছু পরেই, ১৯৪১ সালের ১ নভেম্বর ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টারের অফিস তৈরি হয় বার্লিনের এক বিলাসবহুল ভবনে। এমিলি শেঙ্কল ওই বিশাল বাড়িতে সুভাষের সঙ্গেই থাকতেন। তবে সুভাষকে সাহায্য করার জন্য গঠিত ভারতের স্পেশাল ব্যুরোর বেশিরভাগ কর্মীরই এমিলির সঙ্গে মতানৈক্য ছিল। ইতিহাসবিদ লিওনার্ড এ. গর্ডনের মতে, বিশেষ করে অ্যাডাম ফন ট্রট, আলেকজান্ডার ওয়ার্থ এবং ফ্রেদা ক্রেচেমার, “এমিলিকে তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন বলে মনে হয়। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, বিয়ে করেননি সুভাষ এবং যুদ্ধের কঠিন সময়ে আরামদায়ক জীবন পেতে সুভাষচন্দ্রকে ব্যবহার করার জন্যই একসঙ্গে থাকছেন এমিলি।” সুভাষের সহকারী মুকুন্দ রায় ব্যাস জানান, ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টারের সদস্যদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন না এমিলি। “আমি সহ অনেকেই FIC-র ভারতীয় সদস্যদের প্রতি মিস শেঙ্কলের আচরণে বিরক্তি প্রকাশ করেছি। তবে এটা স্পষ্ট ছিল যে, সুভাষচন্দ্র এমিলিকে সরিয়ে দিতে একেবারেই অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু FIC-তে এমিলির বিরোধিতা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে তিনি অবশেষে এমিলিকে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন,” লিখেছেন মুকুন্দ রায় ব্যাস। ১৯৪২ সালের আগস্টে বার্লিন ছেড়ে রওনা হন এমিলি। সুভাষ জানিয়েছিলেন, তাঁর বই ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল জার্মান ভাষায় অনুবাদ করার কাজেই এবার মন দেবেন এমিলি।
১৯৪২ সালের নভেম্বরে, সুভাষ এবং এমিলির কন্যা অনিতার জন্ম হয়। শোনা যায়, এমিলি-সুভাষের একসঙ্গে থাকা এবং তাঁদের সন্তানের বিষয়ে সবটা ভারতে ‘একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি’-ই জানতেন। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমিলি এবং তাঁদের শিশুকন্যাকে ছেড়ে জার্মান সাবমেরিনে চড়ে সুভাষ রওনা হন জাপান-অধিকৃত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে। বাকিটা অনেকেই বিশ্বাস করেন না, এই নিয়ে বিতর্ক অমীমাংসিত। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট জাপানের দখলে থাকা শহর ডাইরেন থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় না কি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান সুভাষ।
অনিতার বয়স তখন মাত্র কয়েকমাস। ১৯৪৫-এর সেই দিনে ভিয়েনার বাড়ির রান্নাঘরে বসেছিলেন এমিলি। রেডিওর খবরে সুভাষচন্দ্র বসুর নিহত হওয়ার খবর পান এমিলি। সুভাষের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ সম্ভব ছিল না এমিলির। বিয়ের সাত বছর আট মাসে এমিলি এবং সুভাষ তিন বছরেরও কম সময় একসঙ্গে কাটিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে কেউ কখনও জানেননি, তাঁদের বিয়ের কথা, প্রেমের কথা। শুধুমাত্র দাদা শরৎকে বাংলায় লেখা একটি চিঠি ইউরোপ ছেড়ে আসার আগেই এমিলিকে দিয়ে এসেছিলেন সুভাষ, নির্দেশ ছিল তাঁর মৃত্যুর পরেই একমাত্র যেন এই চিঠি পোস্ট করা হয়।
১৯৪৭ এর আগস্ট, স্বাধীনতার মাত্র কয়েকদিন বাকি। জওহরলাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের কাছ থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর বড় দাদা শরৎচন্দ্র বসু প্রথম জানতে পারেন, জার্মানিতে একজন মহিলার সঙ্গে থাকতেন সুভাষ, এবং তাঁদের সন্তানও রয়েছে। ভারতে আর কেউই এই বিষয়ে কিছু জানতেন না। যুদ্ধ-পরবর্তী বছরগুলিতে এমিলি শেঙ্কল ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জে কাজ করতেন। মেয়ে এবং তাঁর মাকে নিয়ে একসঙ্গেই থাকতেন। ১৯৪৮ সালে অস্ট্রিয়াতে এমিলির সঙ্গে দেখা করেন শরৎচন্দ্র। এমিলি অবশ্য কখনই ভারতে আসেননি। ১৯৯৬ সালে মারা যান এমিলি শেঙ্কল। যে গোপনীয়তা সুভাষ আর এমিলি যত্ন করে সামলে রেখেছিলেন, মৃত্যুকাল পর্যন্ত সেই রহস্যের চাবি কাউকে দিয়ে যাননি এমিলি। সারা বিশ্ব হিসেব কষে দেখেছে, এত বছর নেতাজির বেঁচে থাকা অস্বাভাবিক, ভারত ভেবেছে, নেতাজি স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে সব বদলে যেত, জনগণ নোটে ছাপা গান্ধির বদলে সুভাষকে চেয়েছে। এমিলি কী ভেবেছেন, কী চেয়েছেন- তা জানা নেই। একজন ‘হিরো’-র সাংসারিক কাহিনি ভারত কখনও জানতে চায়নি, ভারত এখনও বিশ্বাস করতে চায় না।