মেসিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার? বিশ্বকাপ কি অবসান ঘটাল এই বিতর্কের

FIFA World Cup 2022 : ২০২২-এই ছাপিয়েছেন মারাদোনা আর বাতিস্তুতাকে। এরপরও সর্বকালের সেরা তকমা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হবে মেসিকে?

ধবধবে সাদা বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছেন তিনি। সেই অবস্থাতেও নিজের ‘স্বপ্ন’কে পাশে নিয়ে শুয়েছেন। বিশ্বকাপ। আর্জেন্টিনায় ফেরার পর লিওনেল মেসির এই ছবি ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। ২০০৬ সাল থেকে যে স্বপ্ন দেখে আসছেন, সেটি অবশেষে পূরণ হল। তারও আগে ৩৬ বছর ধরে একই স্বপ্ন দেখে চলেছে আর্জেন্টিনা। ১৮ ডিসেম্বরের সেই রাত সমস্ত না পাওয়া ভুলিয়ে দিল। অবশ্য তারপরেও মেসি ভক্তরা চুপ নেই। প্রিয় তারকার জন্য গলা ফাটিয়ে চলেছেন তাঁরা। সেইসঙ্গে আরও একটা দাবিও শোনা যাচ্ছে তাঁদের মুখে। মেসি ভক্তদের দাবি, সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে ১৮ ডিসেম্বরের ফাইনাল। হ্যাঁ, মেসিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার।

আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্স ম্যাচ তখন শেষ হয়ে গিয়েছে। মাঠে অস্থায়ী মঞ্চে এক এক করে চলছে পুরস্কার দেওয়ার পালা। এমবাপের গোল্ডেন বুট, এমি মার্তিনেজের গোল্ডেন গ্লাভের সঙ্গে মেসির গোল্ডেন বল। তখনই কমেন্ট্রি বক্সে কিছু কথা বলে উঠলেন পিটার ড্রুরি। ৫৫ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ কমেন্টেটর মাইকেই বলে উঠলেন, মেসিই হয়তো সর্বকালের সেরা ফুটবলার। লুসাইল স্টেডিয়াম তো বটেই, স্টেডিয়ামের বাইরে এবং গোটা বিশ্বের বহু মানুষের মনের কথাটি যেন বলে দিলেন পিটার।

অবশ্য মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। অলিম্পিক সোনা, লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ, কোপা ডেল রে, কোপা আমেরিকা, ক্লাব বিশ্বকাপ, সাতবার ব্যালন ডি অর… আরও বহু পুরস্কারের পাশে একটাই জায়গা খালি ছিল। বিশ্বকাপ জিতে সেটাও পূরণ হয়ে গেল। উপরন্তু ফুটবল বিশ্বের ধারণা, বিশ্বকাপে যে রকম দক্ষতা দেখিয়েছেন মেসি, এই বয়সেও নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছেন বারবার, অষ্টমবারের ব্যালন ডি অর যেন সময়ের অপেক্ষা। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা, ২০২২-এই ছাপিয়েছেন মারাদোনা আর বাতিস্তুতাকে। এরপরও সর্বকালের সেরা তকমা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হবে মেসিকে?

আরও পড়ুন : কেউ কাঁদছেন রাস্তায় বসে, কেউ ল্যাম্পপোস্টের ওপরে, মেসিদের আগমনে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর্জেন্টিনায়

এই আলোচনায় আসার আগে একবার ফিরে দেখা যাক সর্বকালের সেরাদের ভিড়ে আছেন কারা। ঠিক কীসের নিরিখে ‘গোট’ তকমা দেওয়া হবে, তার সংজ্ঞা এখনও কেউ নির্ধারণ করতে পারেনি। বারবার সামনে এসেছে প্রতিযোগিতা। লিওনেল মেসির সঙ্গে অবধারিত ভাবে চলে আসবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর (Cristiano Ronaldo) নাম। পর্তুগিজ কিংবদন্তি এই বিশ্বকাপে নিজের সেরাটা দিতে পারেননি। কিন্তু সেজন্য তাঁর দক্ষতাকে ফেলে উচিত হবে না।

২০১৬-র ইউরো জিতিয়েছেন পর্তুগালকে। রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, জুভেন্তাসে সর্বোচ্চ পারফরমেন্স দিয়েছেন। ক্লাব ফুটবলে ৬৫১ ম্যাচে ৬৩৬ টি গোল, দেশের হয়ে ১১৮ টি গোল – তাঁর পরিসংখ্যান অতিক্রম করা প্রায় অসাধ্য। সেইসঙ্গে মেসির সঙ্গে ব্যালন ডি অরের মঞ্চে রাজত্ব করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। সর্বকালের সেরা কে – এই প্রশ্ন এলে এই দু’জনই সামনে চলে আসবেন। মেসি বিশ্বকাপ পেলেও রোনাল্ডো ভক্তরা, এবং স্বয়ং রোনাল্ডোও যে সেটা স্বীকার করবেন না কিছুতেই – তা বলাই বাহুল্য। মেসি-রোনাল্ডো দ্বৈরথ এখনও জারি থাকবে। আর এই দ্বৈরথ বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কাজেই সর্বকালের সেরার দৌড় থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে সরিয়ে রাখা উচিত হবে না।

তবে মেসি, রোনাল্ডোর আগেও ফুটবল বিশ্ব দেখেছে কিংবদন্তিদের। দুনিয়া দেখেছে পেলে (Pele) নামের এক অতিমানবকে। স্বয়ং ফিফা তাঁকে ‘সর্বকালের সেরা’ বলেছে। ব্রাজিলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জয়, অবিশ্বাস্য গোল, ফুটবল দক্ষতা প্রশ্নাতীত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পেলে এক দৃষ্টান্ত। যদিও আতসকাচের তলায় রয়েছেন তিনিও। সেই সময়ের ফুটবলের সঙ্গে আজকের খেলা বদলে গিয়েছে অনেকটা। এসেছে প্রযুক্তি। লাতিন আমেরিকাকে পদে পদে টেক্কা দিচ্ছে ইউরোপ। পেলের সময়ের ভিডিও ফুটেজও যে খুব বেশি আছে, বলা যাবে না। তাই আধুনিক প্রজন্ম প্রশ্ন তুলছে প্রতিযোগিতার মান নিয়ে। কিন্তু পেলেকে অস্বীকার করার সাধ্য আছে কার? তিনি ছাড়া ফুটবল অসম্পূর্ণ।

আরও পড়ুন : সংসার সামলে মডেলিং এবং নিজস্ব বুটিক, ‘মেসির স্ত্রী’ পরিচয়কে যেভাবে ছাপিয়ে গেলেন আন্তোনেল্লা

এর পরের প্রজন্মে চলে আসেন আরও দুই নক্ষত্র – যোহান ক্রুয়েফ এবং দিয়েগো মারাদোনা। টোটাল ফুটবলের জনক ক্রুয়েফের ফুটবল স্রেফ খেলা নয়, আদ্যোপান্ত একটা দর্শন। ১৯৯৯ সালে তাঁকে ইউরোপের শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করা হয়। বিশ্বের নিরিখে পেলের পরই শতাব্দীর দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড়। তাঁর খেলা, তাঁর ভাবনাচিন্তা, ট্যাকটিক্স ফুটবলকে বদলে দেয়। বিশ্বকাপ জেতেননি তিনি, কিন্তু আধুনিক ফুটবলারদের মসিহা তো ক্রুয়েফই। অন্যদিকে আছেন দিয়েগো মারাদোনা। আর্জেন্টিনার প্রথম স্বপ্নের সওদাগর। ১৯৭৮-এর জয়ের পর ’৮৬-র জয়ের প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। সেইসঙ্গে প্রথমবারের জন্য ফুটবল দেখে যুযুধান – পেলে না মারাদোনা? তাঁর বাঁ পায়ের জাদু, ড্রিবলিং এখনও ফুটবল দুনিয়ায় ট্রেন্ডিং।
এরপরই চলে আসেন জিনেদিন জিদান এবং রোনাল্ডো নাজারিও। রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হিসেবেও সফল জিদান। সেইসঙ্গে

নিজের সময়ের কিংবদন্তি ফুটবলার। মেসির মতো তিনিও প্রায় সমস্ত ট্রফিই সাজিয়েছেন নিজের ক্যাবিনেটে। জিদানের হাত ধরে ১৯৯৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ ঢোকে ফ্রান্সে। মাঠের মধ্যে তাঁর স্কিল, গোল করা এবং করানোর দক্ষতা – এক কথায় অতুলনীয়। অন্যদিকে ব্রাজিলের রোনাল্ডোর ঈগলের নজর আর ক্ষিপ্রতা। ব্রাজিলের আক্রমণ ভাগের বিশ্বস্ত যোদ্ধা, গোলের গন্ধ খুঁজে নিতে পারেন ঠিক। ২০১৪-র বিশ্বকাপ পর্যন্ত বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড তাঁরই ছিল। জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসে সেসব ভেঙে দেন।

কাজেই আর্জেন্টিনার ভক্তরা যতই বলুন না কেন, মেসিই সর্বকালের সেরা কিনা সেই বিতর্ক এখনও জারি রয়েছে। এতজন প্রবাদপ্রতিম খেলোয়াড়, নিজের সময়ের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে টপকে সেরাদের সিংহাসন অর্জন করতে পেরেছেন মেসি? তাঁর ভক্তরা দরাজ গলায় সার্টিফিকেট দিলেও, বিতর্ক এখনও থামেনি।

More Articles